সরকারি বাসা বরাদ্দ নিয়ে ভাড়া

ইয়াহ্ইয়া মারুফ, সিলেট
প্রকাশ : ১৩ অক্টোবর ২০২২, ০৮: ২৬
আপডেট : ১৩ অক্টোবর ২০২২, ০৮: ৩৪

সিলেটে সরকারি কর্মচারীদের বাসা বরাদ্দ দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাপক অনিয়মের তথ্য মিলেছে। রাজস্ব খাতের কর্মচারীদের না দিয়ে মাস্টাররোল বা দৈনিক মজুরি ও ভাউচারের ভিত্তিতে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মচারীদের বাসা বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। অথচ ভাউচার ও দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মচারীদের বাসা বরাদ্দ দেওয়ার কোনো নিয়ম নেই।

সিলেট গণপূর্ত বিভাগের বাসা বরাদ্দ কমিটির সভাপতি ও সচিবের পছন্দমতো কর্মচারীরা বাসা বরাদ্দ পাচ্ছেন। ওই কর্মচারীদের কেউ কেউ আবার বরাদ্দ পাওয়া বাসায় নিজেরা না থেকে বাইরের লোকের কাছে ভাড়া দিয়ে টাকা কামাচ্ছেন। প্রকৌশলীদের পছন্দের এক ঠিকাদারও থাকছেন সরকারি বাসায়। ফলে বরাদ্দ পাওয়ার যোগ্য নিয়মিত কর্মচারীরা হচ্ছেন বঞ্চিত। এ নিয়ে ক্ষোভ বিরাজ করছে সিলেট গণপূর্ত বিভাগের কর্মচারীদের মধ্যে। তবে ভয়ে কেউ মুখ খুলতে চান না।

নগরের আম্বরখানায় সরকারি কলোনিসংলগ্ন দুই ইউনিটবিশিষ্ট গণপূর্ত বিভাগীয় শেড (দক্ষিণ অংশ) সিলেট গণপূর্ত বিভাগে কর্মরত অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর মো. আব্দুল মুবিনের নামে বরাদ্দ থাকলেও তিনি বাসাটি ভাড়া দিয়ে টাকা নিচ্ছেন প্রতি মাসে। ওই বাসায় গেলে সেখানে থাকা শিউলী বেগম জানান, তাঁর শ্বশুর নুরুল আমিন গণপূর্তের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। স্বামী ব্যাংকার। তাঁরা বেশ কয়েক মাস ধরে আছেন। তবে বাসাটি ভাড়া কি না তা তিনি জানেন না।

সরকারি বাসা ভাড়া দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বরাদ্দ পাওয়া আব্দুল মুবিন বলেন, ‘বাসায় এসি স্যারের ড্রাইভার নুরুল আমিন থাকেন। আমার ছেলে-মেয়ে এখনো ভর্তি করাইনি। ডিসেম্বরে বাসায় উঠে তাদের ভর্তি করাব। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘অনিয়ম নয়, আমাদের লোকই তো থাকছেন। তিনি অবসরে চলে যাবেন।’ তবে অনুসন্ধানে জানা যায়, গাড়িচালক নুরুল আমিন ২০১৭ সালে অবসরে চলে যান।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওসমানী মেডিকেল গণপূর্ত ওয়ার্কশেডে ৬৫ নম্বর বাসাটি গণপূর্ত উপ-বিভাগের বাবুর্চি ফয়েজ মিয়ার নামে বরাদ্দ। ফয়েজ মিয়া বাসায় থাকেন না।

তিনি বাইরের লোকের কাছে ভাড়া দিয়েছেন। ওই বাসায় সপরিবারে থাকছেন কাঠমিস্ত্রি আনোয়ার। আর ফয়েজ মিয়া থাকছেন গণপূর্ত বিভাগের রেস্ট হাউসে। এ ছাড়া
নিয়ম ভেঙে বাসা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে মাস্টাররোল বা দৈনিক মজুরি ও ভাউচারভিত্তিক এবং আউটসোর্সিংয়ে কর্মরত বেশ কয়েকজন কর্মচারীকে। তবে বরাদ্দ ছাড়াই ৬৬ (ক) নম্বর বাসায় থাকছেন ভাউচারভিত্তিক কর্মচারী হাসান। অথচ ভাউচারভিত্তিক কর্মচারীকে সরকারি বাসা বরাদ্দ দেওয়ারই সুযোগ নেই।

‘কারও ভাই, খালা-মামারা আছে’ এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বাসা বরাদ্দ কমিটির সদস্যসচিব ও সিলেট গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী রিপন কুমার রায় আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা নিয়ম অনুযায়ীই বরাদ্দ দিই। আগে এ রকম হতো, এখন এসব বন্ধ। আর সরেজমিনে গেলে দেখা যায়, কারও পরিবার, কারও ভাই, খালা-মামারা আছে।’

সিলেট গণপূর্ত বিভাগীয় বাসা বরাদ্দ কমিটির সভাপতি ও তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ওসমান গনি আজকের পত্রিকার পরিচয় জানার পরই মিটিংয়ে থাকার কথা বলে ফোন সংযোগ কেটে দেন। পরে আরও কয়েকবার ফোন দিলেও তিনি তা রিসিভ করেননি।

ভাউচারভিত্তিক আরেক কর্মচারী মো. জাকির হোসেন বরাদ্দ পেয়েছেন সিলেট গণপূর্ত উপবিভাগ নং-৩ সংলগ্ন বিভাগীয় ওর্য়াকশেডে ৮৩ নম্বর বাসা। একই স্থানে ৬৩ নম্বর বাসাটি বরাদ্দ পেয়েছেন দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে সিলেট গণপূর্ত জোনে কর্মরত মো. শাহাব উদ্দিন। এ ছাড়া ওসমানী মেডিকেল গণপূর্ত ওয়ার্কশেডে ৬৭ নম্বর বাসা বরাদ্দ সেনেটারি মিস্ত্রি খোকনের নামে। ৬৬ নম্বর বাসা অডিটর নিশি বাবুর নামে। ৬৫ নম্বর বাসা চৌকিদার লোকমানের নামে। ৮১ নম্বর বাসা পাম্পচালক আকবরের নামে। ৭৯ নম্বর বাসা চৌকিদার আব্দুস সত্তারের নামে। ৭৮ নম্বর বাসা কাঠমিস্ত্রির সহকারী সেলিমের নামে। জেনারেটর চালক ময়না মিয়ার নামে বরাদ্দ ৮৩ নম্বর বাসা। কিন্তু এসব বাসায় গিয়ে বরাদ্দপ্রাপ্ত কাউকে পাওয়া যায়নি। জানা যায়, তাঁরা অন্যদের কাছে বাসা ভাড়া দিয়েছেন।

অভিযোগ আছে, ৬৩ নম্বর বাসাটি বরাদ্দ পেতে আবেদন করেছিলেন গণপূর্ত উপবিভাগ-৩-এর নিয়মিত গার্ড মো. রহমান আলী ও নিয়মিত কর্মচারী (পাম্প-সহকারী) মো. তফাজ্জুল হোসেন। কিন্তু তাঁরা বরাদ্দ পাননি। অন্যদিকে সিলেট গণপূর্ত বিভাগীয় বাসা বরাদ্দ কমিটির সভাপতির গাড়িচালক আউটসোর্সিংয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত মো. সুজন নিয়মবহির্ভূতভাবে বসবাস করছেন নগরের তোপখানায় গণপূর্ত বিভাগীয় ওয়ার্কশেডে।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে সিলেট গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী রিপন কুমার রায় বলেন, ‘এসব মিথ্যা কথা। উপযুক্তদের বাসা বরাদ্দ দেওয়া হয়।’ 

সরকারি বাসায় ঠিকাদার অনুসন্ধানে জানা যায়, সিলেট নগরের বাগবাড়িতে গণপূর্ত বিভাগের দোতলা ভবনে পরিবার নিয়ে থাকেন এক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান লুবনা এন্টারপ্রাইজের রিপন মিয়া। তিনি গণপূর্তের প্রকৌশলীদের অতি আস্থাভাজন। পরিচয় গোপন রেখে গত সোমবার ওই বাসায় গেলে রিপনের ভাই জানান, রিপন কিছুক্ষণ আগে বাসায় এসেছেন। এরপর রিপন বেরিয়ে আসেন। একটি ভবনের কাজ করানোর কথা বললে তিনি বলেন, বেসরকারি কোনো কাজ তিনি করেন না। সরকারি ঠিকাদার, তাই শুধু সরকারি কাজ করেন। পরে মঙ্গলবার রিপন মিয়াকে ফোন করে জানতে চাওয়া হয়, সরকারি বাসায় কীভাবে থাকছেন তিনি? জবাবে রিপন বলেন, ‘গণপূর্তের অ্যাকাউনটেন্ট অমিতাভ দত্তের নামে বরাদ্দ নেওয়া এই বাসা। কেয়ারটেকার (তত্ত্বাবধায়ক) হিসেবে থাকছি। বাসায় ওনার মালামালও আছে। দুই-তিন মাস পরে চলে যাব।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত