চরম ঝুঁকিতে চরের মানুষ

মিসু সাহা নিক্কন, রামগতি (লক্ষ্মীপুর)
প্রকাশ : ০৮ অক্টোবর ২০২২, ১৩: ৫৭

লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার দুর্গম পাঁচটি চরে নিরাপদ কোনো আশ্রয়কেন্দ্র নেই। এ অবস্থায় চর আবদুল্লাহ, চর গজারিয়া ও তেলির চরে বসবাসকারী নারী ও শিশুসহ প্রায় ১০ হাজার মানুষ চরম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় শেষসম্বল ঘরবাড়ি ও গবাদিপশু ছেড়ে আসতে চান না তাঁরা অথচ এই বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য ওই চরগুলোতে কোনো আশ্রয়কেন্দ্র নেই, নেই কোনো বেড়িবাঁধ।

লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার মেঘনার বুকে এই ইউনিয়নের ৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে মাত্র একটি ওয়ার্ড রয়েছে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে। বাকি আটটি ওয়ার্ড রয়েছে মেঘনা নদীর মাঝখানে। ‘দ্বীপ চর আবদুল্লাহ’ মেঘনা নদীর ভাঙনে দিনকে দিন ছোট হয়ে আসছে। কমছে জনসংখ্যাও।

সরেজমিনে ওই চরে গেলেও পাওয়া যায়নি চেয়ারম্যান কিংবা ইউপি সদস্যদের। এই বিশাল চরের আটটি ওয়ার্ডের মধ্যে একটি ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য থাকেন এই চরে।

বাকিরা উপজেলা সদরে থাকেন। উপকূলীয় এলাকার মানুষের জীবন ও জীবিকা বিপর্যস্ত হয়েছে। একসময়ের সম্ভ্রান্ত পরিবারগুলো জমি ও সম্পদ হারিয়ে দরিদ্র হয়েছে। গ্রাম ঘুরে দেখা যায় মানুষের জীবনসংগ্রামের চিত্র। জনপদে ঘোরার সময় প্রায় সবার মুখেই শোনা গেল এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা। স্থানীয়রা আরও জানান, দুর্যোগে টিকতে না পেরে অনেকে এলাকা ছেড়েছেন, অনেকে ছাড়ার পথে রয়েছেন।

উপকূলের মানুষের বেঁচে থাকার সমাধান খুঁজতে গিয়ে যে বিষয়টি সবার আগে উঠে এসেছে তা হলো, টেকসই নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র ও স্থায়ী বেড়িবাঁধ। ওইসব এলাকার লোকজন বলছেন, তাঁরা জন্মগতভাবেই প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করতে শিখেছেন। এ কারণে বড় ঝড়-বৃষ্টি তাঁদের দমিয়ে রাখতে পারে না; কিন্তু নদীর বাঁধ ভেঙে গেলে তাঁরা মনোবল হারিয়ে ফেলেন। কারণ এটি তাঁদের সর্বস্বান্ত করে দেয়, এটি মোকাবিলার শক্তিও তাঁদের নেই। টেকসই বাঁধ হলে বেশি জোয়ারে অন্তত নিজের ভিটায় ও নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র হলে প্রাকৃতিক দুর্যোগে চরের অবহেলিত মানুষগুলো মাথা গোঁজার ঠাঁই পাবেন। সেই নিশ্চয়তা পেলে এলাকা ছেড়ে অন্য কোথাও যাওয়ার প্রবণতা কমে যাবে।

স্থানীয় চেয়ারম্যান বাজারের ব্যবসায়ী আবদুল মালেক জানান, ‘এই চরের মানুষের জীবন জোয়ার-ভাটার ওপর নির্ভরশীল। এই চরের গ্রামগুলোর সঙ্গে সড়কপথের যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। বেড়িবাঁধ না থাকায় অধিক জোয়ারের সময় পানি বাড়লে নৌকা নিয়ে চলাচল করতে হয় তাঁদের। নদীর পানি বাড়ার আগেই রান্নার কাজ সারতে হয়। এই অঞ্চলে চলাচলের একমাত্র উপায় ট্রলার বা নৌকা। দুর্যোগে সৃষ্টিকর্তাই আমাদের একমাত্র ভরসা।’

স্থানীয় কৃষক মো. সুমন বলেন, ‘বেড়িবাঁধ না থাকায় লোকালয়ে জোয়ারের লবণাক্ত পানি প্রবেশ করে। এতে করে ফসলের ক্ষতি হয়। এমনকি বিষাক্ত সাপও মারা যায়। নদীর পানিতে লবণ বেশি, তাই এই চরে আমন ধান কিংবা উন্নত জাতের ধান, সয়াবিন বা অন্য ফসল খুব একটা হয় না। এ কারণে কৃষিতে আগ্রহ নেই তাঁদের। আমিও কয়েক বছর ধরে লোকসানে আছি। এভাবে এই পেশা ধরে রাখা সম্ভব হবে না। এ ছাড়া কৃষি অফিসের কোনো লোকের পরামর্শ কিংবা ভর্তুকিতে বীজ, সার, কৃষিপণ্য আমাদের ভাগে জোটে না। তাই এখানের বেশির ভাগ মানুষের প্রধান জীবিকা মাছ ধরা।’

চর গজারিয়া-তেলির চরে দায়িত্বপ্রাপ্ত ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি-সিপিপির চর আবদুল্লাহ ইউনিয়নের টিম লিডার জয়নাল আবদীন জানান, ‘নিরাপদ আশ্রয়ের তেমন কোনো ব্যবস্থা না থাকায় আমাদের অসহায়ের মতো চরে থাকতে হয়।’ তিনি বলেন, চরে বসবাসের যোগ্য আধাপাকা একটি গুচ্ছগ্রাম ভবন ও টিনশেড তিনটি বিদ্যালয় ভবন রয়েছে।

মাটির কিল্লা আগে যা ছিল, এখন তা ভেঙে গেছে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এস এম শান্তনু চৌধুরী বলেন, বিচ্ছিন্ন চরাঞ্চলে নিরাপদ কোনো আশ্রয়কেন্দ্র না থাকায় আপৎকালীন ট্রলারে করে লোকজনকে নিরাপদ আশ্রয়ে আনার ব্যবস্থা করা হয়। এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। 

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত