Ajker Patrika

গ্রামের কুটিরেই গবেষণা, উদ্ভাবন ২৩ ধরনের ধান

অভিজিৎ সাহা, নালিতাবাড়ী (শেরপুর)
গ্রামের কুটিরেই গবেষণা, উদ্ভাবন ২৩ ধরনের ধান

শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার সীমান্তবর্তী চাটকিয়া গ্রামের কৃষক সেন্টু কুমার হাজং। জীর্ণ কুটিরে বসেই করেন ধান নিয়ে গবেষণা। ১৭ বছর নিরলস পরিশ্রম করে সংকরায়ণের মাধ্যমে ২৩ ধরনের ধান উদ্ভাবন করেছেন বলে দাবি এই কৃষকের। তাঁর উদ্ভাবিত ধান স্থানীয় কৃষকেরা আবাদ করছেন। তাঁরা ধানের ফলনও পাচ্ছেন সাধারণ ধানের প্রায় দ্বিগুণ।

সেন্টু কুমারের বাড়ির চারপাশে গাছগাছালি। আঙিনায় খড়ের ছাউনির ছোট্ট একটি কুটির। ভেতরে এক পাশে ২৫-৩০টি প্লাস্টিকের টব, অন্য পাশে হরেক রকম ধানবীজের বস্তা। মেঝেতে প্লাস্টিকের বড় একটি ড্রামে রাখা হয়েছে ১৭ বছরের সঞ্চিত ২৭০ ধরনের ধানের গুচ্ছ (স্যাম্পল)। কাগজে লেখা ধানের জাত, উচ্চতা, সময় ও ধরন।

বাড়ির আঙিনায় ছোট্ট গবেষণাগারটিতে দেশি জাতের ধানের সঙ্গে অন্য একটি দেশি জাতের সংকরায়ণ ও পরাগায়ন করেন সেন্টু। এভাবে নতুন নতুন ধানের সন্ধান দিচ্ছেন তিনি। সরকারিভাবে তাঁর ধানগুলো নিয়ে মাঠপর্যায়ে কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়নি। কোনো স্বীকৃতিও পাননি। তবে নালিতাবাড়ীসহ আশপাশের বিভিন্ন উপজেলায় কয়েক হাজার একর জমিতে কৃষকেরা তাঁর ধান চাষ করে লাভবান হচ্ছেন।

সেন্টু হাজংয়ের (৫১) বাড়ি নন্নী ইউনিয়নের কতুবাকুড়া গ্রামে। অভাবের কারণে মাধ্যমিক পাসের পর আর লেখাপড়া করতে পারেননি। পরে অবলা হাজংকে বিয়ে করে শ্বশুরবাড়ি চাটকিয়া গ্রামে চলে আসেন। ২০০৫ সালে বেসরকারি একটি সংস্থা দরিদ্র কৃষকদের ধানের সংকরায়ণ ও নতুন জাতের ধান উদ্ভাবনের প্রযুক্তি শিখিয়েছিল। সেখানে তিন দিনের প্রশিক্ষণ কর্মশালায় যোগ দিয়েছিলেন সেন্টু। সেই প্রশিক্ষণই সম্বল। তা নিয়েই ধানের নতুন নতুন ধরন বের করা তাঁর ধ্যানজ্ঞান হয়ে দাঁড়ায়।

সেন্টু হাজং ধান সংকরায়ণ করে টবে সেই ধানের বীজ রোপণ করেন। গাছ হলে সেখান থেকে বীজ সংরক্ষণ করেন। আমন মৌসুমে সেই বীজ ৬৫ শতক জমিতে ছোট ছোট আকারে খেত (প্লট) তৈরি করে চাষাবাদ করেন। এভাবে নতুন ধরনের ধান বের করে আনেন তিনি।

২০১৬ সালে ধানের একটি ধরন আনেন সেন্টু। সাত বছরের চেষ্টায় বিআর-১১-এর সঙ্গে চিনিশাইল ধানের সংকরায়ণ করে তিনি নতুন ওই ধরন উদ্ভাবন করেন। ওই ধানের ফলন হয় প্রতি একরে ৪৫ থেকে ৫৫ মণ (যেখানে ধান হয় ৩০-৩৫ মণ)। গাছের উচ্চতা হয় সাড়ে তিন থেকে চার ফুট। গাছ শক্ত থাকায় সহজে বাতাসে হেলে পড়ে না। ধানটির সময়কাল ১৪০ দিন। এই ধান চাষে তেমন কোনো পরিচর্যা লাগে না। পোকামাকড়ের আক্রমণও কম হয়। এ বছর শুধু এই উপজেলায় সাড়ে ছয় হাজার একর জমিতে সেন্টুর এই ধান চাষ হয়েছে বলে উপজেলা কৃষি কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে।

২০১৯ সালে ধানের আরেকটি নতুন ধরন নিয়ে আসেন সেন্টু। পাঁচ বছরের চেষ্টায় দেশি পাইজাম ধানের সঙ্গে রঞ্জিত ধানের সংকরায়ণ করে তিনি নতুন এই ধরন উদ্ভাবন করেন। এই ধানের চাল অনেকটা পাইজামের মতো চিকন হয়। ফলনও পাওয়া যায় দ্বিগুণ। পাইজাম প্রতি একরে ৩৫ থেকে ৪০ মণ, আর সেন্টুর ধান প্রতি একরে ফলন হয় ৬০ থেকে ৭০ মণ। উৎপাদনে সময় লাগে ১৫০ দিন, আর পাইজামের সময়কাল ১৬০ দিন। সেন্টুর ধান চাষে তেমন কোনো পরিচর্যা লাগে না। পোকামাকড়ের আক্রমণও কম হয়।

সম্প্রতি সেন্টু হাজংয়ের বাড়ি গিয়ে এসব কথা জানা যায়। তিনি আজকের পত্রিকাকে আরও বলেন, ধান নিয়ে পড়ে থাকায় প্রথম প্রথম লোকজন এটাকে পাগলামি মনে করতেন। তবে এখন স্থানীয় কৃষকেরা বেজায় খুশি। কৃষক তাঁর ধান চাষ করে যখন লাভবান হন, তখন সেন্টুর ভালো লাগে।

উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন বলেন, ব্যক্তি উদ্যোগে সেন্টু হাজং ধান নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। তা ছাড়া স্থানীয় জাতের ধানকে আরও উন্নত ও সমৃদ্ধ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। তাঁর ধান চাষে স্থানীয় কৃষকেরা লাভবানও হচ্ছেন।

সেন্টু হাজংয়ের কাজের খোঁজ রাখেন, এমনকি তাঁর বাড়িতেও গিয়েছিলেন বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘সেন্টু হাজং হাতের মাধ্যমে ধান পরাগায়ন ও নির্বাচন করে থাকেন। তাঁর ধানের ফলন যদি ভালো হয়, তাহলে ধানের দানা, গাছের ধরন, ফলন, স্বাদ কেমন হয়, সেটা আগে দেখতে হবে। আমরা যেহেতু ধানের গবেষণা করি, সেন্টু হাজংয়ের ধানও আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখব। স্থানীয় পর্যায়ের কৃষকদের উদ্ভাবিত ধান আমাদের মূল্যায়ন করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।’

এদিকে ধানের নতুন কোনো জাতের স্বীকৃতি পেতে হলে কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয় উল্লেখ করে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক শাহজাহান কবির বলেন, ‘একজন কৃষক জাত উদ্ভাবন করতে পারেন। বিভিন্ন স্থানে পরীক্ষামূলক চাষ (ট্রায়াল) দেওয়ার পর এর জাত বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সিতে দিতে হবে। তারা এই জাত দেশের ১০টি অঞ্চলে পরীক্ষামূলক চাষ করে দেখবে। এর ফলাফলের ভিত্তিতে আমাদের প্রচলিত জাতের চেয়ে ভালো কি না, তা যাচাই করা হবে। সেখানে ভালো হলে পরে ন্যাশনাল টেকনিক্যাল কমিটিতে পাঠানো হবে। সেখানে পর্যালোচনা শেষে জাতীয় বীজ বোর্ডে পাঠানোর পর তা অনুমোদিত হলে ধানের নামসহ সরকারি গেজেটে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সেন্টু হাজংয়ের কথা শুনেছি। তিনি চাইলে তাঁর ধান নিয়ে আবেদন করতে পারেন।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত