‘হামাগিরে দুক্কু কি কেউ দেকপিনে’

আজকের পত্রিকা ডেস্ক
প্রকাশ : ২২ জুন ২০২২, ০৮: ২০
আপডেট : ২২ জুন ২০২২, ১৬: ০২

সহিতন বেগম (৩২)। দেখা হয় বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার চালুয়াবাড়ী ইউনিয়নের খাটেবাড়ি চরে। ছয় মাসের ফাতেমাকে বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন এককোমর পানিতে। তিনি যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন তার চারদিকে যমুনার পানির স্রোত।

তাঁর স্বামী ইউসুফ আলী জ্বালানি মাথার ওপর নিয়ে শুকানোর চেষ্টা করছেন। সহিতন বলেন, ‘পাঁচ দিন ধরেই হামার বাড়িতে পানি উঠছে। হামার থাকার ঘরে পানি এক কোমরের ওপরে। টিউবওয়েল আগেই ডুবে গেছে। ল্যাট্রিনে এখন একবুক পানি। চৌকিডা দড়ি দিয়ে বাঁশের সাতে বান্দন দিয়ে উচে করে রাখছি। সেটি আত্তিরে ফাতেমাকে নিয়ে থাকি। মুনে হয় দুলনাত আচি। কখন যে ছোলডা পানিত পরে মরে যাবি, ভয় হয়। কয়দিন ধরে ঘুমাতে পারি না। ফসলাদি যা করছিলেম তা তো আগেই ডুবে গেছে। একন হামরা কুন্টি যামু, কী খামু, হামার গরু কী খাবি। হামাগিরে দুক্কু কি কেউ দেকপের লায়।’

শুধু সহিতনই না। উপজেলার ৭৭টি গামের ১৪ হাজার ১৮০ পরিবারের ৫৬ হাজার ৭২০ জন এখন বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত।

এদিকে উজানের পাহাড়ি ঢলে সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীর পানি দ্রুতগতিতে বেড়েই চলছে। জেলার কাজীপুর ও শহররক্ষা বাঁধ হার্ড পয়েন্ট এলাকায় যমুনার পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে অভ্যন্তরীণ করতোয়া, ফুলজোড়, বড়াল, হুড়াসাগর, ইছামতী নদীসহ চলনবিলে পানি বৃদ্ধির ফলে চরাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হচ্ছে।

গত ২৪ ঘণ্টায় (গত সোমবার দুপুর ১২টা থেকে গতকাল মঙ্গলবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত) যমুনা নদীর পানি ১২ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ৫০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। এ ছাড়া কাজীপুর মেঘাই ঘাট পয়েন্টে যমুনার পানি ৬ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ৫৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।

জেলা ত্রাণ কর্মকর্তা আকতারুজ্জামান জানান, বন্যার্তদের জন্য ইতিমধ্যে ৯১১ মেট্রিক টন চাল, নগদ ২০ লাখ টাকা এবং ৪ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বরাদ্দ পাওয়া গেছে। এগুলো বিতরণের জন্য স্ব-স্ব এলাকার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের কাছ ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা চাওয়া হয়েছে। তালিকা অনুযায়ী বিতরণ করা হবে।

এদিকে, সারিয়াকান্দিতে দায়িত্বে থাকা গেজ রিডার পরশুরাম জানান, গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত যমুনা নদীতে পানির উচ্চতা ছিল ১৭ দশমিক ৩৪ সেন্টিমিটার; যা বিপৎসীমার ৬৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। অপরদিকে বাঙ্গালী নদীতে পানির উচ্চতা ছিল ১৫ দশমিক ৮৯ সেন্টিমিটার; যা বিপৎসীমার ৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।

এ উপজেলার ৭৭টি গ্রাম বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। বন্যায় ১০ হাজার ২৫০টি নলকূপ পানিতে ডুবে গেছে। ১১ হাজার গবাদিপশু পানিবন্দী হয়েছে। পশুখাদ্য তলিয়ে গেছে। পানিতে আংশিকভাবে নিমজ্জিত হয়েছে ৫৫০টি বাড়িঘর। ডুবে গেছে উপজেলার ৬৮টি কাঁচা রাস্তা, ৩টি পাকা রাস্তা এবং ৯টি ব্রিজ। ৩১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আংশিক ডুবে গেছে। এ ছাড়া ২ হাজার ৪৬৯ হেক্টর কৃষিজমির ফসল এখন পানিতে ডুবে গেছে।

আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, এখানে আগে থেকে বাস করত ১২০টি পরিবার। গত কয়েক দিনে এখানে আশ্রয় নিয়েছে ১০০ পরিবার। এখানে নলকূপ রয়েছে ২০টি। ল্যাট্রিন পুরোনো পরিবারের জন্য একটি করে। এ কারণে আশ্রয় নেওয়া নতুন পরিবার পানি, খাবার এবং পয়োনিষ্কাশনজনিত সমস্যায় ভুগছে।

উপজেলার কুতুবপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম সুজন বলেন, ‘আমার ইউনিয়নের তিনটি ওয়ার্ড বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ভেতর অবস্থিত। ফলে তাদের সবারই বাড়িঘর পানিতে ডুবে গেছে।’

ইউএনও মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, অসময়ের বন্যায় উপজেলার বাঙ্গালী এবং যমুনা নদী-সংলগ্ন চরাঞ্চলগুলোর কৃষকেরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তাঁদের সরকারি সহযোগিতা দিতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো হবে।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত