রেড ওয়াইন নিয়ে হাজার বছরের রহস্য উদ্‌ঘাটন করলেন বিজ্ঞানীরা

অনলাইন ডেস্ক
Thumbnail image

গ্রিক দার্শনিক সেলসাসের মতে, মানুষের অন্তহীন দুর্দশার একটাই সমাধান, তা হলো—ওয়াইন! চিকিৎসকেরা বলেন, ক্লান্তি, জ্বর, কাশি বা কোষ্ঠকাঠিন্যের তো সমস্যা সারিয়ে তুলতে দারুণ কাজে দেয় ওয়াইন। এত এত গুণ থাকা সত্ত্বেও ওয়াইন সেবন ডেকে আনতে পারে জঘন্য মাথাব্যথা।

ওয়াইন পানে, বিশেষ করে, রেড ওয়াইন পানে মাথাব্যথা হওয়ার কারণ চিহ্নিত করা গেছে নতুন এক গবেষণায়। গবেষকেরা বলছেন, মানুষের যকৃৎ যখন বিশেষ একটি উপাদান সংশ্লেষ করে তখন এই ধরনের সমস্যা হয়। অ্যালকোহল আসক্তি দূর করতে এক ধরনের ওষুধ দেওয়া হয়। এই ওষুধ সেবনে মদ পানের পর যে অস্বস্তিকর অনুভূতি হয়, সংশ্লেষকৃত উপাদানটিও একই ধরনের অনুভূতি তৈরি করে।

যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকোর ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার হেডেক সেন্টারের পরিচালক মরিস লেভিন বলেন, ‘আমাদের ধারণা, অবশেষে আমরা হাজার বছরের পুরোনো রহস্য উদ্‌ঘাটনের সঠিক পথে আছি। পরবর্তী পদক্ষেপ হলো, এ ধরনের মাথাব্যথা যাদের মধ্যে দেখা যায়, তাদের ওপর এটি পরীক্ষা করে দেখা।’

রেড ওয়াইনের কারণে মাথাব্যথা হ্যাংওভারের চেয়ে ভিন্ন। রাতে মদ পান করলে পরদিন সকালে ঝিম ধরে থাকার মতো অবস্থা তৈরি হতে পারে— একে হ্যাংওভার বলা হয়। ছোট এক থেকে দুই গ্লাস রেড ওয়াইন পানের আধা ঘণ্টা পরই মাথাব্যথা শুরু হতে পারে।

মাথাব্যথার এ কারণ উদ্‌ঘাটনের জন্য সেলসাসের সময় থেকেই গবেষকেরা রেড ওয়াইনের সব ধরনের উপাদান নিয়ে পরীক্ষা চালিয়ে আসছেন। সন্দেহের তালিকায় ছিল— ট্যানিন, সালফাইট যৌগ, ফেনোলিক ফ্ল্যাভনয়েড ও বায়োজেনিক অ্যামাইন যৌগ। তবে এগুলোর কোনোটিই মাথাব্যথার মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়নি।

গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, মাথাব্যথার মূল কারণ রেড ওয়াইনে থাকা ফেনোলিক ফ্ল্যাভনয়েড যৌগ। আঙুরের বীজ ও খোসাতে এ উপাদান পাওয়া যায়। এটিই রেড ওয়াইনের রং, স্বাদ এবং মুখে বিশেষ অনুভূতি তৈরির জন্য দায়ী। সাদা ওয়াইনের চেয়ে রেড ওয়াইনে ফ্ল্যাভনয়েডের পরিমাণ ১০ গুণ বেশি থাকতে পারে। ফলে রেড ওয়াইন তাৎক্ষণিক মাথাব্যথার কারণ হতে পারে।
   
মদপান করলে অ্যালকোহল দুই ধাপে পরিপাক হয়ে অ্যাসিটেটে রূপান্তরিত হয়। প্রথম ধাপে অ্যালকোহলকে ইথানল থেকে অ্যাসিটালডিহাইডে পরিণত হয়। দ্বিতীয় ধাপে ওই অ্যাসিটালডিহাইড অ্যাসিটেটে পরিণত হয়। যকৃৎ থেকে নিঃসৃত নির্দিষ্ট কিছু এনজাইম এ পুরো প্রক্রিয়া ভূমিকা রাখে।

ক্যালিফোর্নিয়ার ড্যাভিসে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ায় আঙ্গুরচাষ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক অ্যান্ড্রু ওয়াটারহাউসসহ গবেষকেরা রেড ওয়াইনের ১২টিরও বেশি উপাদান নিয়ে পরীক্ষা চালান। এর মধ্যে কুয়েরসেটিন নামে একটি ফ্ল্যাভানল যৌগ তাঁরা শনাক্ত করেন, যেটি সাধারণত শুধু রেড ওয়াইনেই পাওয়া যায়। কুয়েরসেটিন ফ্ল্যাভানল যৌগটি শরীরে প্রক্রিয়াজাত হয়ে বিভিন্ন পদার্থ তৈরি হয়। এর মধ্যে একটি হলো কুয়েরসেটিন গ্লুকুরোনাইড। এটি অ্যাসিটালডিহাইডকে অ্যাসিটেটে রূপান্তরিত করা এনজাইম নিঃসৃত হতে বাধা দেয়।

এতেই মাথাব্যথার রহস্য লুকিয়ে আছে বলে দাবি গবেষকদের। গুরুত্বপূর্ণ এ এনজাইম নিঃসরণে বাধাপ্রাপ্ত হওয়ায় রক্তে বিষাক্ত অ্যাসিটালডিহাইডের পরিমাণ বেড়ে যায়। এর উচ্চ মাত্রার ফলে মাথাব্যথা, বমিভাব, মুখ লাল হয়ে যাওয়া ও ঘাম হতে পারে।

অ্যালকোহলে আসক্তদের চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত ডিসালফিরাম ওষুধও একই এনজাইমের নিঃসরণে বাধা দেয়। এ ওষুধ সেবনের ফলে মদে আসক্ত ব্যক্তি মদপান করলে একই লক্ষণ দেখা দেয়।

গবেষকদের মতে, সংবেদনশীল ব্যক্তিরা কম পরিমাণে রেড ওয়াইন পান করলেও মাথাব্যথার মতো উপসর্গ দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে তাঁদের যদি মাইগ্রেনের সমস্যা থেকে থাকে। রেড ওয়াইনের প্রতি কেন কিছু ব্যক্তি বেশি প্রতিক্রিয়া দেখায় এর কারণ অবশ্য এখনো অস্পষ্ট। গবেষকদের ধারণা, এ ধরনের মানুষের ওই বিশেষ এনজাইম সহজে বাধাপ্রাপ্ত হয় বা তাঁরা হয়তো বিষাক্ত অ্যাসিটালডিহাইডের প্রতি বেশি সংবেদনশীল।

গবেষক দলটি এখন এই অনুমানটিকে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণের জন্য পরীক্ষা চালানোর পরিকল্পনা করছে। বিভিন্ন মাত্রার কুয়েরসেটিন বিশিষ্ট রেড ওয়াইনের প্রভাব পরীক্ষা করবেন তাঁরা। 

সূর্যালোকের প্রভাবে আঙুরে কুয়েরসেটিন তৈরি হয়। এর কারণেই আঙুর ঝোপায় ঝোপায় ধরে। নাপা ভ্যালি ক্যাবারনেটে অন্যান্য রেড ওয়াইনের চেয়ে পাঁচগুণ বেশি কুয়েরসেটিন থাকে। গাঁজনের সময় মানুষের ত্বকের সংস্পর্শে আসা, পরিশুদ্ধকরণ এবং কত পুরোনো এর ভিত্তিতে রেড ওয়াইনে কুয়েরসেটিনের মাত্রা নির্ভর করে। 

গবেষক লেভিন বলেন, ‘এ গবেষণার ফলে মানুষ সহজে এমন ওয়াইন বেছে নিতে পারবে যেটিতে কম মাথাব্যথার উদ্রেক হয়। এ ছাড়া ওয়াইন প্রস্তুতকারীরা এ গবেষণা ব্যবহার করে ওয়াইনে কুয়েরসেটিনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত