Ajker Patrika

অপহরণের পর পালিয়ে আসার কাহিনি শোনাল নাইজেরিয়ার স্কুলবালক

আপডেট : ১২ মার্চ ২০২৪, ২১: ১০
অপহরণের পর পালিয়ে আসার কাহিনি শোনাল নাইজেরিয়ার স্কুলবালক

গত সপ্তাহে নাইজেরিয়ার কাদুনা রাজ্যের কুরিগা শহরের একটি স্কুল থেকে ২৮০ জনের বেশি ছাত্র-ছাত্রীকে অপহরণ করা হয়। এর ফলে ওই অঞ্চলের পুরো জনপদে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। 

অপহরণের শিকার শিক্ষার্থীদের মধ্যে ১৭ বছর বয়সী মুসাও ছিল। তবে অপহরণকারীদের কাছ থেকে সে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে। সম্প্রতি বিবিসির কাছে নিজের পালিয়ে আসার ঘটনাটি বর্ণনা করেছে মুসা। 

এ বিষয়ে বিবিসির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ঘটনার দিন (৭ মার্চ) হঠাৎ করেই অসংখ্য মোটরসাইকেল নিয়ে একদল অস্ত্রধারীকে স্কুলের দিকে আসতে দেখেছিল শিক্ষার্থীরা। স্কুলের ছাত্র মুসাসহ আরও অনেকেই ভেবেছিল, ওই অস্ত্রধারীরা হয়তো সেনাবাহিনীর লোক। কিন্তু কিছু বুঝে ওঠার আগেই পুরো স্কুল প্রাঙ্গণ দখল করে নেয় সেই দলটি। গুলিও চালাতে শুরু করে তারা। 

মুসা বলে, ‘আমরা পালানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু ওরা আমাদের ধাওয়া করে ধরে ফেলেছে। পরে আমাদেরকে গরুর মতো ঝোপের মধ্যে নিয়ে জড়ো করা হয়।’ 

মোটরবাইকে আসা সশস্ত্র ওই ব্যক্তিদের ‘ডাকাত’ হিসেবে উল্লেখ করেছে স্থানীয়রা। কুরিগা অঞ্চলের মানুষদের অপহরণ এবং মুক্তিপণ আদায় করে অর্থ উপার্জন করাই তাদের উদ্দেশ্য। 

স্থানীয় একজন বলেন, ‘আমরা আমাদের বাচ্চাদের নিয়ে যেতে দেখেছি, কিন্তু কিছুই করতে পারিনি। আমাদের সেনাবাহিনী নেই, আমাদের সম্প্রদায়ে কোনো পুলিশ নেই।’ 

অপহরণের বর্ণনা দিয়ে পালিয়ে আসা মুসা জানায়, তাদেরকে সারিবদ্ধভাবে জঙ্গল আর ঝোপ-ঝাড়ের মধ্য দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। শিক্ষার্থীদের সবাই ছিল তৃষ্ণার্ত। কিন্তু পানি পান করার উপায় ছিল না কারওরই। মুসা বলে, কিছু মেয়ে এবং ছেলে হাঁটতে গিয়ে পড়ে যাচ্ছিল। কারণ তারা সবাই ছিল ক্লান্ত। 

অবস্থা এমন ছিল যে শিক্ষার্থীদের কয়েকজনকে সাইকেলে করে নিয়ে গিয়েছিল অপহরণকারীরা। তবে একপর্যায়ে ঝোপ-ঝাড় পেরিয়ে দলটি একটি নদীর দেখা পায়। সেই নদীর পানি পান করে সবাই তৃষ্ণা মেটায়। প্রচণ্ড রোদের মধ্যে তাদেরকে আরও কয়েক ঘণ্টা হাঁটতে হয়। 

তবে এসবের মাঝেই পালানোর উপায় খুঁজতে শুরু করে মুসা। পাশাপাশি হেঁটে চলা আরও কয়েকজনকে তার সঙ্গে যোগ দেওয়া আহ্বান জানায় সে। কিন্তু প্রচণ্ড ভয়ে আর কেউই তার আহ্বানে সাড়া দেয়নি। 

হাঁটতে হাঁটতে দুপুরের পর বিকেল পেরিয়ে যখন সন্ধ্যা নামল, তখনই পালানোর একটি সুযোগ দেখতে পেল মুসা। সে দেখল, অপহরণকারীদের নজর তার দিকে নেই। সূর্যটা ডুবে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পথে থাকা ঘাসের স্তূপের মধ্যে তাই সে শুয়ে পড়েছিল। এভাবে মাটির সঙ্গে মিশে সাপের মতো গড়াগড়ি খেয়ে অপহরণকারীদের দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে আসে সে। সম্পূর্ণ অন্ধকার হয়ে আসার আগ পর্যন্ত এভাবে সে হামাগুড়ি দিয়ে যাচ্ছিল। তবে অন্ধকার ঘনিয়ে এলে উঠে দাঁড়িয়ে সে বিরামহীন হাঁটতে শুরু করে যতক্ষণ না একটি গ্রামে গিয়ে পৌঁছায়। পরে ওই গ্রামের মানুষদের কাছে সে সাহায্য দাবি করে। 

পরের দিন মুসা যখন নিজ এলাকা কুরিগায় গিয়ে হাজির হয়, তখন তার বাবা-মায়ের আনন্দ আর দেখে কে? কিন্তু পুরো এলাকাই তখন শোকবিহ্বল। অপহরণের শিকার অন্যদের বাবা-মায়েরা ছুটে আসেন মুসার কাছে। সন্তানের সর্বশেষ পরিস্থিতির কথা জানতে চান তাঁরা। অপহরণ হওয়া ১০ বছর বয়সী সাদিকের বাবা-মাও ছিলেন এই দলে। সন্তানের খুঁটিনাটি বিভিন্ন বিষয় বর্ণনা করে বিলাপ করছিলেন তাঁরা। সাদিকের ভাই হাসান বলছিল—স্কুলে যাওয়ার আগে তার কাছে একটি পেনসিল আবদার করেছিল ছোট ভাই। পরে হাসান তার পকেট থেকে পেনসিল নিয়ে যেতে বলে। এই পেনসিল নিতে গিয়ে তাড়াহুড়ায় সবকিছু এলোমেলো করে স্কুলের দিকে ছুটে গিয়েছিল সাদিক। সেদিনই ঘটল অপহরণের ঘটনা। সাদিকের মা এরপর আর ঘুমাতে পারেননি। 

বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু মুসা আর সাদিক নয়। গত আট মাসে নাইজেরিয়ায় অন্তত ৪ হাজার মানুষকে অপহরণ করা হয়েছে। আর গত দেড় দশকে উত্তর নাইজেরিয়ার অসংখ্য মানুষ সশস্ত্র জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর তীব্র আক্রমণের মুখে পড়েছে। মূলত উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য বোর্নো, আদামাওয়া এবং ইয়োবেতে এসব ঘটনা বেশি ঘটেছে। এই অঞ্চলগুলোতে বোকো হারাম নামে ইসলামপন্থী একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে। তারা পশ্চিমা শিক্ষাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। এই গোষ্ঠীর সঙ্গে ইসলামিক স্টেট (আইএস) জঙ্গিদেরও সংযোগ আছে। তারা কৃষক, যাত্রীদের টার্গেট করার পাশাপাশি বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে হামলা চালায়। আর পশ্চিমা শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা করে স্কুলগুলো তাদের অন্যতম লক্ষ্যবস্তু। ১০ বছর আগে নাইজেরিয়া চিবোকে একটি বালিকা বিদ্যালয়ে কুখ্যাত হামলার সঙ্গে জড়িত ছিল এই জঙ্গিরা। 

কাদুনা রাজ্যের সাবেক সিনেটর শেহু সানি জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক সময়ে উত্তর নাইজেরিয়ার স্কুলগুলোতে হামলার ঘটনা বেড়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে মাধ্যমিক এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এই হামলার শিকার হচ্ছে। আদর্শ প্রতিষ্ঠার নামে মুক্তিপণ আদায় করে অর্থ আয় করাই অপহরণকারীদের উদ্দেশ্য। 

নাইজেরিয়ার সরকার এই সমস্যাটি মোকাবিলায় অনেক সময় এবং অর্থ খরচ করলেও এখনো কিছু সম্প্রদায় অরক্ষিত রয়ে গেছে। এর মধ্যে কুরিগা অন্যতম। তবে কর্তৃপক্ষ কুরিগার মানুষদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে, তারা শিগগিরই তাঁদের সন্তানদের জীবিত অবস্থায় বাড়িতে ফিরিয়ে আনবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত