স্ত্রী সোলতানা পারভীন। ছেলে ফটোসাংবাদিক আজিম অনন ও আবি আল আধিকে নিয়ে সাজানো সংসার ছিল চট্টগ্রামের বিএনপির নেতা ও ফটিকছড়ির লেলাং ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান এ এস এম শহিদুল আলম সিরাজের। ছোট ছেলে আধির বয়স তখন মাত্র দেড় বছর। বেশ ভালোই চলছিল পরিবার। কিন্তু ২০১২ সালের ৬ মার্চ এই পরিবারে নেমে আসে এক দুর্যোগ। সেদিন বিএনপির ‘ঢাকা চলো’ কর্মসূচিতে যোগ দিয়ে চট্টগ্রামে ফেরার পথে নিখোঁজ হন শহিদুল। তারপর ১২ বছর পেরিয়ে গেছে। আজও তাঁর পথ চেয়ে আছে পরিবার।

চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও করলডাঙ্গা ইউপির তৎকালীন চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম বাচাকে ২০১০ সালের ৮ নভেম্বর গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে সাদাপোশাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়। আজ পর্যন্ত তাঁর খোঁজ পায়নি পরিবার। এর আগে একই বছরের ২৭ মার্চ চট্টগ্রাম নগরীর খুলশী এলাকার ভূঁইয়া গলি থেকে তুলে নেওয়া হয় রাউজানের বাগোয়ান ইউপির তৎকালীন চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ আবু জাফরকে। এরপর ১৪ বছর পেরিয়ে গেছে। আজও তাঁর ফেরার অপেক্ষায় রয়েছে পরিবার।

ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মুখে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর কথিত ‘আয়নাঘর’ থেকে মুক্তি পান গত ১৫ বছরের বিভিন্ন সময়ে গুম হওয়া কয়েকজন। এতে আশাবাদী হয়ে ওঠেন এই তিন চেয়ারম্যানের স্বজনেরাও; কিন্তু সে আশা ভঙ্গ হতেও সময় লাগেনি।

ফটিকছড়ির লেলাং ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান শহিদুল আলম উপজেলা বিএনপির কার্যকরী সদস্য ছিলেন। তিনি যখন নিখোঁজ হন, তখন তাঁর বড় ছেলে আজিম অননের বয়স ১৩ বছর। এখন তিনি ফটোসাংবাদিক। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘মনে হয়, এই বুঝি আমার বাবাও আয়নাঘর থেকে বেরিয়ে আসবেন। ২০১২ সালের ১ মার্চ বিএনপির সমাবেশে ঢাকার উদ্দেশে বের হন আমার বাবা।

৬ মার্চ ঢাকা থেকে মোবাইল ফোনে মায়ের সঙ্গে শেষবার যোগাযোগ হয় তাঁর। এরপর থেকে আর কোনো খোঁজ মেলেনি। এ ঘটনায় আমার মা চট্টগ্রাম নগরীর খুলশী ও পাঁচলাইশ মডেল থানায় পৃথক জিডি করেছিলেন। কিন্তু সেই জিডিও পুলিশের আয়নাঘরে। এখনো বাবার পথ চেয়ে বসে থাকে ছোট ভাই আধি। সে তো বাবাকে সেভাবে দেখেইনি।’

এদিকে করলডাঙ্গা ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম বাচা যখন নিখোঁজ হন, তখন তাঁর ছোট ছেলে মিনহাজুল ইসলামের বয়স ৯ বছর। তিনি এখন কানাডায় পড়াশোনা করছেন। আর তাঁর বড় ভাই আনিসুল ইসলাম আছেন দুবাইয়ে। মিনহাজুল আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বাবা যখন নিখোঁজ হন, তখন তাঁকে ভালোভাবে বোঝার বয়সও হয়নি আমার। এর মধ্যেই বাবাকে হারিয়ে ফেললাম। কেন আমার বাবাকে গুম করা হলো জানি না। রাজনীতি করলেই কী মানুষকে গুম করে ফেলতে হবে?’

করলডাঙ্গা ইউপির বর্তমান চেয়ারম্যান নিখোঁজ এই চেয়ারম্যানেরই ছোট ভাই বোয়ালখালী উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মো. হামিদুল হক মান্নান। বড় ভাই নিখোঁজ হওয়ার পরের বছরই এই ইউপিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিজয়ী হন মান্নান। এরপর টানা আরও দুই মেয়াদে নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। মান্নান বলেন, ‘আমার ভাইকে সবাই ভালোবাসতেন। তিনি সবার জন্যই কাজ করতেন। আমরা শুধু ভাইকে ফেরত চাই।’

রাউজানের বাগোয়ান ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ আবু জাফর চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন ব্যক্তি ইমেজে। ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর তিনি এই দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ওঠবস শুরু করেন; কিন্তু তাতেও শেষরক্ষা হয়নি। তাঁর গুমের বিষয়ে তাঁর বড় ছেলে জিসানুর বলেন, ‘২০১০ সালে ২৭ মার্চ চাচা সালাহউদ্দিনকে (আবু জাফরের খালাত ভাই) নিয়ে বাসায় যাচ্ছিলাম।

চট্টগ্রাম নগরীর খুলশীর ভূঁইয়া গলির মুখ থেকে আমাদের সামনেই বেলা ১১টার দিকে একটি কালো রঙের মাইক্রোবাস এসে আব্বুকে তুলে নিয়ে যায়। বিষয়টি বাসায় ফিরে জানালে আম্মুসহ সবাই কান্নায় ভেঙে পড়েন। এরপর খুলশী থানায় জিডি করতে গেলে পুলিশ নেয়নি। সরকারের বিভিন্ন বাহিনীর দপ্তরে গিয়েও সুরাহা পাইনি।’

জাফর চেয়ারম্যানের স্ত্রী ইয়াসমিন আক্তার বলেন, ‘১৪টা বছর আমি আর আমার সন্তানেরা অপেক্ষায় আছি। এত দিন পুলিশের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও কোনো কাজ হয়নি। বর্তমান সরকারের কাছে আমি আমার স্বামীকে ফেরত চাই।’