জানুয়ারির আগে ভোলার ৫ গ্যাসকূপ খননের কাজ পাচ্ছে রুশ কোম্পানি

সাজ্জাদ হোসেন, ঢাকা
প্রকাশ : ২৪ নভেম্বর ২০২৩, ১১: ০৫
আপডেট : ২৪ নভেম্বর ২০২৩, ১১: ০৮

জাতীয় গ্রিডে গ্যাস সরবরাহ করার জন্য সঞ্চালন লাইন নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাই এখনো শেষ হয়নি। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ দ্রুত শেষ করা হলেও ২০২৬ সালের আগে সঞ্চালন লাইন হচ্ছে না। কিন্তু জাতীয় গ্রিডে গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর আশায় ভোলা গ্যাসক্ষেত্রে পাঁচটি কূপ খননের কাজ দেওয়া হচ্ছে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি গ্যাজপ্রমকে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি লিমিটেডের (বাপেক্স) আবিষ্কার করা এই গ্যাসক্ষেত্রে বিনা দরপত্রে গ্যাজপ্রমকে কূপ খননের কাজ দেওয়া হচ্ছে।

জানুয়ারির আগেই কাজটি দেওয়া হতে পারে। বাপেক্সের উচ্চপর্যায়ের সূত্রে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে।

সূত্রমতে, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইনের আওতায় এই কাজ দেওয়া হচ্ছে। প্রক্রিয়া দ্রুত এগিয়ে নিতে গ্যাজপ্রম সপ্তাহ দুয়েক আগেই কারিগরি প্রস্তাব বাপেক্সের কাছে জমা দিয়েছে।

বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) মো. শোয়েব জানান, গ্যাজপ্রমকে কূপ খননের কাজ দেওয়ার ব্যাপারে সরকারের উচ্চপর্যায়ের সবুজসংকেত পাওয়া গেছে। কবে নাগাদ কার্যাদেশ দেওয়া হবে জানতে চাইলে তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘কূপ খননের ব্যাপারে আমরা (বাপেক্স) গ্যাজপ্রমের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি অনেক আগে থেকেই।

নির্বাচন এখনো অনেক দেরি। খননকাজের কার্যাদেশ আমরা নির্বাচনের আগেই দিয়ে দেব।’ ভোলায় পাঁচটি কূপ খননের এই কাজ দেওয়া হচ্ছে ২০২৪ সালের মধ্যে ৪৬টি গ্যাস অনুসন্ধান কূপ খনন ও পুনঃখনন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে। তার মধ্যে বাপেক্স ২০টি, বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেড ১২টি এবং সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেড ১৪টি কূপ খনন করবে।

জানা যায়, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্স ভোলায় এ পর্যন্ত তিনটি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করেছে। এই তিনটি গ্যাসক্ষেত্র হলো শাহবাজপুর, ভোলা নর্থ ও ইলিশা। গ্যাজপ্রমকে দেওয়া হবে মূলত শাহবাজপুর-৫, শাহবাজপুর-৭, শাহবাজপুর নর্থ ইস্ট-১ এবং ভোলা নর্থ-৩ ও ভোলা নর্থ-৪ নম্বর কূপ।

ভোলার গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করার পাইপলাইন নেই 
ভোলায় প্রায় ২ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া গেলেও ব্যবহার করা যাচ্ছে না পুরো সক্ষমতা। বর্তমানে ভোলার দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ করা হলেও তা প্রমাণিত মজুত গ্যাসের তুলনায় নগণ্য। ভোলার গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করার জন্য নির্মাণ করা হয়নি কোনো সঞ্চালন লাইন। এই অবস্থায় কূপ খনন করা হলেও জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হচ্ছে না ২০২৬ সালের জুনের আগে।  

পাইপলাইন নির্মাণের সঙ্গে জড়িত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেডের (জিটিসিএল) মহাব্যবস্থাপক (পরিকল্পনা ডিভিশন) আবু সাঈদ মাহমুদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘শাহবাজপুর ও ভোলা নর্থ গ্যাসফিল্ডের গ্যাস বরিশাল গ্রিডের সঙ্গে যুক্ত করার জন্য পাইপলাইন নির্মাণকাজের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ চলছে। আগামী দুই মাসের মধ্যে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শেষ করা যাবে। তারপর আমরা ডিপিপি প্রস্তুত করে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠাব অনুমোদনের জন্য।’

জিটিসিএলের ওয়েবসাইটে উল্লেখ আছে, ১ হাজার ১৬৬ কোটি টাকার সম্ভাব্য ব্যয়ে শাহবাজপুর ও ভোলা নর্থ গ্যাসফিল্ড থেকে লাহারহাট হয়ে বরিশাল একটি পাইপলাইন নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০২৩ সালের জুলাই থেকে ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত। 
বাপেক্সের একাধিক কর্মকর্তা জানান, কূপ খননের কাজ শেষ হওয়ার পরও প্রায় দেড় বছরের বেশি সময় অপেক্ষা করতে হবে বরিশালে থাকা গ্যাসের জাতীয় গ্রিডে সঙ্গে এই কূপগুলো থেকে গ্যাস সরবরাহ করার জন্য।

গ্যাজপ্রমকে খননকাজ দেওয়ার যুক্তি
গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার, উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের পরিমাণ নির্ধারণ, কূপ খনন ও গ্যাস উত্তোলন—এই চার ধাপের মধ্যে সবচেয়ে জটিল ও ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া হচ্ছে গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার ও উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের পরিমাণ নির্ধারণ করা। যে তিনটি গ্যাসক্ষেত্রে গ্যাজপ্রমকে খননকাজ দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে, সেগুলো আবিষ্কার ও গ্যাসের নিশ্চিত মজুত নির্ধারণ করেছে বাপেক্স। শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্রে প্রায় ১ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ), ভোলা নর্থ ও শাহবাজপুর ইস্ট গ্যাসক্ষেত্রেও ১ দশমিক ৫ টিসিএফের বেশি গ্যাস মজুত আছে। 
ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গত বছরের মে মাসের দিকে দাম বাড়তে থাকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি)। ফলে ডলার-সংকটে সরকার প্রায় আট মাস আমদানি বন্ধ রাখে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমতে থাকায় সরকারকে গ্যাস বিল পরিশোধেও গড়িমসি করতে হচ্ছে। এ অবস্থায় ২০২২ সালের মাঝামাঝি পরিকল্পনা করা হয় ২০২৪ সালের মধ্যে ৪৬টি গ্যাস অনুসন্ধান কূপ খনন ও পুনঃখননের।

বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) এবং বাপেক্সের যুক্তি, ডলার-সংকটের কারণে সরকারের পক্ষে বেশি দামে এলএনজি আমদানি করা এখন কঠিন। এ অবস্থায় সরকারি প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা দিয়ে কাজ করলে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা যাবে না। সে জন্য বিদেশি কোম্পানির সাহায্য নেওয়ার বিকল্প নেই বলে মনে করেন নীতিনির্ধারকেরা।  

পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্রনাথ সরকার আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘সরকার এখন নিজস্ব উৎস থেকে দ্রুত গ্যাস উত্তোলন করতে চায়। বাপেক্সের যে সক্ষমতা আছে, তাতে বছরে দুটি কূপ খনন করা যাবে। আরেকটা রিগ কেনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আশা করি, আগামী ছয় মাসের মধ্যে আমরা একটা রিগ কিনতে পারব।’ তিনি আরও বলেন, ‘বাপেক্সের যে পাঁচটা রিগ আছে, সেগুলোকে শতভাগ কাজে লাগিয়ে আমরা ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত সর্বোচ্চ ২২টা কূপ খনন করতে পারব। এই জন্য আমাদের বিদেশি কোম্পানি দিয়ে কূপ খনন করতে হবে।’

অন্যদিকে বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) বলেন, ভোলায় গ্যাজপ্রম আগেও তিনটা কূপ খনন করেছে, এ জন্য তাদের আরও পাঁচটা কূপ দেওয়া হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, একসঙ্গে অনেক কূপ খনন করার সক্ষমতা বাপেক্সের নেই।  

বেশি দামে দিতে হবে কাজ
বাপেক্সের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, নিজস্ব লোকবল দিয়ে একটি কূপ খনন করতে সর্বোচ্চ খরচ হয় ৮০ কোটি টাকা। অন্যদিকে গ্যাজপ্রমকে দিয়ে কূপ খনন করতে গিয়ে খরচ হয় ১৮০ কোটি টাকার মতো। ২০২০ সালে তিনটি কূপ খননের জন্য গ্যাজপ্রমকে দিতে হয়েছে ৫৪০ কোটি টাকা।

এ বিষয়ে মো. শোয়েব বলেন, ‘গ্যাজপ্রমকে দিয়ে কূপ খনন করতে আমাদের টাকা বেশি হবে তবে তা গ্যাস আমদানির খরচের তুলনায় কম।’

বিনা দরপত্রে ও বাপেক্সের আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্রে গ্যাজপ্রমকে কূপ খননের কাজ দেওয়ার সিদ্ধান্তকে জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বদরূল ইমাম। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘কূপ খনন করার জন্য যে পরিমাণ টাকা দরকার তা বিনিয়োগ করা সরকারের উচিত ছিল। এখন যন্ত্রপাতি না থাকার অজুহাতে বাপেক্সের আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্রে বিদেশি কোম্পানিকে কূপ খননের কাজ দেওয়া অপরাধ।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত