ড. মইনুল ইসলাম
সম্প্রতি পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান মিডিয়ায় একটি সরল স্বীকারোক্তি করেছেন, ‘হাওরে পাকা সড়ক বানিয়ে নিজের পায়ে কুড়াল মেরেছি।’ তাঁর এই বক্তব্য দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। দেশের জনগণের মধ্যে একজন সৎ, সজ্জন, মেধাবী, সরল ও স্পষ্টভাষী ব্যক্তি হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জনকারী পরিকল্পনামন্ত্রী যখন বিবেকের দংশনে এহেন সরল স্বীকারোক্তি দিয়ে অপরাধবোধ থেকে নিষ্কৃতি পেতে চাইছেন, তখন ব্যাপারটিকে গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা-বিশ্লেষণে নিয়ে আসা প্রয়োজন মনে করছি। হাওরে নির্মিত ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রামের সংযোগকারী প্রায় ৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ দৃষ্টিনন্দন এ মহাসড়কটি ইতিমধ্যেই অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি পর্যটক-আকর্ষণ হিসেবে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। দেশের পত্র-পত্রিকা, ব্রডকাস্ট মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়ায় এ সড়কটি আকর্ষণের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে উদ্বোধনের পর থেকেই।
সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলের কৃতী সন্তান জনাব মান্নানের এই খবরগুলো সবই জানা আছে। হাওরাঞ্চলের আরেক কৃতী সন্তান সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ প্রধানত এ প্রকল্পটি গ্রহণ ও বাস্তবায়নের জন্য সরকারকে প্রভাবিত করেছেন। প্রথম দৃষ্টিতে এ মহাসড়কটিকে হাওরাঞ্চলে যোগাযোগব্যবস্থার যুগান্তকারী পরিবর্তন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক বিবেচনা করাই সংগত মনে হতে পারে। কিন্তু জনাব মান্নান এই অঞ্চলের সন্তান হিসেবে প্রকল্পটি যে জনগণের জন্য আখেরে উপকারের চেয়ে অনেক বেশি অপকারী ও ক্ষতিকর ভূমিকা পালন করবে, তা উপলব্ধি করতে পেরেছেন। সে জন্যই তাঁর এই সরল স্বীকারোক্তি। তাঁকে আমার সশ্রদ্ধ অভিনন্দন। হাওরগুলোর বিপুল জলরাশির চলাচলের ক্ষেত্রে যে বর্ষা মৌসুমে এ মহাসড়কটি বড় ধরনের বাধা হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে, সেটা গত দুই-তিন বছরে এলাকার জনগণ হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। মহাসড়কটি পানির নিম্নগামী প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করায় প্রতি বর্ষাকালেই পুরো হাওরাঞ্চলের জনগণের অনেক ঘরবাড়িতে পানি ঢুকে পড়ছে এবং অস্বাভাবিক বন্যার কবলে পড়ছে অনেক এলাকা। শুষ্ক মৌসুমে জনগণের চলাচলে সড়কটি প্রভূত উপকার বয়ে আনলেও এই মহা অপকারটি জনগণকে মহা ভোগান্তির শিকার করবে বছরের পর বছর। অথচ এখন সড়কটি ভেঙে ফেলার বিষয়টিও আর সুবিবেচনাপ্রসূত মনে হবে না, সে জন্যই ‘পায়ে কুড়াল মারার’ কথাটি প্রযোজ্য হয়ে যাচ্ছে এ ক্ষেত্রে। এ বিষয়টি সামনে আসার কারণে ইতিমধ্যেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, হাওরাঞ্চলে আর কোনো সড়ক নির্মাণ করা হবে না, প্রয়োজনে উড়ালসড়ক নির্মাণের ব্যবস্থা করা হবে।
যেকোনো প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে সুচিন্তিতভাবে ‘ফিজিবিলিটি স্টাডি’ পরিচালনা এ জন্যই অত্যাবশ্যক। প্রকল্পের উপকার-অপকার কী কী হতে পারে, সেগুলো এহেন সম্ভাব্যতা-সমীক্ষাগুলোতে হাইলাইট করার কথা। সাধারণ জনগণের বিবেচনায় যে প্রকল্পকে খুবই প্রয়োজনীয় এবং উপকারী মনে হবে তা যে গভীরতর বিশ্লেষণে ক্ষতিকর হিসেবে ধরা দিতে পারে তারই বড়সড় দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছে হাওরের এই মহাসড়ক। পরিবেশকে জবরদস্তি করে পরিবর্তনের চেষ্টা করলে প্রকৃতি প্রতিশোধ নেয় বলে যে কঠিন সত্য কথাটি আমরা অনেক সময় উপলব্ধি করি না, তারই জের টানতে হবে হাওরাঞ্চলের জনগণকে আগামী দিনগুলোতে। পার্বত্য চট্টগ্রামের কাপ্তাইয়ে স্থাপিত জলবিদ্যুৎ প্রকল্পটিও এ রকম আরেকটি পরিবেশ-ধ্বংসকারী প্রকল্প, যেটাকে বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে নির্মাণের সময় তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের সবচেয়ে ‘প্রেস্টিজিয়াস প্রকল্প’ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। সে সময়ে প্রকৃতি ও পরিবেশ সম্পর্কে বিশ্বের জ্ঞানভান্ডার অতখানি সমৃদ্ধ ছিল না। তাই যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে তখনকার দিনে যথাযথ বিবেচিত ‘ফিজিবিলিটি স্টাডি’ করেই প্রকল্পটি গৃহীত হয়েছিল। আশির দশকে আমার গবেষণার প্রয়োজনে যখন ওই ‘ফিজিবিলিটি রিপোর্ট’ সংগ্রহ করে আমি পড়ার সুযোগ পাই, তখন কয়েক পৃষ্ঠার ওই রিপোর্টে পরিবেশের ক্ষতির বিষয়টি তেমন গুরুত্ব না পাওয়ায় আমি বিস্মিত হয়েছিলাম। আমি নিশ্চিত যে এখনকার সময়ে এ প্রকল্পটি গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হবে না কোনো ফিজিবিলিটি স্টাডি মোতাবেকই।
অথচ প্রায় ৬৫ বছর ধরে কাপ্তাই প্রকল্পের ক্ষতিকারক অভিঘাতগুলো মেনে নিতে হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং সারা দেশের জনগণকে। কারণ, এখন তো আর প্রতিকারের সুযোগ নেই! খামখেয়ালের বশবর্তী হয়ে মেগা প্রকল্প গ্রহণের বদ খাসলত কারও কারও থাকে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তেমন নন বলেই অনেকে মনে করেন। ক্ষতিকর মেগা প্রকল্প থেকে সংশ্লিষ্টদের বিরত রাখার জন্য আমাকে প্রায়ই কলম ধরতে হচ্ছে। নিচে স্বল্প প্রয়োজনীয় বা অপ্রয়োজনীয় কয়েকটি মেগা প্রকল্পের বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যতের নেতিবাচক অভিঘাত তুলে ধরছি।
প্রথমেই আসে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প প্রসঙ্গ। প্রায় ১ লাখ ১৩ হাজার ৯২ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে মাত্র ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের এই নির্মীয়মাণ প্ল্যান্ট প্রকল্প-মূল্যায়নের পদ্ধতি প্রয়োগ করে কখনোই গ্রহণযোগ্য প্রমাণ করা যাবে না। কারণ ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের অনেক বিকল্প প্রযুক্তি বিশ্বে পাওয়া যাবে, যেখানে এর অর্ধেকেরও কম ব্যয়ে নির্মিত প্রকল্পে ওই পরিমাণ বিদ্যুৎ অনেক বেশি নিরাপদে উৎপাদন করা যাবে। রাশিয়া থেকে এই প্রকল্পের জন্য ১২ বিলিয়ন ডলার ঋণ পাওয়া গেছে, অথচ ভারতের তামিলনাড়ুর কুদনকুলামে রাশিয়ার ৬ বিলিয়ন ডলার ঋণে ২ হাজার মেগাওয়াটের একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপিত হয়েছে। পারমাণবিক প্রকল্পের মতো একটা মহা বিপজ্জনক প্রযুক্তির প্ল্যান্ট বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশের সীমানার একেবারে মাঝখানে পাবনার রূপপুরে স্থাপিত হওয়া আদৌ কি গ্রহণযোগ্য? পারমাণবিক প্ল্যান্টের দুর্ঘটনা খুব বিরল নয়। প্রধানমন্ত্রীর জীবদ্দশায় বড় কোনো দুর্ঘটনা না-ও ঘটতে পারে, কিন্তু সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত বৈজ্ঞানিক সত্য হলো, একটু অসাবধান হলেই পারমাণবিক প্ল্যান্ট থেকে বিপজ্জনক বিকিরণ বেরিয়ে যেতে পারে, যা প্ল্যান্টের আশপাশের এলাকার জনগণের জন্য মারাত্মক জীবন-সংহারী স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করবে।
দ্বিতীয় যে প্রকল্পটি ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে সেটা হলো ঢাকায় নির্মীয়মাণ বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্প। ১২ বছর ধরে এ প্রকল্পটি চলমান, ইতিমধ্যেই প্রাক্কলিত ব্যয়ের প্রায় চার গুণ খরচ হয়ে গেছে এই প্রকল্পে। পাঁচজন লোকের প্রাণও গেছে এই প্রকল্পের নির্মাণ-দুর্ঘটনার শিকার হয়ে। এই প্রকল্পের জন্য ১২ বছর ধরে এয়ারপোর্ট রোড ব্যবহারকারী জনগণকে কী বিপুল ভোগান্তির শিকার হতে হয়েছে, সেটা ভুক্তভোগী কাউকে মনে করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। বলা হচ্ছে এ বছরের মধ্যেও প্রকল্পটি শেষ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। আরও দুঃখজনক হলো, এখন স্বীকার করা হচ্ছে যে প্রকল্পটি প্রকৃত বিচারে ঢাকার জনগণের চলাচলের ভোগান্তিকে তেমন প্রশমিত করতে পারবে না।
তৃতীয় যে কম প্রয়োজনীয় প্রকল্পের উল্লেখ করব সেটা হলো, ঢাকা-ফরিদপুর-যশোর রেললাইন। পদ্মা সেতু দিয়ে মহাসড়কের মাধ্যমে ঢাকার সঙ্গে দক্ষিণবঙ্গের সড়ক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এই রেললাইন অনেকখানি অপ্রয়োজনীয় হয়ে যাবে। অথচ প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে! চতুর্থ অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প হতে যাচ্ছে দ্বিতীয় বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ প্রকল্প।
পত্রপত্রিকায় প্রায়ই খবর প্রকাশিত হচ্ছে যে প্রথম বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের দুই-তৃতীয়াংশ ক্যাপাসিটি এখনো অব্যবহৃত রয়ে গেছে। আমরা নিজেরাও ব্যবহার করতে পারছি না, অন্য কোনো দেশের কাছে এই স্যাটেলাইটের উদ্বৃত্ত ক্যাপাসিটি বিক্রিও করতে পারছি না। অথচ এখন কৃষি খাতে ব্যবহারের অজুহাত দিয়ে দ্বিতীয় বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের তোড়জোড় চলেছে! পঞ্চম যে প্রকল্পটি স্বল্প প্রয়োজনীয় প্রমাণিত হবে সেটি হলো, চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত নির্মীয়মাণ রেলপথ, এটাও বেশ কয়েক বছর আন্ডার-ইউটিলাইজড থেকে যাবে।
এই পর্যায়ে যে প্রকল্প ক্যাটাগরির নজির তুলে ধরা প্রয়োজন সেটি হলো, যত্রতত্র সেতু ও সড়ক নির্মাণের সংস্কৃতি। বিপুলসংখ্যক সেতু দেশের বিভিন্ন স্থানে অসমাপ্ত ও অর্ধসমাপ্ত অবস্থায় এখনো ব্যবহার-অযোগ্য হয়ে পড়ে রয়েছে, অথচ স্থানীয় সংসদ সদস্য ও ক্ষমতাসীন দল বা জোটের জনপ্রতিনিধিদের প্রথম অগ্রাধিকার বিবেচিত হয়ে চলেছে তাঁদের নির্বাচনী এলাকার সেতু নির্মাণ ও সড়ক-উন্নয়ন। এমন অনেক সেতুর ছবি নিয়মিতভাবে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়, যেগুলোর সঙ্গে কোনো সংযোগ সড়কের ব্যবস্থাই গড়ে তোলা হয়নি নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার বছরের পর বছর পার করেও। আমরা অনেকেই জানি না যে বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশে প্রতি বর্গকিলোমিটারে সবচেয়ে বেশি দৈর্ঘ্যের অপরিকল্পিত সড়কপথ রয়েছে (বেশির ভাগই কাঁচা রাস্তা)। এভাবে যত্রতত্র সড়ক নির্মাণ করে আমরা বিভিন্ন নগরীর ও গ্রামীণ জনপদের পানিনিষ্কাশনব্যবস্থাকে ধ্বংস করে জলাবদ্ধতা সমস্যার সৃষ্টি করে চলেছি। উদাহরণ হিসেবে বলছি—ঢাকা ও চট্টগ্রামের মারাত্মক জলাবদ্ধতা সমস্যার জন্য এই দুটো মহানগরীর খালগুলোকে জবরদখল ও ভরাট করে ফেলাকেই প্রধানত দায়ী করা হয়ে থাকে। আমরা যারা চট্টগ্রাম নগরীতে কৈশোর থেকে বসবাস করছি, তাদের কাছে চট্টগ্রামের ড্রেনেজ সিস্টেমের এহেন দুরবস্থা খুবই হাস্যকর মনে হয়। এখন আবার হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নিয়ে এই জলাবদ্ধতা নিরসনের প্রয়াস চলেছে!
সম্প্রতি পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান মিডিয়ায় একটি সরল স্বীকারোক্তি করেছেন, ‘হাওরে পাকা সড়ক বানিয়ে নিজের পায়ে কুড়াল মেরেছি।’ তাঁর এই বক্তব্য দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। দেশের জনগণের মধ্যে একজন সৎ, সজ্জন, মেধাবী, সরল ও স্পষ্টভাষী ব্যক্তি হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জনকারী পরিকল্পনামন্ত্রী যখন বিবেকের দংশনে এহেন সরল স্বীকারোক্তি দিয়ে অপরাধবোধ থেকে নিষ্কৃতি পেতে চাইছেন, তখন ব্যাপারটিকে গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা-বিশ্লেষণে নিয়ে আসা প্রয়োজন মনে করছি। হাওরে নির্মিত ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রামের সংযোগকারী প্রায় ৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ দৃষ্টিনন্দন এ মহাসড়কটি ইতিমধ্যেই অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি পর্যটক-আকর্ষণ হিসেবে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। দেশের পত্র-পত্রিকা, ব্রডকাস্ট মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়ায় এ সড়কটি আকর্ষণের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে উদ্বোধনের পর থেকেই।
সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলের কৃতী সন্তান জনাব মান্নানের এই খবরগুলো সবই জানা আছে। হাওরাঞ্চলের আরেক কৃতী সন্তান সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ প্রধানত এ প্রকল্পটি গ্রহণ ও বাস্তবায়নের জন্য সরকারকে প্রভাবিত করেছেন। প্রথম দৃষ্টিতে এ মহাসড়কটিকে হাওরাঞ্চলে যোগাযোগব্যবস্থার যুগান্তকারী পরিবর্তন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক বিবেচনা করাই সংগত মনে হতে পারে। কিন্তু জনাব মান্নান এই অঞ্চলের সন্তান হিসেবে প্রকল্পটি যে জনগণের জন্য আখেরে উপকারের চেয়ে অনেক বেশি অপকারী ও ক্ষতিকর ভূমিকা পালন করবে, তা উপলব্ধি করতে পেরেছেন। সে জন্যই তাঁর এই সরল স্বীকারোক্তি। তাঁকে আমার সশ্রদ্ধ অভিনন্দন। হাওরগুলোর বিপুল জলরাশির চলাচলের ক্ষেত্রে যে বর্ষা মৌসুমে এ মহাসড়কটি বড় ধরনের বাধা হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে, সেটা গত দুই-তিন বছরে এলাকার জনগণ হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। মহাসড়কটি পানির নিম্নগামী প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করায় প্রতি বর্ষাকালেই পুরো হাওরাঞ্চলের জনগণের অনেক ঘরবাড়িতে পানি ঢুকে পড়ছে এবং অস্বাভাবিক বন্যার কবলে পড়ছে অনেক এলাকা। শুষ্ক মৌসুমে জনগণের চলাচলে সড়কটি প্রভূত উপকার বয়ে আনলেও এই মহা অপকারটি জনগণকে মহা ভোগান্তির শিকার করবে বছরের পর বছর। অথচ এখন সড়কটি ভেঙে ফেলার বিষয়টিও আর সুবিবেচনাপ্রসূত মনে হবে না, সে জন্যই ‘পায়ে কুড়াল মারার’ কথাটি প্রযোজ্য হয়ে যাচ্ছে এ ক্ষেত্রে। এ বিষয়টি সামনে আসার কারণে ইতিমধ্যেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, হাওরাঞ্চলে আর কোনো সড়ক নির্মাণ করা হবে না, প্রয়োজনে উড়ালসড়ক নির্মাণের ব্যবস্থা করা হবে।
যেকোনো প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে সুচিন্তিতভাবে ‘ফিজিবিলিটি স্টাডি’ পরিচালনা এ জন্যই অত্যাবশ্যক। প্রকল্পের উপকার-অপকার কী কী হতে পারে, সেগুলো এহেন সম্ভাব্যতা-সমীক্ষাগুলোতে হাইলাইট করার কথা। সাধারণ জনগণের বিবেচনায় যে প্রকল্পকে খুবই প্রয়োজনীয় এবং উপকারী মনে হবে তা যে গভীরতর বিশ্লেষণে ক্ষতিকর হিসেবে ধরা দিতে পারে তারই বড়সড় দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছে হাওরের এই মহাসড়ক। পরিবেশকে জবরদস্তি করে পরিবর্তনের চেষ্টা করলে প্রকৃতি প্রতিশোধ নেয় বলে যে কঠিন সত্য কথাটি আমরা অনেক সময় উপলব্ধি করি না, তারই জের টানতে হবে হাওরাঞ্চলের জনগণকে আগামী দিনগুলোতে। পার্বত্য চট্টগ্রামের কাপ্তাইয়ে স্থাপিত জলবিদ্যুৎ প্রকল্পটিও এ রকম আরেকটি পরিবেশ-ধ্বংসকারী প্রকল্প, যেটাকে বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে নির্মাণের সময় তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের সবচেয়ে ‘প্রেস্টিজিয়াস প্রকল্প’ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। সে সময়ে প্রকৃতি ও পরিবেশ সম্পর্কে বিশ্বের জ্ঞানভান্ডার অতখানি সমৃদ্ধ ছিল না। তাই যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে তখনকার দিনে যথাযথ বিবেচিত ‘ফিজিবিলিটি স্টাডি’ করেই প্রকল্পটি গৃহীত হয়েছিল। আশির দশকে আমার গবেষণার প্রয়োজনে যখন ওই ‘ফিজিবিলিটি রিপোর্ট’ সংগ্রহ করে আমি পড়ার সুযোগ পাই, তখন কয়েক পৃষ্ঠার ওই রিপোর্টে পরিবেশের ক্ষতির বিষয়টি তেমন গুরুত্ব না পাওয়ায় আমি বিস্মিত হয়েছিলাম। আমি নিশ্চিত যে এখনকার সময়ে এ প্রকল্পটি গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হবে না কোনো ফিজিবিলিটি স্টাডি মোতাবেকই।
অথচ প্রায় ৬৫ বছর ধরে কাপ্তাই প্রকল্পের ক্ষতিকারক অভিঘাতগুলো মেনে নিতে হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং সারা দেশের জনগণকে। কারণ, এখন তো আর প্রতিকারের সুযোগ নেই! খামখেয়ালের বশবর্তী হয়ে মেগা প্রকল্প গ্রহণের বদ খাসলত কারও কারও থাকে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তেমন নন বলেই অনেকে মনে করেন। ক্ষতিকর মেগা প্রকল্প থেকে সংশ্লিষ্টদের বিরত রাখার জন্য আমাকে প্রায়ই কলম ধরতে হচ্ছে। নিচে স্বল্প প্রয়োজনীয় বা অপ্রয়োজনীয় কয়েকটি মেগা প্রকল্পের বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যতের নেতিবাচক অভিঘাত তুলে ধরছি।
প্রথমেই আসে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প প্রসঙ্গ। প্রায় ১ লাখ ১৩ হাজার ৯২ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে মাত্র ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের এই নির্মীয়মাণ প্ল্যান্ট প্রকল্প-মূল্যায়নের পদ্ধতি প্রয়োগ করে কখনোই গ্রহণযোগ্য প্রমাণ করা যাবে না। কারণ ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের অনেক বিকল্প প্রযুক্তি বিশ্বে পাওয়া যাবে, যেখানে এর অর্ধেকেরও কম ব্যয়ে নির্মিত প্রকল্পে ওই পরিমাণ বিদ্যুৎ অনেক বেশি নিরাপদে উৎপাদন করা যাবে। রাশিয়া থেকে এই প্রকল্পের জন্য ১২ বিলিয়ন ডলার ঋণ পাওয়া গেছে, অথচ ভারতের তামিলনাড়ুর কুদনকুলামে রাশিয়ার ৬ বিলিয়ন ডলার ঋণে ২ হাজার মেগাওয়াটের একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপিত হয়েছে। পারমাণবিক প্রকল্পের মতো একটা মহা বিপজ্জনক প্রযুক্তির প্ল্যান্ট বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশের সীমানার একেবারে মাঝখানে পাবনার রূপপুরে স্থাপিত হওয়া আদৌ কি গ্রহণযোগ্য? পারমাণবিক প্ল্যান্টের দুর্ঘটনা খুব বিরল নয়। প্রধানমন্ত্রীর জীবদ্দশায় বড় কোনো দুর্ঘটনা না-ও ঘটতে পারে, কিন্তু সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত বৈজ্ঞানিক সত্য হলো, একটু অসাবধান হলেই পারমাণবিক প্ল্যান্ট থেকে বিপজ্জনক বিকিরণ বেরিয়ে যেতে পারে, যা প্ল্যান্টের আশপাশের এলাকার জনগণের জন্য মারাত্মক জীবন-সংহারী স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করবে।
দ্বিতীয় যে প্রকল্পটি ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে সেটা হলো ঢাকায় নির্মীয়মাণ বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্প। ১২ বছর ধরে এ প্রকল্পটি চলমান, ইতিমধ্যেই প্রাক্কলিত ব্যয়ের প্রায় চার গুণ খরচ হয়ে গেছে এই প্রকল্পে। পাঁচজন লোকের প্রাণও গেছে এই প্রকল্পের নির্মাণ-দুর্ঘটনার শিকার হয়ে। এই প্রকল্পের জন্য ১২ বছর ধরে এয়ারপোর্ট রোড ব্যবহারকারী জনগণকে কী বিপুল ভোগান্তির শিকার হতে হয়েছে, সেটা ভুক্তভোগী কাউকে মনে করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। বলা হচ্ছে এ বছরের মধ্যেও প্রকল্পটি শেষ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। আরও দুঃখজনক হলো, এখন স্বীকার করা হচ্ছে যে প্রকল্পটি প্রকৃত বিচারে ঢাকার জনগণের চলাচলের ভোগান্তিকে তেমন প্রশমিত করতে পারবে না।
তৃতীয় যে কম প্রয়োজনীয় প্রকল্পের উল্লেখ করব সেটা হলো, ঢাকা-ফরিদপুর-যশোর রেললাইন। পদ্মা সেতু দিয়ে মহাসড়কের মাধ্যমে ঢাকার সঙ্গে দক্ষিণবঙ্গের সড়ক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এই রেললাইন অনেকখানি অপ্রয়োজনীয় হয়ে যাবে। অথচ প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে! চতুর্থ অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প হতে যাচ্ছে দ্বিতীয় বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ প্রকল্প।
পত্রপত্রিকায় প্রায়ই খবর প্রকাশিত হচ্ছে যে প্রথম বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের দুই-তৃতীয়াংশ ক্যাপাসিটি এখনো অব্যবহৃত রয়ে গেছে। আমরা নিজেরাও ব্যবহার করতে পারছি না, অন্য কোনো দেশের কাছে এই স্যাটেলাইটের উদ্বৃত্ত ক্যাপাসিটি বিক্রিও করতে পারছি না। অথচ এখন কৃষি খাতে ব্যবহারের অজুহাত দিয়ে দ্বিতীয় বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের তোড়জোড় চলেছে! পঞ্চম যে প্রকল্পটি স্বল্প প্রয়োজনীয় প্রমাণিত হবে সেটি হলো, চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত নির্মীয়মাণ রেলপথ, এটাও বেশ কয়েক বছর আন্ডার-ইউটিলাইজড থেকে যাবে।
এই পর্যায়ে যে প্রকল্প ক্যাটাগরির নজির তুলে ধরা প্রয়োজন সেটি হলো, যত্রতত্র সেতু ও সড়ক নির্মাণের সংস্কৃতি। বিপুলসংখ্যক সেতু দেশের বিভিন্ন স্থানে অসমাপ্ত ও অর্ধসমাপ্ত অবস্থায় এখনো ব্যবহার-অযোগ্য হয়ে পড়ে রয়েছে, অথচ স্থানীয় সংসদ সদস্য ও ক্ষমতাসীন দল বা জোটের জনপ্রতিনিধিদের প্রথম অগ্রাধিকার বিবেচিত হয়ে চলেছে তাঁদের নির্বাচনী এলাকার সেতু নির্মাণ ও সড়ক-উন্নয়ন। এমন অনেক সেতুর ছবি নিয়মিতভাবে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়, যেগুলোর সঙ্গে কোনো সংযোগ সড়কের ব্যবস্থাই গড়ে তোলা হয়নি নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার বছরের পর বছর পার করেও। আমরা অনেকেই জানি না যে বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশে প্রতি বর্গকিলোমিটারে সবচেয়ে বেশি দৈর্ঘ্যের অপরিকল্পিত সড়কপথ রয়েছে (বেশির ভাগই কাঁচা রাস্তা)। এভাবে যত্রতত্র সড়ক নির্মাণ করে আমরা বিভিন্ন নগরীর ও গ্রামীণ জনপদের পানিনিষ্কাশনব্যবস্থাকে ধ্বংস করে জলাবদ্ধতা সমস্যার সৃষ্টি করে চলেছি। উদাহরণ হিসেবে বলছি—ঢাকা ও চট্টগ্রামের মারাত্মক জলাবদ্ধতা সমস্যার জন্য এই দুটো মহানগরীর খালগুলোকে জবরদখল ও ভরাট করে ফেলাকেই প্রধানত দায়ী করা হয়ে থাকে। আমরা যারা চট্টগ্রাম নগরীতে কৈশোর থেকে বসবাস করছি, তাদের কাছে চট্টগ্রামের ড্রেনেজ সিস্টেমের এহেন দুরবস্থা খুবই হাস্যকর মনে হয়। এখন আবার হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নিয়ে এই জলাবদ্ধতা নিরসনের প্রয়াস চলেছে!
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৪ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৪ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৪ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৪ দিন আগে