রোজা থাকলে ক্যানসার কোষ ধ্বংস হয়— জাপানি বিজ্ঞানীর নামে ভুল প্রচার

ফ্যাক্টচেক ডেস্ক
আপডেট : ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৫: ২৭
Thumbnail image

জীবদেহে ‘অটোফেজি’ প্রক্রিয়া নিয়ে গবেষণা করে ২০১৬ সালে চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান জাপানের গবেষক ইয়োশিনোরি ওহশোমি। সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় কিছু অ্যাকাউন্ট ও পেজ থেকে একটি পোস্ট ভাইরাল হয়েছে যে, ১২–২৪ ঘণ্টা রোজা রাখলে মানুষের দেহে ‘অটোফেজি’ চালু হয়। এটি ইয়োশিনোরি ওহশোমি আবিষ্কার করেছেন। তিনি এটিও প্রমাণ করেছেন যে, রোজা রাখার মাধ্যমে মানুষের বেশ কিছু উপকার হয়। এর মধ্যে অন্যতম হলো, ক্যানসার কোষ ধ্বংস হওয়া।

রোজা রাখলে সত্যিই কি মানবদেহে ‘অটোফেজি’ প্রক্রিয়া শুরু হয়? জাপানি গবেষক ইয়োশিনোরি ওহশোমি কি প্রমাণ করেছেন যে, রোজা থাকলে ক্যানসার কোষ ধ্বংস হয়?

রোজার মাধ্যমে ধ্বংস হয় ক্যানসার কোষ দাবিতে ভাইরাল পোস্ট।এসব প্রশ্নের উত্তর জানার আগে জেনে নিই ‘অটোফেজি’ প্রক্রিয়া কী? 
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ক্যানসার ইনস্টিটিউটের ওয়েবসাইট থেকে ‘অটোফেজি’ সম্পর্কে জানা যায়। এতে অটোফেজি সম্পর্কে বলা হয়েছে, এটি এমন এক প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে একটি কোষ ভেঙে যায় এবং কোষের সাইটোপ্লাজমের (কোষের ভেতরের তরল) পুরোনো, ক্ষতিগ্রস্ত বা অস্বাভাবিক প্রোটিন এবং অন্যান্য পদার্থ ধ্বংস হয়। ভেঙে যাওয়া কোষণের এসব উপাদান চাপ এবং উপবাস বা ক্ষুধার সময় গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য পুনর্ব্যবহার করে মানুষের দেহ।

অটোফেজি সংক্রামক ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাস ধ্বংস করতেও সাহায্য করে এবং সুস্থ কোষকে ক্যানসার কোষে পরিণত হতে বাধা দিতে পারে। একবার ক্যানসার আক্রান্ত হলে, অটোফেজি ক্যানসার প্রতিরোধক ওষুধ বা অন্যান্য উপাদানকে ধ্বংস করা থেকে রক্ষা করে। অটোফেজি ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া এবং ক্যানসার কোষের বিরুদ্ধে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকেও প্রভাবিত করতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনে প্রকাশিত এক গবেষণা সূত্রে জানা যায়, ‘অটোফেজি’ শব্দটি দুটি গ্রিক শব্দ auto এবং phagy থেকে উদ্ভূত। এর অর্থ নিজেই নিজেকে খেয়ে ফেলা। এটি জীবদেহের হোমিওস্ট্যাসিস বা জীবের বেঁচে থাকা এবং সঠিকভাবে কাজ করার জন্য শরীরের প্রয়োজনীয় সমস্ত ব্যবস্থার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে। যখন শরীরের এই ভারসাম্য নষ্ট হয়, তখন দেহে নানা সমস্যা তৈরি হতে পারে। এটি জীবদেহ ‘পরিষ্কারকের’ কাজ করে। অর্থাৎ অনাকাঙ্ক্ষিত প্রোটিন, মাইটোকন্ড্রিয়া বা এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলামের মতো কোষের বিচ্ছিন্ন অংশ এবং এমনকি ক্ষতিকারক জীবাণুর মতো অনুপ্রবেশকারীকে জীবদেহ থেকে বহিষ্কার করে। 

সর্বোপরি অটোফেজি হলো একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া, যেখানে শরীরের কোষগুলো ক্ষতিগ্রস্ত বা অপ্রয়োজনীয় উপাদানগুলোকে পরিষ্কার করে এবং শারীরবৃত্তীয় কর্মকাণ্ডগুলো মসৃণভাবে চলতে সাহায্য করে।

রোজা থাকলে ‘অটোফেজি’ প্রক্রিয়া চালু হয়?
এই প্রশ্নের উত্তরের খোঁজে স্বাস্থ্য বিষয়ক ওয়েবসাইট হেলথ লাইনে অটোফেজি নিয়ে প্রকাশিত এক নিবন্ধ সূত্রে জানা যায়, অটোফেজি মানবদেহে ক্রমাগত ঘটতে থাকে। যদিও মানুষ শারীরিকভাবে অটোফেজি প্রক্রিয়া অনুভব করতে পারেন না। তবে দেহে প্রক্রিয়াটি উদ্দীপিত করার বিভিন্ন উপায় রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, রোজা রাখা, ব্যায়াম করা বা ক্যালোরি গ্রহণ সীমিত করা। এর বাইরে কম শর্করা গ্রহণ, উচ্চ চর্বিযুক্ত কিটোজেনিক ডায়েট অটোফেজিকে উদ্দীপিত করতে পারে।

একই তথ্য জানা যায় স্বাস্থ্য বিষয়ক ম্যাগাজিন মেডিকেল নিউজ টুডেতে প্রকাশিত এক নিবন্ধ থেকেও। নিবন্ধটিতে বলা হয়, জীবদেহে অটোফেজি প্রাকৃতিকভাবেই ঘটতে থাকে। তবে নির্দিষ্ট কিছু প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অটোফেজিকে উদ্দীপিত করা যায়। এর মধ্যে সম্ভাব্য একটি উদ্দীপক উপবাস। কেউ যখন উপবাস করে, তখন ওই ব্যক্তি স্বেচ্ছায় কয়েক ঘণ্টা বা একদিন বা তারও বেশি সময় খাবার গ্রহণ থেকে বিরত থাকেন।

উপবাস প্রচলতি ক্যালোরি গ্রহণ কমিয়ে আনা থেকে ভিন্ন। যখন একজন ব্যক্তি তাঁর ক্যালোরি গ্রহণ সীমিত করেন, তখন তিনি নিয়মিত খাবার গ্রহণ কমিয়ে দেন। তবে বিদ্যমান গবেষণা দৃঢ়ভাবে পরামর্শ দেয় যে, উপবাস এবং ক্যালোরি সীমিত করা উভয়ই অটোফেজিকে উদ্দীপিত করতে পারে।

রোজা বা উপবাসের মাধ্যমেই মানবদেহে অটোফেজি প্রক্রিয়া চালু হয়, ব্যাপারটি এমন নয়।অর্থাৎ রোজা বা উপবাসের মাধ্যমেই মানবদেহে অটোফেজি প্রক্রিয়া চালু হয়, ব্যাপারটি এমন নয়। বরং এটি প্রাকৃতিকভাবেই মানবদেহে চলতে থাকে এবং রোজা বা উপবাসের মাধ্যমে এই প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা যায় মাত্র।

রোজা থাকলে ক্যানসার কোষ ধ্বংস হয়—ইয়োশিনোরি ওহশোমি এটি প্রমাণ করেছেন? 
নোবেল বিজয়ী জাপানি বিজ্ঞানী ইয়োশিনোরি ওহশোমি টোকিও ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে কর্মরত। বার্তা সংস্থা এএফপি সূত্রে জানা যায়, ইয়োশিনোরি ওহশোমিকে উদ্ধৃত করে রোজা থাকলে ক্যানসার কোষ ধ্বংস হয়— এমন দাবি দীর্ঘদিন ধরেই বিভিন্ন ভাষায় প্রচারিত হয়ে আসছে। ২০২২ সালের অক্টোবরে দাবিটি ফরাসি ভাষায় ছড়িয়ে পড়লে এএফপি একটি ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করে জানায়, অন্তত ২০১৮ সাল থেকে ইন্টারনেটে দাবিটির অস্তিত্ব পাওয়া যায়।

ওই সময় দাবি করা হয়, ইয়োশিনোরি ওহশোমি গবেষণায় দেখিয়েছেন, উপবাসের মাধ্যমে ক্যানসার ও আলঝেইমার (স্মৃতিভ্রংশ রোগ) প্রতিরোধ করা যায়। একই বছরের ডিসেম্বরেও দাবিটি ভারত, নেপাল, মালয়েশিয়া এবং থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে ইংরেজি ভাষায় ছড়িয়ে পড়ে। ওই সময় কেবল ইয়োশিনোরি ওহশোমিকে উদ্ধৃত করে ‘উপবাসের মাধ্যমে ক্যানসার প্রতিরোধ করা যায়’ এমন দাবি করা হয়।

দাবিটির সত্যতা যাচাইয়ে এএফপি জানায়, ইয়োশিনোরি ওহশোমির এমন কোনো গবেষণা সম্পর্কে জানা যায় না। পরে বার্তা সংস্থাটি ইয়োশিনোরি ওহশোমির কর্মস্থল টোকিও ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির জনসংযোগ বিভাগে যোগাযোগ করে। প্রতিষ্ঠানটি এএফপিকে ওই বছরের ৭ অক্টোবর জানায়, উপবাসের মাধ্যমে ক্যানসার ও আলঝেইমার প্রতিরোধ করা সম্ভব, এমন কোনো মন্তব্য ইয়োশিনোরি ওহশোমি করেননি, এটি মিথ্যা।

উপবাস ক্যানসার রোগীদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ
উপবাসে ক্যানসার রোগীদের কোনো উপকার আছে কি না তা জানতে এএফপি বিভিন্ন বিশেষজ্ঞের মতামত নেয়। তাঁদের একজন ফ্রান্সের ন্যাশনাল সেন্টার ফর সায়েন্টিফিক রিসার্চের অটোফেজি এবং সংক্রামক রোগ গবেষক লুসিল এসপার্ট এএফপিকে বলেন, সময় সময় উপবাস করা জীবদেহের কোনো ক্ষতি করে না এবং সম্ভবত এটি অটোফেজিকে প্রভাবিত করে। তবে উপবাস রোগ নিরাময় করে এমন ভাবাটা বিপজ্জনক।

বেলজিয়ামের ক্যাথলিক ইউনিভার্সিটি অব লুভেনের অধ্যাপক এবং এক্সপেরিমেন্টাল ক্যানসার গবেষণা বিশেষজ্ঞ পিয়েরে সোনভেউক্স একই বিষয়ে এএফপিকে বলেন, ক্যানসার রোগীদের খাদ্যাভ্যাসে ঘন ঘন পরিবর্তন আনা উচিত নয়। যদি খাদ্য পরিবর্তন করতেই হয়, তবে অবশ্যই চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলতে হবে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, সংবাদমাধ্যম বা যেকোনো মাধ্যমে প্রচারিত কোনো ছবি, ভিডিও বা তথ্য বিভ্রান্তিকর মনে হলে তার স্ক্রিনশট বা লিংক কিংবা সে সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য আমাদের ই-মেইল করুন। আমাদের ই-মেইল ঠিকানা [email protected]
Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত