Ajker Patrika

ডেঙ্গু জ্বর: লক্ষণ জেনে চিকিৎসা করান

দেবলীনা ভৌমিক
ডেঙ্গু জ্বর: লক্ষণ জেনে চিকিৎসা করান

ডেঙ্গু জ্বর এডিস মশাবাহিত ভাইরাসজনিত একটি রোগ। দিন দিন বাড়ছে এতে আক্রান্তের সংখ্যা। তুলনামূলকভাবে ঢাকায় এর প্রকোপ বেশি হলেও দেশের অন্যান্য জায়গায়ও ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে।

ডেঙ্গু জ্বরের কারণ
প্রধানত প্রাক্‌-গ্রীষ্ম ও বর্ষার সময় এই রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পায়। ১৯৬০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ডেঙ্গু জ্বরের তীব্রতা ৩০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বৃদ্ধির কারণ হিসেবে নির্বিচারে নগরায়ণ, জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং বৈশ্বিক উষ্ণায়নসহ পরিবেশ বিপর্যয়ের কথা বলা হয়। এখন থেমে থেমে বৃষ্টি হওয়ার কারণে এডিস মশার ঘনত্ব বেড়ে গেছে। এডিস মশার কামড়ের মাধ্যমে ভাইরাস সংক্রমণের সাধারণত ৪ থেকে ৭ দিনের মধ্যে ডেঙ্গু জ্বরের উপসর্গ দেখা দেয়।

সম্প্রতি কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবিরুল বাশারের গবেষণায় দেখা গেছে, এডিস মশার চরিত্রে বেশ বদল এসেছে। এই মশা রাতের বেলা, বিশেষ করে ভোরের দিকেও কামড়ায় এবং ময়লা এমনকি নোনাপানিতেও ডিম পাড়ে।

ডেঙ্গু জ্বরের চিকিৎসা
বেশির ভাগ রোগী কোনো স্থায়ী সমস্যা ছাড়াই ডেঙ্গু জ্বর থেকে ভালো হয়। এতে মৃত্যুর হার চিকিৎসা ছাড়া ১ থেকে ৫ শতাংশ এবং পর্যাপ্ত চিকিৎসায় ১ শতাংশের কম। তবে রোগের চরম পর্যায়ে মৃত্যুহার ২৬ শতাংশ। ডেঙ্গু ভাইরাসের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট  চিকিৎসা এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি। যেহেতু বর্তমানে ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ বেশি, তাই জ্বর হলে সময় নষ্ট না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ডেঙ্গু ভাইরাস টেস্ট করান। সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে স্বল্প খরচে এই টেস্ট করানোর ব্যবস্থা আছে। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীকে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী বাড়িতে চিকিৎসা নিতে হবে অথবা হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে।

ডেঙ্গু জ্বরের রোগীদের চিকিৎসার জন্য এ, বি ও সি এই তিন ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়। ‘এ’ ক্যাটাগরির রোগীরা স্বাভাবিক থাকে। অধিকাংশ ডেঙ্গু রোগী ‘এ’ ক্যাটাগরির। তাদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। বাড়িতে বিশ্রাম নেওয়াই যথেষ্ট। 

ডেঙ্গু জ্বরের উপসর্গ

  • উচ্চ তাপমাত্রায় জ্বর। তাপমাত্রা ১০২ থেকে ১০৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত হতে পারে।
  • তীব্র মাথাব্যথা।
  • চোখের পেছনে ব্যথার অনুভূতি।
  • মাংসপেশি ও অস্থিসন্ধিতে ব্যথা।
  • বমির ভাব।
  • মাথা ঘোরা।
  • গ্রন্থি ফুলে যাওয়া।
  • ত্বকের বিভিন্ন স্থানে ফুসকুড়ি ওঠা।

সাধারণত ২ থেকে ৭ দিন পর্যন্ত এই উপসর্গগুলো স্থায়ী হতে পারে। এই পর্যায়ের রোগীরা মুখে পর্যাপ্ত পরিমাণে তরল খাবার খেতে পারে এবং তাদের ক্ষেত্রে প্রতি ৬ ঘণ্টায় কমপক্ষে একবার প্রস্রাব হওয়া স্বাভাবিক বলে ধরে নিতে হবে। দ্বিতীয়বার ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে রোগের ভয়াবহতা বৃদ্ধি পায়। 

ডেঙ্গু জ্বরে তাপমাত্রা হতে পারে ১০২ থেকে ১০৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট। বাড়িতে কী করবেন

  • পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হবে।
  • প্রচুর তরলজাতীয় খাবার খেতে হবে। ঘন ঘন ডাবের পানি, লেবুর শরবত, ফলের রস এবং খাওয়ার স্যালাইন খেতে হবে।
  • রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য প্রোটিনজাতীয় খাবার বেশি করে খাদ্যতালিকায় রাখতে হবে।
  • ডেঙ্গু জ্বরে প্যারাসিটামল-জাতীয় ওষুধ খাওয়া যাবে। স্বাভাবিক ওজনের প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি প্রতিদিন সর্বোচ্চ ৮টি প্যারাসিটামল খেতে পারবেন। কিন্তু কোনো ব্যক্তির যদি লিভার, হার্ট ও কিডনি-সংক্রান্ত জটিলতা থাকে, তাহলে প্যারাসিটামল সেবনের আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
  • রোগীকে মশারির ভেতর থাকতে হবে।
  • ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে অ্যাসপিরিন, ক্লোরোফেনাক, আইবুপ্রোফেন-জাতীয় ওষুধ খাওয়া যাবে না।

ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত ‘বি’ ক্যাটাগরির রোগীদের ক্ষেত্রে কিছু বিপজ্জনক লক্ষণ দেখা দিতে পারে। সে রকম যেকোনো একটি লক্ষণ দেখা দিলে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে। নইলে রোগীর ডেঙ্গু শক সিনড্রোম হওয়ার আশঙ্কা বেশি হবে।

বিপজ্জনক লক্ষণ

  • প্রচণ্ড পেটব্যথা।
  • ক্রমাগত বমি হওয়া।
  • মাড়ি বা নাক দিয়ে রক্তপাত হওয়া।
  • প্রস্রাব ও মলের সঙ্গে রক্তপাত হওয়া।
  • নারীদের ক্ষেত্রে মাসিকের সময় স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি রক্ত যাওয়া।
  • ত্বকের নিচে রক্তক্ষরণ হওয়া।
  • ক্লান্তিবোধ করা।
  • রোগীর বিরক্তি ও অস্থিরতা প্রকাশ করা।
  • প্রস্রাব কমে যাওয়া।
  • হাত-পা ফ্যাকাশে ও ঠান্ডা হয়ে যাওয়া।

বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ, এক বছরের কম বয়সী শিশু এবং অন্তঃসত্ত্বা নারীরা যেকোনো সময় ‘বি’ ক্যাটাগরির রোগী হয়ে যেতে পারেন কোনো লক্ষণ না থাকলেও। এ ছাড়া স্থূলতা, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, রক্ত-সম্পর্কিত রোগ, কিডনি বা লিভারের সমস্যা যাঁদের আছে, সেই সব ডেঙ্গু রোগীকে হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা করাতে হবে।

‘সি’ ক্যাটাগরির রোগীর অবস্থা সবচেয়ে খারাপ হয়ে থাকে। শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, যেমন লিভার, কিডনি, মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। রোগীর শ্বাসকষ্ট হতে পারে। সে জন্য ‘বি’ ও ‘সি’ ক্যাটাগরির রোগীদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে।

প্রতিরোধ

  • মূলত এডিস মশার কামড় এড়িয়ে চলাই ডেঙ্গু প্রতিরোধের প্রধান উপায়। তাই মশার আবাসস্থল ধ্বংস করে এর বংশবিস্তার প্রতিরোধ করতে হবে।
  • ব্যবহৃত পাত্রের গায়ে লেগে থাকা মশার ডিম ধ্বংসে পাত্রটি ব্লিচিং পাউডার দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে।
  • কোনো কিছুতে পানি জমতে দেওয়া যাবে না।
  • শরীরের বেশির ভাগ অংশ ঢেকে রাখে এমন পোশাক পরতে হবে।
  • রাতে শোয়ার সময় মশারি ব্যবহার করতে হবে। 

এই সময়ে উচ্চ তাপমাত্রার জ্বর হলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। অবহেলায় এই রোগ মারাত্মক হতে পারে। 

দেবলীনা ভৌমিক, সহকারী অধ্যাপক (মাইক্রোবায়োলজি) জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর), ঢাকা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত