কামরুল হাসান, ঢাকা
মোগল দরবারের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদের নাম ছিল মুনশি। ধর্মীয় জ্ঞান, ভাষা, বিজ্ঞান ও দর্শনশাস্ত্রের পণ্ডিতকে এই ফারসি শব্দে অভিহিত করা হতো। তবে মুনশি শব্দ নিয়ে এত মুনশিয়ানা দেখানোর বিস্তর জ্ঞান আমার কস্মিনকালেও ছিল না। এটা জেনেছি সৈয়দ মুজতবা আলীর পঞ্চতন্ত্র পড়ার সুবাদে।
জনকণ্ঠে রিপোর্টিং বিভাগে কাজ করার সময় আমাদের দলে সে রকম একজন মুনশি ছিলেন–আহমেদ নূরে আলম। তাঁর পুরো নাম কখনো মুখে আসত না। আমরা ঈষৎ সংক্ষিপ্ত আর সম্পাদনা করে ডাকতাম নূরে আলম ভাই। বিজ্ঞান-অবিজ্ঞানের যেকোনো জটিল বিষয়কে সরল করে লেখায় তাঁর জুড়ি মেলা ভার। আমার মতো গড়পড়তা মানুষের কাছে নূরে আলম ভাই ছিলেন ‘অনেক জানাশোনা মানুষ’।
তো সেই নূরে আলম ভাইয়ের একদিন ভীষণ মন খারাপ। কী একটা কাজে আমি জনকণ্ঠ ভবনের অন্য তলায়, রিপোর্টিং থেকে অগ্রজ ফজলুল বারী ডেকে পাঠালেন। নিউজরুমে এসে দেখি, তিনজন সহকর্মী নূরে আলম ভাইয়ের তিন দিক ঘিরে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন। তিনি খুবই উদ্বিগ্ন, তাঁর দুই চোখ টলটল।
এ রকম একজন মানুষকে এই অবস্থায় দেখে কিছুটা হতবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ব্যাপার কী নূরে আলম ভাই? তিনি বললেন, ‘অপি খুব বিপদে পড়েছে।’ আমি বললাম, ‘কোন অপি?’ তিনি বললেন, ‘অপি করিম’। অভিনয় জগতে অপি করিমের তখন বেশ নামডাক। কিন্তু তাঁর কারণে নূরে আলম ভাই কেন উদ্বিগ্ন, বুঝতে না পেরে আবার জানতে চাইলাম, ‘অপি করিমের কী হয়েছে, তাতে আপনার কী?’ তিনি বললেন, ‘সে তো আমার বোন বাবলির মেয়ে।’
শুনে একটু অবাকই হলাম। এত দিন পাশে বসে কাজ করছি, অথচ তিনি কখনো এসবের কিছুই বলেননি। তিনি বরাবরই নিজের সম্পর্কে ঢাকঢোল পেটানোর উল্টো পথে চলা মানুষ। নূরে আলম ভাইকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, চিন্তার কিছু নেই, আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।
সে সময় ঢাকা মহানগরের পুলিশ কমিশনার ছিলেন আবদুল কাইয়ুম। ক্রাইম রিপোর্টারদের সঙ্গে তাঁর ‘ভাই-ব্রাদার’ সম্পর্ক। প্রথমে তাঁকে ফোন দিলাম। বললেন, এখনই ডিসিকে বলে দিচ্ছেন। একটু পরে ডিবির ইন্সপেক্টর রেজাউল করিমের ফোন। বললেন, তাঁদের একটি দল এখনই বের হবে, চাইলে আমি সঙ্গে যেতে পারি। ডিবির মাইক্রোবাসের পিছে পিছে মোটরসাইকেল নিয়ে গেলাম বুয়েটে। কিন্তু সেখানে সবকিছু স্বাভাবিকই মনে হলো। অপি আশ্রয় নিয়েছিলেন বুয়েটের শিক্ষক অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন আহমেদের বাসায়। সেখানে তাঁর মা সঙ্গে ছিলেন। পুলিশের গাড়িতে ওঠার আগে মা-মেয়েকে দেখে মনে হচ্ছিল, তাঁরা যেন গভীর জলে ডুবতে ডুবতে কোনোমতে বেঁচে ফিরেছেন। এরপর পুলিশি পাহারায় সেদিন তাঁরা বাসায় চলে যান।
এ রকম পরিস্থিতির শিকার কারও কাছে ঘটনা বিষয়ে জানতে চাওয়া খুবই অমানবিক। কিন্তু সংবাদকর্মীকে সেই কঠিন কাজটাই হেসে হেসে করতে হয়। অপির মা-বাবা সেদিন যা বললেন, তা শুনে চুপ হয়ে গেলাম। এটা ছিল ২০০২ সালের ১৮ আগস্ট রোববার।
এ ঘটনার প্রায় আড়াই মাস আগে (২০০২ সালের ৮ জুন) দরপত্র নিয়ে বিরোধে বুয়েট ছাত্রদল সভাপতি মোকাম্মেল হায়াত খান মুকি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এস এম হলের টগর গ্রুপের সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে মারা যান কেমিকৌশলের শিক্ষার্থী সাবেকুন নাহার সনি। সে সময় ছাত্র বিক্ষোভের মুখে বুয়েট অনেক দিন বন্ধ ছিল। খোলার পরে শুরু হয় বিভিন্ন বিভাগের পরীক্ষা। তবে উত্তপ্ত পরিস্থিতির কারণে তখনো ক্যাম্পাসে পুলিশ ছিল।
সেদিন ১৮ আগস্ট (২০০২) সকালে অপি আসেন পরীক্ষা দিতে। ক্যাম্পাসে আসার পর থেকে তাঁকে উত্ত্যক্ত করতে থাকেন তখনকার বুয়েট ছাত্র সংসদের ভিপি ও জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের নেতা গোলাম মোর্শেদ লায়ন। সেদিন পরীক্ষা দিয়ে ক্যাম্পাস থেকে বের হয়ে শহীদ মিনারের কাছে এলে লায়ন তাঁর সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে অপির পথরোধ করে দাঁড়ান। যেন ক্ষুধার্ত বাঘ, শিকারের অপেক্ষায় আছেন! তিনি অপিকে জোর করে তুলে নিয়ে যেতে চান। অপির সঙ্গে তাঁর মা ছিলেন। এ ঘটনায় মা-মেয়ে খুবই আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। বুয়েটের গেটের সামনে তখন পুলিশের একটি দল ছিল। অপি তাদের কাছে সাহায্য চাইলে পুলিশের একজন সদস্য বলেন, এটা ক্যাম্পাসের বাইরের ঘটনা, তাঁদের কিছুই করার নেই। এ রকম পরিস্থিতিতে মা-মেয়ে কী করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। পরে অপি এক বান্ধবীর সাহায্য নিয়ে অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন আহমেদের বাসায় গিয়ে আশ্রয় নেন। লায়ন তখন দলবল নিয়ে বের হওয়ার পথে পাহারা বসান। অবশ্য ডিবির গাড়ি আসার পর তাঁরা কেটে পড়েন।
এ ঘটনার কয়েক মাস আগে অপি একদিন বুয়েট থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে করে বাড়ি ফিরছিলেন। বাসটি মোহাম্মদপুরে আসার পর তিনি দেখেন, সেই বাসের পেছনের দিকে বুয়েট ছাত্র সংসদের ভিপি বসে। তিনি খুবই আপত্তিকরভাবে তাকাচ্ছেন। এই অবস্থায় অপি বাস থেকে দ্রুত নেমে বাড়ির দিকে চলে যান। কিছুক্ষণ পর তাঁর বাসার দরজায় কড়া নাড়েন ভিপি লায়ন। তিনি খুবই অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকেন। সেদিন অনেক কষ্টে তাঁকে বিদায় করা হয়। এরপরই বিভিন্ন সময় তিনি অপিকে উত্ত্যক্ত করতে থাকেন। ক্লাসে, ক্যানটিনে, পথে, যেখানে-সেখানে আজেবাজে মন্তব্য করতে থাকেন আর তুলে নেওয়ার হুমকি দেন। একদিকে স্থাপত্যবিদ্যার মতো জটিল বিষয়, অন্যদিকে মানসিক যন্ত্রণা—দুয়ে মিলে পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পারছিলেন না অপি। পরিস্থিতি একসময় এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে অপি বুয়েট ছেড়ে দেওয়ার কথাও ভাবতে শুরু করেন। এই অবস্থায় মেয়ের বিপদে ঢাল হয়ে দাঁড়ান মা শাহানারা করিম বাবলি। সংসারের কাজ ফেলে তিনি মেয়ের সঙ্গে ক্যাম্পাসে আসা-যাওয়া করতে থাকেন।
এভাবে দুই বছর শেষ হয়। পঞ্চম বর্ষে এসে আবার সেই একই যন্ত্রণা। এবার ভিপি লায়ন আরও বেপরোয়া। অপি তখন নিজের নিরাপত্তা নিয়ে এতটা শঙ্কিত হন যে নিজের বাসাতেও একটানা থাকতেন না। পালা করে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে রাত কাটানো শুরু করেন।
অপহরণের চেষ্টা নিয়ে অপির বাবা সৈয়দ আবদুল করিম লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলেন থানায়। কিন্তু পুলিশ সেই অভিযোগ মামলা হিসেবে গ্রহণ করেনি। সে সময় মামুনুর রশীদসহ অনেক নাট্যজন এ ঘটনার প্রতিবাদ করে বিবৃতি দেন। তারপরও দেশের নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বুয়েট তাদের শিক্ষার্থীর নিরাপত্তার জন্য কিছুই করেনি। উল্টো বুয়েটসহ সবাই ভিপি লায়নের পক্ষ নেয়। একপর্যায়ে লায়নকে বাঁচাতে তাঁকে মানসিক রোগীর সনদ দিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়।
বুয়েটের তখন ছাত্রকল্যাণ উপদেষ্টা ছিলেন অধ্যাপক জয়নুল আবেদিন। তিনি আমাকে বলেছিলেন, লায়নকে বুয়েটের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা শাজাহান আলী মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে ভর্তি করে দিয়েছেন। লায়ন একজন প্রকৃত মানসিক রোগী। তিনি বলেন, এর আগেও জামানস ও মনন নামের দুটি ক্লিনিকে মানসিক রোগের চিকিৎসা নিয়েছিলেন লায়ন।
যত দূর মনে পড়ে, প্রথম ঘটনার পর লায়নের বাবা দিনাজপুরের পার্বতীপুরের একটি কলেজের শিক্ষক মকবুল হোসেন বুয়েটে লিখিত অঙ্গীকার দিয়ে বলেছিলেন, তাঁর ছেলে আর কাউকে উত্ত্যক্ত করবেন না। মকবুল হোসেন একবার বিষয়টি মিটিয়ে ফেলতে বুয়েটের গাড়িতে চড়ে অপিদের মোহাম্মদপুরের বাসাতেও গিয়েছিলেন। কিন্তু পরে সে কথা আর রক্ষা হয়নি।
ওই সময় পুলিশের একজন কর্মকর্তা আমাকে বলেছিলেন, লায়নকে নিয়ে তাঁদের পক্ষে আসলে কিছুই করা সম্ভব নয়। কারণ, লায়নের জন্মদিনের কেক কেটেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া।
লায়নের খোঁজ নিয়ে গত বৃহস্পতিবার আজকের পত্রিকার দিনাজপুর প্রতিনিধি আনিসুল হক জুয়েল আর নীলফামারী প্রতিনিধি জসিম উদ্দিন বললেন, লায়নের বাবা জাতীয় পার্টির বড় নেতা ছিলেন। লায়ন এখনো পার্বতীপুরে একা থাকেন। তিনি কিছুই করেন না, শুধু এলাকায় ঘুরে বেড়ান।
আমাদের সেই নূরে আলম ভাই এখন অবসর যাপনে আমেরিকায় থাকেন। কদিন আগে তাঁকে ফোন করেছিলাম। শুধু বললেন, কী বাজে সময়ই-না গেছে।
অপির সঙ্গে কথাও হলো বুধবার। পুরোনো কথা তুলতেই মনে হলো, তাঁর মনের গভীরে ক্ষত এখনো দগদগে। সেই ঘটনা, পরিস্থিতি—সবই তাঁর মনে আছে, ভোলেননি কিছুই। শুধু বললেন, জীবনের সেই ঝড়টা এভাবে পাড়ি দিতে না হলে (পরীক্ষায়) আরও ভালো ফল করা যেত।
অপির ফোন রাখতে রাখতে মনে হচ্ছিল, অপি যেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ঝড়ের পরে’ গল্পের সেই কিশোর ছেলেটি। ঝড় যাঁকে শিখিয়ে দিয়ে গেছে, কী করে বাঁচতে হয়, কী করে শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াতে হয়।
হয়তো সেই শিক্ষাই জীবনে কাজে লাগিয়েছেন অপি। এখন তাঁর গণ্ডি দেশ থেকে দেশান্তরে ছড়িয়ে গেছে। হালে ঢাকা-কলকাতায় মুক্তি পাওয়া ‘মায়ার জঞ্জাল’ ছবিটি তো তারই বার্তা দিয়ে গেল।
আষাঢ়ে নয় সম্পর্কিত আরও পড়ুন:
মোগল দরবারের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদের নাম ছিল মুনশি। ধর্মীয় জ্ঞান, ভাষা, বিজ্ঞান ও দর্শনশাস্ত্রের পণ্ডিতকে এই ফারসি শব্দে অভিহিত করা হতো। তবে মুনশি শব্দ নিয়ে এত মুনশিয়ানা দেখানোর বিস্তর জ্ঞান আমার কস্মিনকালেও ছিল না। এটা জেনেছি সৈয়দ মুজতবা আলীর পঞ্চতন্ত্র পড়ার সুবাদে।
জনকণ্ঠে রিপোর্টিং বিভাগে কাজ করার সময় আমাদের দলে সে রকম একজন মুনশি ছিলেন–আহমেদ নূরে আলম। তাঁর পুরো নাম কখনো মুখে আসত না। আমরা ঈষৎ সংক্ষিপ্ত আর সম্পাদনা করে ডাকতাম নূরে আলম ভাই। বিজ্ঞান-অবিজ্ঞানের যেকোনো জটিল বিষয়কে সরল করে লেখায় তাঁর জুড়ি মেলা ভার। আমার মতো গড়পড়তা মানুষের কাছে নূরে আলম ভাই ছিলেন ‘অনেক জানাশোনা মানুষ’।
তো সেই নূরে আলম ভাইয়ের একদিন ভীষণ মন খারাপ। কী একটা কাজে আমি জনকণ্ঠ ভবনের অন্য তলায়, রিপোর্টিং থেকে অগ্রজ ফজলুল বারী ডেকে পাঠালেন। নিউজরুমে এসে দেখি, তিনজন সহকর্মী নূরে আলম ভাইয়ের তিন দিক ঘিরে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন। তিনি খুবই উদ্বিগ্ন, তাঁর দুই চোখ টলটল।
এ রকম একজন মানুষকে এই অবস্থায় দেখে কিছুটা হতবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ব্যাপার কী নূরে আলম ভাই? তিনি বললেন, ‘অপি খুব বিপদে পড়েছে।’ আমি বললাম, ‘কোন অপি?’ তিনি বললেন, ‘অপি করিম’। অভিনয় জগতে অপি করিমের তখন বেশ নামডাক। কিন্তু তাঁর কারণে নূরে আলম ভাই কেন উদ্বিগ্ন, বুঝতে না পেরে আবার জানতে চাইলাম, ‘অপি করিমের কী হয়েছে, তাতে আপনার কী?’ তিনি বললেন, ‘সে তো আমার বোন বাবলির মেয়ে।’
শুনে একটু অবাকই হলাম। এত দিন পাশে বসে কাজ করছি, অথচ তিনি কখনো এসবের কিছুই বলেননি। তিনি বরাবরই নিজের সম্পর্কে ঢাকঢোল পেটানোর উল্টো পথে চলা মানুষ। নূরে আলম ভাইকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, চিন্তার কিছু নেই, আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।
সে সময় ঢাকা মহানগরের পুলিশ কমিশনার ছিলেন আবদুল কাইয়ুম। ক্রাইম রিপোর্টারদের সঙ্গে তাঁর ‘ভাই-ব্রাদার’ সম্পর্ক। প্রথমে তাঁকে ফোন দিলাম। বললেন, এখনই ডিসিকে বলে দিচ্ছেন। একটু পরে ডিবির ইন্সপেক্টর রেজাউল করিমের ফোন। বললেন, তাঁদের একটি দল এখনই বের হবে, চাইলে আমি সঙ্গে যেতে পারি। ডিবির মাইক্রোবাসের পিছে পিছে মোটরসাইকেল নিয়ে গেলাম বুয়েটে। কিন্তু সেখানে সবকিছু স্বাভাবিকই মনে হলো। অপি আশ্রয় নিয়েছিলেন বুয়েটের শিক্ষক অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন আহমেদের বাসায়। সেখানে তাঁর মা সঙ্গে ছিলেন। পুলিশের গাড়িতে ওঠার আগে মা-মেয়েকে দেখে মনে হচ্ছিল, তাঁরা যেন গভীর জলে ডুবতে ডুবতে কোনোমতে বেঁচে ফিরেছেন। এরপর পুলিশি পাহারায় সেদিন তাঁরা বাসায় চলে যান।
এ রকম পরিস্থিতির শিকার কারও কাছে ঘটনা বিষয়ে জানতে চাওয়া খুবই অমানবিক। কিন্তু সংবাদকর্মীকে সেই কঠিন কাজটাই হেসে হেসে করতে হয়। অপির মা-বাবা সেদিন যা বললেন, তা শুনে চুপ হয়ে গেলাম। এটা ছিল ২০০২ সালের ১৮ আগস্ট রোববার।
এ ঘটনার প্রায় আড়াই মাস আগে (২০০২ সালের ৮ জুন) দরপত্র নিয়ে বিরোধে বুয়েট ছাত্রদল সভাপতি মোকাম্মেল হায়াত খান মুকি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এস এম হলের টগর গ্রুপের সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে মারা যান কেমিকৌশলের শিক্ষার্থী সাবেকুন নাহার সনি। সে সময় ছাত্র বিক্ষোভের মুখে বুয়েট অনেক দিন বন্ধ ছিল। খোলার পরে শুরু হয় বিভিন্ন বিভাগের পরীক্ষা। তবে উত্তপ্ত পরিস্থিতির কারণে তখনো ক্যাম্পাসে পুলিশ ছিল।
সেদিন ১৮ আগস্ট (২০০২) সকালে অপি আসেন পরীক্ষা দিতে। ক্যাম্পাসে আসার পর থেকে তাঁকে উত্ত্যক্ত করতে থাকেন তখনকার বুয়েট ছাত্র সংসদের ভিপি ও জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের নেতা গোলাম মোর্শেদ লায়ন। সেদিন পরীক্ষা দিয়ে ক্যাম্পাস থেকে বের হয়ে শহীদ মিনারের কাছে এলে লায়ন তাঁর সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে অপির পথরোধ করে দাঁড়ান। যেন ক্ষুধার্ত বাঘ, শিকারের অপেক্ষায় আছেন! তিনি অপিকে জোর করে তুলে নিয়ে যেতে চান। অপির সঙ্গে তাঁর মা ছিলেন। এ ঘটনায় মা-মেয়ে খুবই আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। বুয়েটের গেটের সামনে তখন পুলিশের একটি দল ছিল। অপি তাদের কাছে সাহায্য চাইলে পুলিশের একজন সদস্য বলেন, এটা ক্যাম্পাসের বাইরের ঘটনা, তাঁদের কিছুই করার নেই। এ রকম পরিস্থিতিতে মা-মেয়ে কী করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। পরে অপি এক বান্ধবীর সাহায্য নিয়ে অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন আহমেদের বাসায় গিয়ে আশ্রয় নেন। লায়ন তখন দলবল নিয়ে বের হওয়ার পথে পাহারা বসান। অবশ্য ডিবির গাড়ি আসার পর তাঁরা কেটে পড়েন।
এ ঘটনার কয়েক মাস আগে অপি একদিন বুয়েট থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে করে বাড়ি ফিরছিলেন। বাসটি মোহাম্মদপুরে আসার পর তিনি দেখেন, সেই বাসের পেছনের দিকে বুয়েট ছাত্র সংসদের ভিপি বসে। তিনি খুবই আপত্তিকরভাবে তাকাচ্ছেন। এই অবস্থায় অপি বাস থেকে দ্রুত নেমে বাড়ির দিকে চলে যান। কিছুক্ষণ পর তাঁর বাসার দরজায় কড়া নাড়েন ভিপি লায়ন। তিনি খুবই অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকেন। সেদিন অনেক কষ্টে তাঁকে বিদায় করা হয়। এরপরই বিভিন্ন সময় তিনি অপিকে উত্ত্যক্ত করতে থাকেন। ক্লাসে, ক্যানটিনে, পথে, যেখানে-সেখানে আজেবাজে মন্তব্য করতে থাকেন আর তুলে নেওয়ার হুমকি দেন। একদিকে স্থাপত্যবিদ্যার মতো জটিল বিষয়, অন্যদিকে মানসিক যন্ত্রণা—দুয়ে মিলে পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পারছিলেন না অপি। পরিস্থিতি একসময় এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে অপি বুয়েট ছেড়ে দেওয়ার কথাও ভাবতে শুরু করেন। এই অবস্থায় মেয়ের বিপদে ঢাল হয়ে দাঁড়ান মা শাহানারা করিম বাবলি। সংসারের কাজ ফেলে তিনি মেয়ের সঙ্গে ক্যাম্পাসে আসা-যাওয়া করতে থাকেন।
এভাবে দুই বছর শেষ হয়। পঞ্চম বর্ষে এসে আবার সেই একই যন্ত্রণা। এবার ভিপি লায়ন আরও বেপরোয়া। অপি তখন নিজের নিরাপত্তা নিয়ে এতটা শঙ্কিত হন যে নিজের বাসাতেও একটানা থাকতেন না। পালা করে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে রাত কাটানো শুরু করেন।
অপহরণের চেষ্টা নিয়ে অপির বাবা সৈয়দ আবদুল করিম লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলেন থানায়। কিন্তু পুলিশ সেই অভিযোগ মামলা হিসেবে গ্রহণ করেনি। সে সময় মামুনুর রশীদসহ অনেক নাট্যজন এ ঘটনার প্রতিবাদ করে বিবৃতি দেন। তারপরও দেশের নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বুয়েট তাদের শিক্ষার্থীর নিরাপত্তার জন্য কিছুই করেনি। উল্টো বুয়েটসহ সবাই ভিপি লায়নের পক্ষ নেয়। একপর্যায়ে লায়নকে বাঁচাতে তাঁকে মানসিক রোগীর সনদ দিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়।
বুয়েটের তখন ছাত্রকল্যাণ উপদেষ্টা ছিলেন অধ্যাপক জয়নুল আবেদিন। তিনি আমাকে বলেছিলেন, লায়নকে বুয়েটের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা শাজাহান আলী মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে ভর্তি করে দিয়েছেন। লায়ন একজন প্রকৃত মানসিক রোগী। তিনি বলেন, এর আগেও জামানস ও মনন নামের দুটি ক্লিনিকে মানসিক রোগের চিকিৎসা নিয়েছিলেন লায়ন।
যত দূর মনে পড়ে, প্রথম ঘটনার পর লায়নের বাবা দিনাজপুরের পার্বতীপুরের একটি কলেজের শিক্ষক মকবুল হোসেন বুয়েটে লিখিত অঙ্গীকার দিয়ে বলেছিলেন, তাঁর ছেলে আর কাউকে উত্ত্যক্ত করবেন না। মকবুল হোসেন একবার বিষয়টি মিটিয়ে ফেলতে বুয়েটের গাড়িতে চড়ে অপিদের মোহাম্মদপুরের বাসাতেও গিয়েছিলেন। কিন্তু পরে সে কথা আর রক্ষা হয়নি।
ওই সময় পুলিশের একজন কর্মকর্তা আমাকে বলেছিলেন, লায়নকে নিয়ে তাঁদের পক্ষে আসলে কিছুই করা সম্ভব নয়। কারণ, লায়নের জন্মদিনের কেক কেটেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া।
লায়নের খোঁজ নিয়ে গত বৃহস্পতিবার আজকের পত্রিকার দিনাজপুর প্রতিনিধি আনিসুল হক জুয়েল আর নীলফামারী প্রতিনিধি জসিম উদ্দিন বললেন, লায়নের বাবা জাতীয় পার্টির বড় নেতা ছিলেন। লায়ন এখনো পার্বতীপুরে একা থাকেন। তিনি কিছুই করেন না, শুধু এলাকায় ঘুরে বেড়ান।
আমাদের সেই নূরে আলম ভাই এখন অবসর যাপনে আমেরিকায় থাকেন। কদিন আগে তাঁকে ফোন করেছিলাম। শুধু বললেন, কী বাজে সময়ই-না গেছে।
অপির সঙ্গে কথাও হলো বুধবার। পুরোনো কথা তুলতেই মনে হলো, তাঁর মনের গভীরে ক্ষত এখনো দগদগে। সেই ঘটনা, পরিস্থিতি—সবই তাঁর মনে আছে, ভোলেননি কিছুই। শুধু বললেন, জীবনের সেই ঝড়টা এভাবে পাড়ি দিতে না হলে (পরীক্ষায়) আরও ভালো ফল করা যেত।
অপির ফোন রাখতে রাখতে মনে হচ্ছিল, অপি যেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ঝড়ের পরে’ গল্পের সেই কিশোর ছেলেটি। ঝড় যাঁকে শিখিয়ে দিয়ে গেছে, কী করে বাঁচতে হয়, কী করে শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াতে হয়।
হয়তো সেই শিক্ষাই জীবনে কাজে লাগিয়েছেন অপি। এখন তাঁর গণ্ডি দেশ থেকে দেশান্তরে ছড়িয়ে গেছে। হালে ঢাকা-কলকাতায় মুক্তি পাওয়া ‘মায়ার জঞ্জাল’ ছবিটি তো তারই বার্তা দিয়ে গেল।
আষাঢ়ে নয় সম্পর্কিত আরও পড়ুন:
পর্দার নায়িকারা নিজেদের বয়স আড়ালে রাখা পছন্দ করেন। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম আজমেরী হক বাঁধন। প্রতিবছর নিজের জন্মদিনে জানান দেন তাঁর বয়স। গতকাল ছিল বাঁধনের ৪১তম জন্মদিন। সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেই জানালেন এই তথ্য।
২ দিন আগে১০ বছরের বেশি সময় ধরে শোবিজে কাজ করছেন অভিনেত্রী শবনম ফারিয়া। নাটকের পাশাপাশি ওটিটিতে দেখা গেছে তাঁকে। সরকারি অনুদানের ‘দেবী’ নামের একটি সিনেমায়ও অভিনয় করেছেন। প্রশংসিত হলেও সিনেমায় আর দেখা মেলেনি তাঁর। ছোট পর্দাতেও অনেক দিন ধরে অনিয়মিত তিনি। এবার শবনম ফারিয়া হাজির হচ্ছেন নতুন পরিচয়ে। কমেডি রিয়েলিটি
২ দিন আগেআমাদের লোকসংস্কৃতির অন্যতম ঐতিহ্য যাত্রাপালা। গণমানুষের সংস্কৃতি হিসেবে বিবেচিত এই যাত্রাপালা নিয়ে শিল্পকলা একাডেমি আয়োজন করছে ‘যাত্রা উৎসব-২০২৪’। আগামী ১ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মুক্তমঞ্চে শুরু হবে ৭ দিনব্যাপী এই উৎসব।
২ দিন আগে‘বঙ্গবন্ধু’ পদবি বিলীন হবে না। হতে পারে না। যেমনটি ‘দেশবন্ধু’ চিত্তরঞ্জন দাশের পদবি বিলীন হয়নি। ইতিহাসে এসব পদবি অম্লান ও অক্ষয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিত্ব ছিল অনন্যসাধারণ। আপনজনকে তো অবশ্যই, শত্রুপক্ষের লোকেরাও ব্যক্তিগত পর্যায়ে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হতেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর উচ্চপদের
২ দিন আগে