জহির রায়হান গুম হয়নি, বাড়ি থেকে পালিয়েছে—বঙ্গবন্ধুর নামে গুজব

ফ্যাক্টচেক ডেস্ক
আপডেট : ১৪ আগস্ট ২০২৪, ১৮: ০৭
Thumbnail image

বাংলাদেশের ক্ষণজন্মা চলচ্চিত্র নির্মাতা ও কথাসাহিত্যিক জহির রায়হানের নিখোঁজ হওয়া নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তব্য দাবি করে দৈনিক ইত্তেফাকের একটি পেপার কাটিংয়ের ছবি  সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। সেখানে দাবি করা হচ্ছে, জহির রায়হানের নিখোঁজের ঘটনায় ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, ‘জহির রায়হান গুম হয়নি, বাড়ি থেকে পালিয়েছে।’

দাবিটির সত্যতা যাচাইয়ে পুরোনো পত্রিকার অনলাইন সংগ্রহশালা সংগ্রামের নোটবুকের সহায়তা নেওয়া হয়। সংগ্রামের নোটবুক থেকে জানা যাচ্ছে, দৈনিক ইত্তেফাকের ভাইরাল সংস্করণের ছবিটি ১৯৭১ সালের ১৮ মার্চের। ওই দিনের প্রকাশিত ইত্তেফাক পত্রিকার সঙ্গে সম্প্রতি ভাইরাল পত্রিকার কাটিংটির মিল রয়েছে। মিলগুলো হলো—

  • ভাইরাল মূল প্রতিবেদনটির নিচে ‘জাহান্নামে বসিয়াও হাসিতে পারি’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন দেখা যাচ্ছে।
  •  ডানে আরেকটি প্রতিবেদনের শিরোনামে থাকা ‘প্রেসিডেন্ট’ লেখা দেখা যাচ্ছে। পুরো শিরোনামটি স্পষ্ট নয়। 
  • তার পাশেই ‘কেন্দ্রীয় কর স্থানীয় ব্যাংকে জমা...’ শীর্ষক একটি সংবাদ শিরোনাম দেখা যাচ্ছে। 
  •  নিচে বাঁদিকের কর্নারে ‘জন্মদিনে–’ লেখা দেখা যাচ্ছে। 
  • ডানে পত্রিকার নামের সঙ্গে ‘ইউপেপসিন’ নামের একটি পণ্যের বিজ্ঞাপন দেখা যাচ্ছে।

জহির রায়হানের নিখোঁজ হওয়া নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথিত ভাইরাল মন্তব্যটি এডিটেড। ছবি: আজকের পত্রিকার ফ্যাক্টচেকের বিশ্লেষণএই মিলগুলো থেকে স্পষ্ট যে জহির রায়হানকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর উক্তি দাবিতে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া পত্রিকার কাটিং এবং সংগ্রামের নোটবুকের আর্কাইভে পাওয়া পত্রিকার সংস্করণ দুটি একই। ওই দিন ইত্তেফাকের মূল প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, ‘ইয়াহিয়া–মুজিব ২য় দফা বৈঠক, লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত থাকিবে—শেখ মুজিব।’ মূল প্রতিবেদনের এই শিরোনাম এডিট করে জহির রায়হানের নিখোঁজ হওয়া নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথিত ভাইরাল মন্তব্যটি যুক্ত করা হয়েছে। 

বিডিনিউজ২৪–এ প্রকাশিত সহুল আহমদের এক নিবন্ধের বরাতে জানা যায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর নিখোঁজ অগ্রজ শহীদুল্লা কায়সারকে খুঁজতে গিয়েছিলেন জহির রায়হান। ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি সকালে টেলিফোনে কেউ তাকে জানিয়েছিল, মিরপুরের ১২ নম্বরে বিহারি পল্লিতে শহীদুল্লা কায়সারসহ আরও অনেক বুদ্ধিজীবীকে বন্দী করে রাখা হয়েছে। কিন্তু সেটি ছিল ফাঁদ। সেখানে গিয়ে তিনি আর ফিরে আসেননি। 

মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী মিরপুরের ১২ নম্বরের প্রায় ২০ হাজার বিহারিকে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিয়ে ‘সিভিল আর্মড ফোর্সেস’ (সিএএফ) নামে নতুন বাহিনী গড়ে তুলেছিল। ১৬ ডিসেম্বরে পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পন করলেও এই সিএএফের সদস্যরা আত্মসমর্পণ করেনি। বরং এসব বিহারি, আলবদর অস্ত্রশস্ত্রসহ আশ্রয় নিয়েছিল মিরপুরে। অর্থাৎ বাংলাদেশ ১৬ ডিসেম্বর হানাদার মুক্ত হলেও মিরপুর তখনো অবাঙালি, আলবদর ও রাজাকারদের দখলে ছিল।

৩০ জানুয়ারি ওই এলাকায় বুদ্ধিজীবীদের সন্ধানে সেনাবাহিনীর তল্লাশি অভিযানের সঙ্গী হন জহির রায়হান। সেনাবাহিনী সিভিলিয়ান সঙ্গে রাখতে চায়নি। অনেক অনুরোধের পর জহির রায়হানকে নিতে রাজি হয়েছিল। আনুমানিক বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বিহারিরা আশপাশের বাড়িঘর থেকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রশস্ত্রসহ হ্যান্ড গ্রেনেড নিয়ে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। কেউ এই হামলার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না, তাই পাল্টা আক্রমণের কোনো সুযোগ পাননি তাঁরা। 

বিহারিদের অতর্কিত হামলায় সেদিন ৪২ জন সেনাসদস্য নিহত হন। ক্যাপ্টেন মোর্শেদ ও নায়েক আমিরসহ কয়েকজন আহত হন। নিহতদের তিন-চারজন ছাড়া আর কারও লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি। এমনকি মিরপুর পুরো জনশূন্য করার পরও। খুব সম্ভব ৩০ জানুয়ারি রাতেই সেগুলো সরিয়ে ফেলা হয়। রাতের অন্ধকারে বিহারিদের সরিয়ে ফেলা সেই লাশগুলোর সঙ্গে বড়দাকে খুঁজতে গিয়ে হারিয়ে যান জহির রায়হান।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, সংবাদমাধ্যম বা যেকোনো মাধ্যমে প্রচারিত কোনো ছবি, ভিডিও বা তথ্য বিভ্রান্তিকর মনে হলে তার স্ক্রিনশট বা লিংক কিংবা সে সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য আমাদের ই-মেইল করুন। আমাদের ই-মেইল ঠিকানা [email protected]
Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত