রংপুরে নিখিলের নীলের ভুবন

শিপুল ইসলাম, রংপুর
প্রকাশ : ১৯ আগস্ট ২০২৩, ০৮: ০৭

একসময় ইংরেজ নীলকরদের অমানবিক অত্যাচারে অতিষ্ঠ রংপুরের চাষিরা বিদ্রোহ করেছিলেন। সেই রংপুরেই কিনা এখন একটু বাড়তি উপার্জনের আশায় কৃষকেরা স্বেচ্ছায় নীল চাষ করছেন। তাঁদের প্রেরণা জোগাচ্ছেন এক তরুণ। তাঁর নাম নিখিল রায়। তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন নীল তৈরির কারখানা। সেখানে শতাধিক নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। আর রংপুর সদর, তারাগঞ্জ, গঙ্গাচড়া এবং নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলায় নীল চাষ করছেন কয়েক হাজার কৃষক।

রংপুর-দিনাজপুর মহাসড়কের পাশে গঙ্গাচড়া উপজেলার সীমান্ত এলাকা হরকলি ঠাকুরপাড়া গ্রামে ২২ শতাংশ জমিতে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে কারখানাটি। নিখিল রায় এলাকার অভাবী নারী-পুরুষকে সংগঠিত করে প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘হস্ত কুটিরশিল্প প্রশিক্ষণ ও কল্যাণকেন্দ্র’ নামক একটি সংগঠন।

রংপুর সদর থেকে ১৫ কিলোমিটার ও তারাগঞ্জ থেকে ৭ কিলোমিটার দূরে গঙ্গাচড়ায় অবস্থিত কারখানায় যাওয়ার পথে সড়কের দুই ধারে বিস্তীর্ণ এলাকায় চোখে পড়ে নীলখেত। হরকলি গ্রামের নীলচাষি প্রদীপ কুমার বলেন, নীলগাছ স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে মালগাছ হিসেবে পরিচিত। এই গাছ পাঁচ-ছয় ফুট লম্বা হয়। এগুলো জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হতো। কিন্তু নিখিলের কল্যাণে এখন নীল চাষ করে কৃষকেরা বাড়তি টাকা আয় করছেন।

তারাগঞ্জের বালাবাড়ি গ্রামের কৃষক মতিয়ার রহমান বলেন, প্রতি একর জমির নীলগাছ থেকে প্রায় তিন হাজার কেজি পাতা পাওয়া যায়। নিখিলের কারখানায় প্রতি কেজি পাতা চার টাকা দরে কেনা হয়। এই হিসাবে এক একর জমির নীলগাছের পাতার দাম দাঁড়ায় ১২ হাজার টাকা। তা ছাড়া প্রতি একর জমির শুকনা নীলগাছ জ্বালানি হিসেবে বিক্রি হয় ৯ থেকে ১০ হাজার টাকায়।

ঠাকুরটারী গ্রামের কৃষক ইন্দ্রজিৎ রায় বলেন, এক একর জমিতে তিনি নীলগাছের চাষ করেছেন। তিন দফায় নীলপাতা বিক্রি করেছেন ১৩ হাজার ৩০০ টাকা। জ্বালানি হিসেবে মালগাছ বিক্রি করেছেন ৫ হাজার ৮০০ টাকার। আবার যেসব গাছ আছে, তা বিক্রি করতে পারবেন আরও তিন থেকে চার হাজার টাকা। এক একর জমিতে তাঁর খরচ হয়েছে প্রায় ২ হাজার টাকা।

নিখিলের নীল তৈরির কারখানায় দেখা গেছে, গ্রামের ২৫-২৬ জন নারী সেখানে নীল তৈরিতে ব্যস্ত। জানতে চাইলে ঠাকুরটারী গ্রামের গোলাপী রানী বলেন, ‘নিখিল দাদার কাছে প্রশিক্ষণ নিয়ে নীল তৈরিসহ আনুষঙ্গিক কাজ করি। এতে সংসার ভালোভাবেই চলে যায়।’ এই কারখানায় কাজ করে সংসারে সচ্ছলতা ফিরে এসেছে বলে জানান হরকলি এলাকার ময়না বেগম, বিউটি বেগম, ঠাকুরটারীর শোবা রানী, প্রমিলা রানী, প্রভা রানী, সাবিত্রী বালাসহ অনেকে। এই কারখানার শ্রমিক প্রতিদিন মজুরি পান ২৫০ টাকা করে।

নিখিল রায় জানান, তাঁর জন্ম গঙ্গাচড়ার উপজেলার হরকলি ঠাকুরটারী গ্রামে। এসএসসি পাস করার পর ২০০২ সালে পল্লিচিকিৎসকের কোর্স করেন। এরপর নিজ গ্রামে বিনা পয়সায় চিকিৎসাসেবা শুরু করেন। ২০০৩ সালে এলাকার অভাবী নারী-পুরুষদের সংগঠিত করে চালু করেন হস্ত কুটিরশিল্প প্রশিক্ষণ কল্যাণকেন্দ্র। ২০০৬ সালে ‘এমসিসি বাংলাদেশ’ নামক একটি সংস্থায় নীল তৈরির ওপর প্রশিক্ষণ নেন। পরে সংস্থাটির আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতায় শুরু করেন পাতা থেকে নীল তৈরির কাজ।

নিখিল বলেন, তাঁর কারখানার তালিকাভুক্ত চাষি ৭২০ জন। তাঁরা প্রায় ২৫০ একর জমিতে নীলের চাষ করেন। আরও অন্তত ৩৯০ জন সাধারণ চাষি রয়েছেন। তাঁরা ১২৫ একর জমিতে নীল চাষ করেন।

নিখিল রায় আরও বলেন, প্রতি মৌসুমে (জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত) তাঁর কারখানায় প্রায় অর্ধকোটি টাকা মূল্যের নীল তৈরি হয়। শ্রমিকদের মজুরি দিয়ে যে লাভ থাকে, তা জমা হয় সংগঠনের নামে। শ্রমিকদের দুর্দিনে বা প্রয়োজনে ওই টাকা কাজে লাগানো হয়। 

রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ওবায়দুর রহমান মণ্ডল বলেন, ব্রিটিশ আমলে রংপুর অঞ্চলের চাষিরা নীলকরদের অমানবিক অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে নীল চাষ বন্ধের দাবিতে আন্দোলন করেছিলেন। এখন নিখিলের বদৌলতে রংপুরের অনেক নীলচাষির মুখে হাসি ফুটছে।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

টাঙ্গাইলে দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান র‍্যাবের হাতে গ্রেপ্তার

পুলিশ ফাঁড়ি দখল করে অফিস বানিয়েছেন সন্ত্রাসী নুরু

ঢাকার রাস্তায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালকদের বিক্ষোভ, জনদুর্ভোগ চরমে

শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ সুরক্ষায় নতুন উদ্যোগ

জাতিকে ফ্রি, ফেয়ার অ্যান্ড ক্রেডিবল নির্বাচন উপহার দিতে চাই: নতুন সিইসি

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত