ডোলমা খাংয়ের চূড়ায় বাংলাদেশ

মন্টি বৈষ্ণব, ঢাকা
প্রকাশ : ১৬ নভেম্বর ২০২২, ১১: ৩৩

পর্বত আরোহণ খুব সহজ বিষয় নয়। আমাদের দেশের নারীরা এ বিষয়ে বেশ এগিয়ে যাচ্ছেন। নিকট অতীতে আমাদের বেশ কয়েকজন নারী সফলভাবে পর্বত অভিযানে অংশ নিয়েছেন। সম্প্রতি হিমালয়ের ৬ হাজার ৩৩২ মিটার উঁচু ডোলমা খাং পর্বতচূড়ায় বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছেন শায়লা বিথী। ৫ নভেম্বর ডোলমা খাং পর্বতচূড়া জয় করেন পিরোজপুরের স্বরূপকাঠির মেয়ে বিথী।  

ডোলমা খাং পর্বতে যাত্রা
বিথী বেশ কয়েক বছর ধরে পর্বত অভিযানের সঙ্গে জড়িত। ২০১৫ সালে তিনি প্রথম হিমালয়ে যান। এর পর থেকে প্রায় প্রতিবছর কোনো না কোনো অভিযানের অংশ হয়েছেন তিনি। এ বছর ঠিক করেছিলেন ৮ হাজার মিটার উঁচু কোনো পর্বতের চূড়ায় উঠবেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত স্পনসর জোগাড়ে ব্যর্থ হন তিনি। তবে হতাশ না হয়ে যে এজেন্সির মাধ্যমে তিনি পাহাড়ে যাতায়াত করেন, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন বিথী। তারা তাঁকে ৬ হাজার ৫০০ মিটার থেকে একটু বেশি উঁচু পর্বতের কথা বলেন। সেই পর্বত আরোহণের জন্য যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন, সেটাও জোগাড় করতে পারেননি বিথী। পরে এজেন্সির দায়িত্বপ্রাপ্তদের পরামর্শে ডোলমা খাং পর্বতের চূড়ায় উঠবেন ঠিক করেন। কারণ এর আগে বাংলাদেশ থেকে কেউ ডোলমা খাং পর্বতে যাননি। এভাবেই শুরু ডোলমা খাং পর্বত অভিযানের।

যুদ্ধবিরোধী প্ল্যাকার্ড
বিথী পর্বতে গেলে যুদ্ধবিরোধী, ধর্ষণবিরোধী, পরিবেশ সুরক্ষাসংবলিত কিছু প্ল্যাকার্ড নিয়ে যান। তিনি বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী আমরা একটা অস্থির সময় পার করছি। বিশ্বের কোনো না কোনো দেশে যুদ্ধ লেগেই আছে। এটি মানবসভ্যতার জন্য ভালো কোনো বিষয় নয়। যুদ্ধে মানুষ মারা যাচ্ছে, প্রকৃতি ধ্বংস হচ্ছে, থমকে যাচ্ছে অনেক দেশ, শিশুরা হুমকির মুখে পড়ছে। যুদ্ধরত দেশগুলো বাদেও ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে পুরো পৃথিবীর। ধ্বংসের পর আবার সবকিছু তৈরি করতে হচ্ছে। যুদ্ধ পৃথিবীকে পিছিয়ে দিচ্ছে।’ বিথী আরও বলেন, ‘আমি পৃথিবীজুড়ে শান্তির বারতা ছড়িয়ে দিতে চাই। আমি জানি না, আমার এই বার্তা 
কত মানুষের কাছে পৌঁছাবে? আমি চেষ্টা করছি যুদ্ধবিরোধী বার্তা অনেকের কাছে পৌঁছে দিতে। আমি বলতে চেয়েছি, 
যুদ্ধ বন্ধ হোক।’

বাধাবিপত্তি
পর্বতারোহণে একজন পর্বতারোহীকে অনেক বাধাবিপত্তি অতিক্রম করতে হয়। অনেক বেশি ধৈর্যের পরীক্ষাও দিতে হয়। পর্বতারোহী শায়লা বিথীকেও অনেক লড়াই করতে হয়েছে। কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে আমার অনেক কিছু করার ইচ্ছে হতো। গান করতে চাইতাম, নাচও করতে চাইতাম। কিন্তু পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি আমার পক্ষে ছিল না। অনেক কথা শুনতে হতো। তাই কিছু করতে পারতাম না। সে জায়গায় এখন আমি পর্বতে পর্বতে ঘুরে বেড়াচ্ছি। এটা আমার জন্য অনেক বড় পাওয়া। তবে, এ সময়ে আমি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও অনেক ঝামেলার মুখোমুখি হচ্ছি। আমার পোস্ট করা ছবির নিচের মন্তব্য দেখলে সেটা বোঝা যায়। তবে জীবনসঙ্গী আমার পর্বত অভিযানের কাজে অনেক সহযোগিতা করে।’

বেদিং গ্রামের অন্য রকম স্মৃতি
পাহাড় অভিযানে অনেক স্মৃতি জমা হয়। সাম্প্রতিক অভিযানেও তেমন ভালো লাগার স্মৃতি আছে বিথীর। কয়েক দিন পাহাড়ে ট্রেকিং করার পর তাঁরা পৌঁছান বেদিং নামে একটি গ্রামে। সেখানে তিনি খাবার খেতে পারছিলেন না। পুরো অভিযানে এমনটা আগে কখনো হয়নি। বেদিং গ্রামে পৌঁছানোর পর উচ্চতায় খাপ খাওয়ানোর জন্য আরও দুই দিন অতিরিক্ত থাকার কথা ছিল। বিথী সিদ্ধান্ত নিলেন, বেদিং গ্রামের জন্য বরাদ্দ করা দুই দিন তিনি গ্রামে থাকবেন না। কারণ খাবার খেতে না পারলে ওই উচ্চতায় আরও দুই দিন থাকা মানে শক্তি শেষ করে ফেলা। যার প্রভাবে পরে আরও খারাপ পরিস্থিতি হতে পারে। তিনি তাঁর মূল গাইডকে জানান, বেদিং গ্রামে না থেকে তিনি হাইক্যাম্পে চলে যেতে চান। সেখানে শরীর বেশি খারাপ লাগলে নিচে নেমে যাবেন। গাইড প্রথমে না করলেও  পরে মেনে নেন।
এরপর তাঁরা বেদিং গ্রাম থেকে সরাসরি হাইক্যাম্পে চলে যান। বেদিং গ্রামের উচ্চতা ছিল ৩ হাজার মিটারের বেশি। আর হাইক্যাম্পের উচ্চতা ছিল ৪ হাজার ৯০০ মিটারের কাছাকাছি। প্রায় ১ হাজার মিটার ওপরে চলে যান তাঁরা। সেখান থেকে তাঁদের আরও ১ হাজার ৩৩২ মিটার ওপরে যেতে হবে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, হাইক্যাম্পে পৌঁছানোর পর শায়লা বিথী সুস্থ ছিলেন এবং সফলভাবে অভিযান শেষ করেন।

ঝুলিতে যা কিছু আছে
শায়লা বিথীর অভিজ্ঞতার ঝুলিতে রয়েছে অনেক পর্বত অভিযানের গল্প। তিনি ২০১৫ সালে নেপালের মাউন্ট ক্যাজু রি বেসক্যাম্পে ট্রেকিং করেন, ২০১৬ সালে ভারতের নেহরু ইনস্টিটিউট অব মাউন্টিনিয়ারিং থেকে পর্বতারোহণের মৌলিক প্রশিক্ষণ কোর্স সম্পন্ন করেন ‘এ’ গ্রেড নিয়ে। ওই বছরেই তিনি নেপালের ৬ হাজার ৪৭৪ মিটার উঁচু মেরা পর্বতের চূড়ায় ওঠেন। ২০১৭ সালে নেপালের লারকে পর্বত অভিযানে যান। সে বছরের এপ্রিল মাসে নেপালের থ্রংলা পাস ট্রেকিং সম্পন্ন করেন। ২০১৮ সালের মে মাসে তিব্বতের ৭ হাজার ৪৫ মিটার উঁচু লাকপারি পর্বতচূড়ায় আরোহণ করেন। ২০১৯ সালে নেপালের মাউন্ট ফারচামোতে ৬ হাজার ১৮৭ মিটার অভিযান সম্পন্ন করেন। প্রথম বাংলাদেশি নারী হিসেবে হিমালয়ের দুর্গম তাশিলাপচা গিরিপথ অতিক্রম করেন। ২০২১ সালে নেপালের ৬ হাজার ১৮৯ মিটার উচ্চতার আইল্যান্ড পিক জয় করেন। ২০২১ সালে প্রথম বাংলাদেশি  হিসেবে নেপালের বিখ্যাত থ্রি পাস ট্রেকিং সম্পন্ন করেন। আর এ বছর প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে নেপালের ৬ হাজার ৩৩২ মিটার উঁচু ডোলমা খাং পর্বত জয় করেন বিথী।

স্বপ্ন এবং আক্ষেপ
একজন পর্বত আরোহী হিসেবে শায়লা বিথী আগামী বছর এভারেস্ট অভিযানে যেতে চান। পর্বত আরোহণের কথা বলতে গিয়ে দুঃখ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে পর্বত আরোহণকে স্পোর্টস হিসেবে দেখা হয় না। এ জন্য সরকারিভাবে কোনো পৃষ্ঠপোষকতার ব্যবস্থাও নেই। এ ক্ষেত্রে যদি স্পনসরদের সহযোগিতা পাওয়া যায়, তাহলে পর্বত আরোহণে আমাদের দেশের নারীরা অনেক বেশি রেকর্ড তৈরি করবে।’ 

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

আবু সাঈদকে ৪–৫ ঘণ্টা পরে হাসপাতালে নেওয়া হয়—শেখ হাসিনার দাবির সত্যতা কতটুকু

মেট্রোরেল থেকে আমলাদের বিদায়, অগ্রাধিকার প্রকৌশলীদের

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

বিমানবন্দরে সাংবাদিক নূরুল কবীরকে হয়রানির তদন্তের নির্দেশ প্রধান উপদেষ্টার

কবি নজরুল ও সোহরাওয়ার্দী কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ৩৫ কলেজের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত