বিএসএমএমইউ হাসপাতাল: এক দিনও কাজ হয়নি সাড়ে ৩ কোটির যন্ত্রে, অনুসন্ধানে দুদক

রাশেদ রাব্বি ও মারুফ কিবরিয়া, ঢাকা 
প্রকাশ : ০৪ নভেম্বর ২০২৩, ০৯: ৫১
আপডেট : ০৪ নভেম্বর ২০২৩, ১০: ১৬

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালের বর্জ্য শোধনের জন্য একটি যন্ত্র কেনা হয়েছিল প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টাকায়। ২০১৮ সালে কেনা ‘মেডিকেল ওয়েস্ট ডিসপোজাল প্ল্যান্ট’টি এক দিনও ব্যবহার করেনি প্রতিষ্ঠানটি। এমনকি ব্যবহারের জন্য সেটি কোথাও স্থাপনও করা হয়নি। গুদামে তালাবদ্ধ কক্ষে পড়ে আছে। এভাবে রাষ্ট্রীয় অর্থ অপচয়ের বিষয়ে অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বিএসএমএমইউ ও দুদক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। 

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, যন্ত্রটি ব্যবহারের উপযোগীই নয়। এই প্ল্যান্ট কিনে স্থাপন করার চেয়ে রক্ষণাবেক্ষণ বেশি ব্যয়বহুল। এ ছাড়া এটি স্থাপন করা হলেও আদৌ কাজে আসবে কি না, তা নিয়েও সংশয় আছে।

প্রকল্প পরিচালক ডা. আবু নাসার রিজভী আজকের পত্রিকাকে বলেন, এটি কোরিয়ান হাসপাতালে স্থাপন করা হবে বলে আর ব্যবহার করেনি বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষ।  
বিএসএমএমইউ সূত্রে জানা যায়, ২০১৭ সালে বিএসএমএমইউকে সেন্টার অব এক্সিলেন্স-এ পরিণতকরণ (দ্বিতীয় পর্যায়) শীর্ষক প্রকল্পের অধীনে হাসপাতালের চিকিৎসা বর্জ্য শোধনের জন্য প্ল্যান্টটি কেনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। প্রকল্পের পরিচালক ছিলেন ডা. আবু নাসার রিজভী। ২০১৭ সালের ২ আগস্ট প্ল্যান্টটি কেনা ও স্থাপন করার কাজ পায় এমএস আহমেদ এন্টারপ্রাইজ। ৩ কোটি ৩৩ লাখ টাকায় কেনা হয় প্ল্যান্ট। হাসপাতালের তৎকালীন পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আবদুল্লাহ-আল-হারুনের নেতৃত্বে ২০১৮ সালের ৬ জুন সামগ্রী গ্রহণ ও মূল্যায়ন কমিটিও গঠন করে কর্তৃপক্ষ। প্রকল্প পরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু নাসার রিজভীর সই করা এক আদেশে ওই কমিটিকে মেডিকেল ওয়েস্ট ডিসপোজাল প্ল্যান্ট যাচাই-বাছাই করে গ্রহণের বিষয়ে সাত দিনের মধ্যে মতামত দিতে বলা হয়। ২০১৮ সালের ১৫ জুলাই কমিটির সভাপতি উপস্থিত থেকে প্ল্যান্টের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করেছেন বলে প্রকল্প পরিচালককে জানান। সে অনুযায়ী প্ল্যান্টটি গ্রহণ করা হয়। 

জানা গেছে, প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা না করে এবং স্থাপনের স্থান নির্ধারণ না করেই বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন কর্তৃপক্ষ প্ল্যান্টটি কিনেছিল। প্ল্যান্ট আসার পর প্রথমে সেটি বর্তমান সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের এক কোনায় এবং পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে বসানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু কোনোখানেই স্থাপন করা সম্ভব হয়নি। সম্প্রতি এটি পুনঃস্থাপন করার উদ্যোগ নেওয়া হলে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ৬০ লাখ টাকা দাবি করে। ফলে প্রক্রিয়াটি অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক বলেন, বর্জ্য শোধনাগার কেনা হলেও কখনো ব্যবহার করা হয়নি। এমনকি কখনো ব্যবহার হবে কি না, সে বিষয়েও সন্দেহ আছে। তিনি বলেন, যন্ত্রটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর সংশ্লিষ্ট কোনো কর্মকর্তা সঠিকভাবে বুঝেও নেননি। তাঁরা কাগজে-কলমে গ্রহণ করে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে ছাড়পত্র দেন। 

এ বিষয়ে মূল্যায়ন ও গ্রহণসংক্রান্ত কমিটির সদস্য ডা. নাজমুল করিম বলেন, ‘এটা নিয়ে আমি বেশি কিছু জানি না। হাসপাতালে কোনো যন্ত্র কেনা হলে সেটা বুঝে নেওয়ার একটা নিয়ম আছে; সে দায়িত্বই পালন করেছি।’ তিনি বলেন, ‘তখন যন্ত্রটি নতুন হাসপাতালে বসানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তারপর কী হয়েছে আমি জানি না।’

বর্জ্য শোধনাগার প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনাবিষয়ক কনসালট্যান্ট তড়িৎ কান্তি বিশ্বাস আজকের পত্রিকাকে বলেন, বর্তমানে তিন ধরনের মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থা আছে, সেগুলো হলো—ইনসিনেটর অটোক্লেভ ও মাইক্রোওয়েভ পদ্ধতি। ঘণ্টায় ৫০ কেজি পরিশোধন ক্ষমতাসম্পন্ন একটি ইনসিনেটর স্থাপনে ২,০০০ বর্গফুট জায়গা লাগে। সেটি হতে হয় দুই কক্ষবিশিষ্ট। একটি কক্ষের তাপমাত্রা থাকে ৮৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং অন্যটির ১০৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এটি পরিচালনায় বিদ্যুতের পাশাপাশি জ্বালানি তেলের প্রয়োজন হয়। অন্যদিকে ১৫০-২০০ কেজি বর্জ্য পরিশোধন ক্ষমতাসম্পন্ন অটোক্লেভ স্থাপনে ১৫০০ বর্গফুট জায়গা লাগে। তবে অটোক্লেভ যন্ত্র ব্যবহারে লিকুইড ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের প্রয়োজন। এ ছাড়া মাইক্রোওয়েভ পদ্ধতির বর্জ্য শোধনাগার স্থাপনে একই পরিমাণ জায়গা লাগে। মাইক্রোওয়েভ পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ ছাড়া অন্য কোনো জ্বালানি লাগে না। 

তবে বিএসএমএমইউর শোধনাগারটি কোন পদ্ধতির, সেটি কেউ সঠিক বলতে পারছেন না।

এ বিষয়ে মূল্যায়ন ও গ্রহণসংক্রান্ত কমিটির সভাপতি আবদুল্লাহ-আল-হারুন বলেন, ‘এটা প্রকল্প পরিচালক ভালো বলতে পারবেন। আমি এর পরেই এই দায়িত্ব থেকে চলে যাই।’
যন্ত্রটি ব্যবহার করা হয়েছিল কি না, জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘আমি প্রকল্পের দায়িত্বে ছিলাম, তাই এ বিষয়ে বলতে পারছি না। কর্তৃপক্ষ কত দিন ব্যবহার করেছে, সেটা তারাই জানে।’
দুদক সূত্রে জানা গেছে, বিএসএমএমইউর যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় অনিয়মের একটি অভিযোগনামা নিয়ে দুদক অনুসন্ধান করছে। সেই অভিযোগনামায় বর্জ্য শোধনাগারের বিষয়টিও আছে। অভিযোগটি অনুসন্ধানের জন্য গত জুনে দুদক কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়েছে। দুদকের উপপরিচালক সৈয়দ নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি দল অভিযোগটি অনুসন্ধান করছে।
অনুসন্ধানের বিষয়ে দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, অনুসন্ধান চলমান। অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা আইন ও বিধি অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ে প্রতিবেদন জমা দেবেন। অনুসন্ধান কবে নাগাদ শেষ হবে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিধি অনুযায়ী ১২০ কর্মদিবসের মধ্যে অনুসন্ধান শেষ করতে হয়। তবে কর্মকর্তা মনে করলে কমিশনের অনুমোদনক্রমে সময় বাড়ানো যায়।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত