সরকারের পক্ষ নিল চীন, জটিলতা আরও বাড়াবে বলছেন বিশেষজ্ঞরা

কূটনৈতিক প্রতিবেদক, ঢাকা
প্রকাশ : ১৫ জুন ২০২৩, ০৮: ৪৪
আপডেট : ১৫ জুন ২০২৩, ০৯: ০৭

বাংলাদেশে গণতন্ত্রের মান, নির্বাচন, মানবাধিকার পরিস্থিতিসহ অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয়ে বরাবরই নীরবতা অবলম্বনের কৌশল অনুসরণ করে এসেছে চীন, রাশিয়া, জাপানসহ সামরিক ও অর্থনৈতিক পরাশক্তি দেশগুলো। নীরবতা ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র জাপান সম্প্রতি নির্বাচন নিয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। কথা বলছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে গত মাসে বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এই অবস্থায় ভূরাজনীতিতে দেশটির প্রতিদ্বন্দ্বী চীন এবং রাশিয়াও এখন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রতিক্রিয়া দেখাতে শুরু করেছে।

চীন গতকাল বুধবার মার্কিন নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিক্রিয়ার প্রশংসা করেছে। ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারসহ আন্তর্জাতিক প্রায় সব ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের এই বৈরী দেশটি বলেছে, কড়া প্রতিক্রিয়া দেখানোর মাধ্যমে শেখ হাসিনা বিশ্ব সম্প্রদায়ের একটি বড় অংশ, বিশেষ করে উন্নয়নশীল বিশ্ব ও তাঁর দেশের মানুষের মনোভাবের প্রতিফলন ঘটিয়েছেন।

মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন ও সংস্থাটির সাবেক ও তদানীন্তন সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। আর গত ২৪ মে দেশটি বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করে। এতে বলা হয়, বাংলাদেশে নির্বাচনে অনিয়ম-জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের ভিসা দেওয়া হবে না। এ ছাড়া বাংলাদেশ থেকে শান্তিরক্ষা মিশনের সদস্য সংগ্রহে কড়াকড়ি আরোপ করার জন্য গত মঙ্গলবার জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ওয়াশিংটনভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)।

এর আগে আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হবে–এমন আশাবাদ ব্যক্ত করে ২০২২ সালের ১৪ নভেম্বর ঢাকায় জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি এক অনুষ্ঠানে বলেন, তিনি (২০১৮ সালের নির্বাচনে) ভোটের দিন ‘ব্যালট বাক্স ভর্তি’ করার কথা শুনেছেন। কিন্তু ‘আগের রাতে কিছু পুলিশ ব্যালট বাক্স ভর্তি করে দিয়েছে, যা তিনি অন্য কোনো দেশে কখনো শোনেননি।’

আর ৮ জুন বাংলাদেশে নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আলেক্সান্ডার মন্টিটস্কি বলেছেন, তাঁর দেশ আশা করে বাংলাদেশে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে। চট্টগ্রামে এক মতবিনিময় অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তৃতায় এই মন্তব্য করে তিনি বলেন, নির্বাচন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। রাশিয়া অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না।

সর্বশেষ যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রেটিক পার্টির কংগ্রেস সদস্য উইলিয়াম বিল কিটিং গতকাল ১৪ জুন করা এক টুইটে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছেন, বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে তিনি (বিল) উদ্বিগ্ন। বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো ও কর্মকর্তাদের মধ্যে যাঁরা মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত, তাঁদের জবাবদিহির আওতায় আনতে বলা অব্যাহত রাখতে তিনি ব্লিঙ্কেনের প্রতি আহ্বান জানান।

বিল টুইটে ৮ জুন বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে পাঠানো ছয় কংগ্রেসম্যানের চিঠিও যুক্ত করে দেন। উইলিয়াম কিটিং ছাড়াও অন্য যে পাঁচ কংগ্রেসম্যান চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন, তাঁরা হলেন জেমস ম্যাকগভার্ন, বারবারা লি, জিম কস্টা, দিনা টিটাস ও জেমি রাস্কিন।

চিঠিতে তাঁরা ২০২১ সালে র‍্যাবের ওপর আরোপ করা নিষেধাজ্ঞা এবং বাংলাদেশের জন্য গত মে মাসে ঘোষণা করা মার্কিন ভিসা নীতির প্রতি সমর্থন জানান।
এমন এক প্রেক্ষাপটে চীনের প্রতিক্রিয়ার বৈশ্বিক তাৎপর্য আছে বলে মনে করা হচ্ছে।

চীনের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিন গতকাল বেইজিংয়ে এক প্রশ্নের জবাবে সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুধু বাংলাদেশের জনগণের শক্তিশালী অবস্থান নয়, বরং তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের, বিশেষ করে উন্নয়নশীল বিশ্বের বড় অংশের মনের কথাও বলেছেন।’

চীন সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া সংবাদমাধ্যম গ্লোবাল টাইমসের এক সাংবাদিক র‍্যাবের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ‘দৃঢ়-কঠিন প্রতিক্রিয়া’ সম্পর্কে প্রশ্ন করলে মুখপাত্র বলেন, চীন সরকার এ বিষয়ে শেখ হাসিনার মন্তব্যের প্রশংসা করেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের নাম উল্লেখ না করে ওয়াং বলেন, ‘প্রকৃতপক্ষে একটি নির্দিষ্ট দেশ নিজ দেশের জাতিগত বৈষম্য, বন্দুক-সহিংসতা ও মাদকের বিস্তারের মতো ভয়াবহ সমস্যার প্রতি দৃষ্টিপাত না করে, দীর্ঘদিন ধরে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের অজুহাতে বাংলাদেশ এবং বিশ্বের অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে আসছে।’

ওয়াং বলেন, চীন বাংলাদেশের স্বাধীন দেশীয় ও বৈদেশিক নীতি সমুন্নত রাখতে এর জাতীয় বাস্তবতার সঙ্গে মানানসই উন্নয়নের পথ অনুসরণকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে।

চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আরও বলেন, চীন সব ধরনের আধিপত্যবাদ ও ক্ষমতার রাজনীতির বিরোধিতা করতে, জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক আইন দ্বারা পরিচালিত আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণকারী মৌলিক নিয়মাবলি সমুন্নত রাখতে বাংলাদেশ ও অন্যান্য দেশের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত।

তবে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে চীনের কথা বলা বাংলাদেশের জন্য জটিলতা বাড়াবে বলে মনে করেন বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের (বিইআই) প্রেসিডেন্ট হুমায়ুন কবির। এতে বাংলাদেশ চীনের প্রতি ঝুঁকছে বলে মার্কিনদের যে ধারণা, তা আরও বদ্ধমূল হবে বলে মনে করেন তিনি।

চীন ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তৃতীয় দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার বিষয়ে কথা বলল এবং চীনের এই মন্তব্য বাংলাদেশের কোনো কাজে আসবে কি না, এমন প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক এই রাষ্ট্রদূত বলেন, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বড় দেশ হিসেবে চীন বিবৃতিটি দিয়েছে। এ বিবৃতি তারা না দিলেই ভালো করত। কারণ, এতে দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশের কোনো লাভ হবে না।

বিভিন্ন দেশ যা-ই বলুক না কেন, কাজকর্মে ও কূটনৈতিক চর্চায় বাংলাদেশ একধরনের ভারসাম্য বজায় রাখতে চায়—এমন পর্যবেক্ষণ দিয়ে বিইআই প্রেসিডেন্ট বলেন, চীন বা অন্য কোনো দেশ যদি স্বপ্রণোদিত হয়ে বিবৃতিটি দিয়ে থাকে, তবে তাদের বলা উচিত, তারা এ ধরনের বিবৃতি না দিলে ভালো হয়।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত