Ajker Patrika

বেড়েছে বিচ্ছেদ, শৈশব হারাচ্ছে শিশু

অর্চি হক, ঢাকা
আপডেট : ১৫ মে ২০২৩, ১০: ৪৯
বেড়েছে বিচ্ছেদ, শৈশব হারাচ্ছে শিশু

মতের মিল না হওয়ায় সংসার ভেঙেছে আগেই। বিচ্ছেদের পর সন্তানের অভিভাবকত্ব নিয়ে তিন বছর ধরে আইনি লড়াইয়ে আছেন ইমরান শরীফ ও নাকানো এরিকো। মা-বাবার এই লড়াইয়ের মধ্যে পড়ে হারিয়ে যাচ্ছে তাঁদের তিন সন্তানের শৈশব। পারিবারিক কাঠামোটাই ভুলতে বসেছে তারা। বড় বোন জেসমিন থাকছে মায়ের কাছে, মেজ বোন লায়লা বাবার কাছে, আর ছোট বোন সোনিয়া আছে নানির কাছে।

জাপানি মায়ের এই তিন সন্তানের মতো অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন পার করছে শিশু অর্ণ আর বর্ণ। মা-বাবার বিচ্ছেদের পর থেকে কখনো দাদা-দাদি, আবার কখনো নানা-নানির কাছে থাকছে তারা। দাদি শাহিনা চৌধুরী বলছিলেন, একেক সময় একেক জায়গায় থাকার কারণে পরিবার কী জিনিস, সেটাই অর্ণ আর বর্ণ বুঝে উঠতে পারছে না। মানসিকভাবে সব সময় মনমরা থাকে তারা। লেখাপড়ার ক্ষেত্রেও তাদের সমস্যা হচ্ছে।

শুধু জেসমিন, লায়লা কিংবা অর্ণ ও বর্ণ নয়, মা-বাবার বিচ্ছেদের কারণে স্বাভাবিক শৈশব হারাচ্ছে অসংখ্য শিশু। পারিবারিক জটিলতার সঙ্গে সঙ্গে সামাজিকভাবেও হেয় হতে হয় তাদের। এতে এসব শিশুর মনোজগতে পড়ছে নেতিবাচক প্রভাব।

দেশের ভেতরে ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পরিচালিত বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্বে এক যুগ আগের তুলনায় উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে বিবাহবিচ্ছেদ। গত মার্চে প্রকাশিত বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস-২০২১ অনুযায়ী, ২০০৬ সালে দেশে তালাকের হার ছিল দশমিক ৬, বর্তমানে এই হার দশমিক ৭৩। রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে দিনে ৩৭টি বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা ঘটে। গত বছর ১২ হাজার ৮২৪টি তালাক কার্যকর হয়। অর্থাৎ প্রতি মাসে তালাক হয় গড়ে ১ হাজার ৬৮টি।

পরিবারব্যবস্থার এমন ভঙ্গুর পরিস্থিতির মধ্যেই আজ ১৫ মে সারা বিশ্বে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক পরিবার দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য, ‘জনসংখ্যার প্রবণতা এবং পরিবার’। ১৯৯৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের এক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৫ মে আন্তর্জাতিক পরিবার দিবস হিসেবে ঘোষিত হয়।পরিবারের সব সদস্যের একসঙ্গে জীবন কাটানোকে উৎসাহিত করতে জাতিসংঘ এই উদ্যোগ নেয়।

মানবাধিকারকর্মী, আইনজীবী ও মনোবিদেরা বলছেন, নারীদের ওপর মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন, পরকীয়া এবং আত্মনির্ভরশীলতা বেড়ে যাওয়ার কারণে বিবাহবিচ্ছেদ বাড়ছে। মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবী এলিনা খান বলেন, বিয়ে হচ্ছে পারস্পরিক বোঝাপড়ার একটা সম্পর্ক।

কিন্তু অনেকেই এটা বুঝতে চায় না। অনেক ক্ষেত্রে ছেলে বা মেয়ের পরিবারের লোকজনেরও বিচ্ছেদের ব্যাপারে একধরনের ইন্ধন থাকে। সম্পর্কে সমস্যা তৈরি হলে দুই পরিবারেরই উচিত তাদের ছেলেমেয়েদের কাউন্সেলিং করা। আরেকটা বিষয় হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। সামাজিক মাধ্যমে এমন কিছু বিষয় থাকে, যেগুলো মারাত্মক উসকানিমূলক। রাতদিন সামাজিক মাধ্যমে থাকার কারণে অনেকের সংসারের প্রতি অনীহা তৈরি হয়। অনেকে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ে।সেটার জন্য বৈবাহিক সম্পর্কে বিশাল ধস নামছে।

জনসংখ্যা ও আবাসনশুমারি-২০২২ অনুযায়ী, দেশে জনসংখ্যা বিবেচনায় তালাকপ্রাপ্তের হার দশমিক ৪২ শতাংশ এবং দাম্পত্য বিচ্ছিন্নের হার দশমিক ৩৭ শতাংশ। বিবাহবিচ্ছেদে দেশের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে রাজশাহী বিভাগ। সেখানে এর হার দশমিক ৬১ শতাংশ। বিবাহবিচ্ছেদের হার বরিশালে দশমিক ২৯ শতাংশ, চট্টগ্রামে দশমিক ৩০, ঢাকায় দশমিক ৪০, খুলনায় দশমিক ৫৫, ময়মনসিংহে দশমিক ৪০, রংপুরে দশমিক ৩৮ ও সিলেটে দশমিক ৪৩ শতাংশ।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ফারজানা রহমান বলেন, একেকটি বিচ্ছেদ মানে একেকটি পরিবারের ভাঙন। বিচ্ছেদ পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে সুন্দরভাবে বা তিক্ততার মধ্য দিয়ে—দুভাবেই হতে পারে। বিচ্ছেদ যদি তিক্ততার মধ্য দিয়ে হয়, তবে শিশুর মনোজগতে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। সে ভবিষ্যৎ সম্পর্কের ক্ষেত্রে একধরনের ভয় ও অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকে। সামাজিকভাবে নানা কটু কথাও শুনতে হয়। যার প্রভাবে অনেক ক্ষেত্রে সে মাদকাসক্তও হয়ে পড়ে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত