আরও দুই বছর চলবে খনন, এরপর সংরক্ষণ

তানজিল হাসান, মুন্সিগঞ্জ
প্রকাশ : ৩০ এপ্রিল ২০২২, ১৫: ২৩

মুন্সিগঞ্জের টঙ্গিবাড়ী উপজেলার আব্দুল্লাহপুরের নাটেশ্বর গ্রামে প্রায় ৯ বছর ধরে চলছে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন। খননকাজে মাটির নিচ থেকে বেরিয়ে আসছে হাজার বছরের পুরোনো নানা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। এখানে ১০ একর বিশালাকৃতির দেউলে খননকাজ চলবে আরও দুই বছর। তারপর সংরক্ষণ করা হবে আবিষ্কৃত প্রাচীন নিদর্শনগুলো।

এই অঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান, খনন এবং গবেষণার উদ্যোগ নেয় অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশন। এই ফাউন্ডেশনের সভাপতি ও বিক্রমপুর অঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন এবং গবেষণা কর্মসূচির পরিচালক ড. নূহ-উল-আলম লেনিন।

ড. লেনিন বলেন, ‘আমরা আরও দুই বছর খনন অব্যাহত রাখব। এরপর প্রাচীন নিদর্শনগুলো সংরক্ষণ করা হবে। এ ব্যাপারে চীনের প্রত্নতাত্ত্বিকদের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। চীনের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক চুক্তি হয়েছে। কথা ছিল ২০১৯-২০ থেকে তাঁরা এখানে সংরক্ষণকাজে সহযোগিতা করবে।’ 
জানা গেছে, নাটেশ্বরে খননকাজ চলে মূলত শুষ্ক মৌসুমে। বর্ষাকালে কাজ বন্ধ থাকে। গত নভেম্বরে শুরু হওয়া কাজে এবার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের মধ্যে আছে অষ্টকোণাকৃতির বৌদ্ধস্তূপ, ধর্মচক্র ও প্রাচীর।

ড. লেনিন আরও বলেন, ‘এবার আবিষ্কৃত অষ্টকোণাকৃতির বৌদ্ধস্তূপ খুবই দুর্লভ। এর আগেও এখানে স্তূপ পাওয়া গেছে। সর্বশেষ এই স্তূপটি পাওয়া গেল। এটি মাটির ঢিবির প্রায় ১৪ ফুট নিচ থেকে আবিষ্কৃত হয়।’

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আবিষ্কৃত সীমানাপ্রাচীর, মণ্ডপ ও স্তূপের ইটের দেয়াল খুবই ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থায় আছে। অষ্টকোণাকৃতি স্তূপের প্রায় ৯০ ভাগই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, কিন্তু টিকে থাকা প্রায় ১০ ভাগ থেকে স্তূপের ভূমি-নকশা পরিষ্কার বোঝা যায়। এবারের অষ্টকোণাকৃতির স্তূপটি নাটেশ্বর দেউলের পঞ্চম স্তূপ। আবিষ্কৃত পাঁচটি স্তূপের প্রতিটিই দুটি করে পর্যায়ে নির্মাণ করা হয়েছিল, আদি পর্যায় এবং পরবর্তী পর্যায়। আদি পর্যায়ে ছাট আকারে এবং পরবর্তী পর্যায়ে স্তূপের স্থাপত্য বাড়িয়ে বড় করে নির্মাণ করা হয়েছিল।

আদি পর্যায়ের স্তূপটি পরবর্তী পর্যায়ের স্তূপের স্থাপত্য দিয়ে ঢেকে যায়। ফলে বাইরে থেকে আদি পর্যায়ের ছাট আকারের স্তূপটি সাধারণত দৃষ্টিগোচর হয় না। সদ্য আবিষ্কৃত পঞ্চম স্তূপটি আগের চারটি অষ্টকোণাকৃতির স্তূপের মতো একই রকম। পঞ্চম স্তূপের আদি পর্যায়ের অষ্টকোণাকৃতির দেয়ালের গাঁথুনি এখনো অপূর্বভাবে মসৃণ। দেখে মনে হয় যেন সিরামিক ইটের গাঁথুনি।

এদিকে এখানে আবিষ্কৃত হয়েছে একটি ধর্মচক্র। দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে ৭ দশমিক ৪ পরিমাপের একটা বর্গাকার ভিত্তির ওপর উল্লম্বভাবে ইট স্থাপন করে অনেকটা গরুর গাড়ির চাকার মতো করে ধর্মচক্রটি নির্মাণ করা হয়েছে। আগের আবিষ্কৃত প্রথম এবং চতুর্থ স্তূপের আদি পর্যায়ে ধর্মচক্রের আভাস দেখা দিয়েছিল; কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ের স্তূপ দিয়ে আবৃত থাকায় সে রহস্য উন্মোচিত হয়নি। এবারের আবিষ্কৃত পঞ্চম স্তূপের ধর্মচক্রটিতে আটটি স্পোক রয়েছে। সাধারণত ধর্মচক্রে ৪-৩১টি পর্যন্ত স্পোক থাকে। প্রতিটি স্পোকসংখ্যা বৌদ্ধধর্মে ভিন্ন ভিন্ন অর্থ বহন করে।

সংশ্লিষ্টদের দাবি, নিরেট ভিত্তিভূমিতে আট স্পোকবিশিষ্ট ধর্মচক্রের ওপর হাজার বছরের প্রাচীন মণ্ডপসহ অষ্টকোণাকৃতির স্তূপ; কেবল বাংলাদেশে কেন, পুরো ভারতবর্ষের অন্য কোথাও পাওয়া যায়নি। নাটেশ্বর দেউলে আবিষ্কৃত স্থাপত্য এবং আট স্পোকযুক্ত ধর্মচক্র সবই বৌদ্ধধর্মের মূল মন্ত্রের প্রতীকী রূপ।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সুফি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘বিক্রমপুরের (মুন্সিগঞ্জ) অনেক জায়গাতেই প্রাচীন নিদর্শন চাপা পড়ে আছে। সঠিক অনুসন্ধান, খনন ও গবেষণার মাধ্যমে তা আবিষ্কার করা সম্ভব। আমরা নাটেশ্বরে এই অর্থবছরের খননকাজ প্রায় গুছিয়ে এনেছি।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত