ভোট কারচুপি, বিক্ষোভে অচল মোজাম্বিক

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ : ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২২: ২৫
মোজাম্বিকে গত অক্টোবরে জাতীয় নির্বাচনে ভোট কারচুপির পর থেকে বিক্ষোভ ও সহিংসতা সৃষ্টি হয়েছে। ছবি: সংগৃহীত

আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিকে গত অক্টোবরে জাতীয় নির্বাচনে ভোট কারচুপির পর থেকে বিক্ষোভ ও সহিংসতার সৃষ্টি হয়েছে। ক্ষমতাসীন দল ফ্রেলিমো নির্বাচনে জালিয়াতি করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রধান বিরোধী প্রার্থী ভেনান্সিও মন্ডলেনের সমর্থকেরা নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে বিক্ষোভ শুরু করেছেন, যা ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ছে।

বিতর্কিত নির্বাচনের পর দেশটির ৩৫ মিলিয়ন মানুষের মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষ বিরাজ করছে। রাজধানী মাপুতোর বিভিন্ন রাস্তায় বিদ্যুতের খুঁটি, পোড়া টায়ার ও পাথরের টুকরো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। বিক্ষোভে অংশ নেওয়া জেইম নামে এক তরুণ শিক্ষার্থী ও দোকানি বলেন, ‘অনেকেই দেশের পরিবর্তন চায়।’ বেকারত্ব, দুর্নীতি এবং পুলিশের নির্যাতন নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন এই তরুণ।

মোজাম্বিকে এ পর্যন্ত শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন। তবে এই অসন্তোষের মূলে রয়েছে আরও বড় বড় সমস্যা। আফ্রিকাজুড়ে যুব সমাজের মধ্যে জেইমের মতোই হতাশা বিরাজ করছে। এই বছর বতসোয়ানা, ঘানা এবং সেনেগালের মতো দেশে ভোটারেরা দুর্নীতি ও জীবিকা নির্বাহের ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলগুলোকে ভোট দেয়নি। আর কেনিয়ায় মানুষ রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করেছে।

নির্বাচনী অনিয়মের অভিযোগ

১৯৭৫ সালে পর্তুগালের কাছ থেকে স্বাধীনতার পর থেকেই মোজাম্বিকে ক্ষমতায় রয়েছে ফ্রেলিমো দল। দেশটির নির্বাচনী কমিশন জানিয়েছে, অক্টোবরের নির্বাচনে ফ্রেলিমো দলের প্রার্থী ড্যানিয়েল চাপো ৭১ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। তবে এ ফলাফল কেউ বিশ্বাস করেছেন না। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, ভোটে নানা অনিয়ম হয়েছে।

আনুষ্ঠানিকভাবে ২০ শতাংশ ভোট পাওয়া স্বতন্ত্র প্রার্থী ভেনান্সিও মন্ডলেন নিজেকে প্রকৃত বিজয়ী বলে দাবি করেছেন ও বিপ্লবের আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁর দাবির পক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ না থাকলেও সমর্থকেরা তাঁর কথায় আস্থা রেখেছেন। নির্বাচনী কারচুপির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এখন রূপ নিয়েছে সামাজিক বিদ্রোহে।

যুবকদের নেতৃত্বে শহরে শহরে বিদ্রোহ

একসময় আফ্রিকায় স্বৈরাচারী সরকার উৎখাতের জন্য গ্রামে গ্রামে বিদ্রোহই ছিল প্রধান উপায়। তবে খণ্ডকালীন পাদ্রী ও জনপ্রিয় নেতা মন্ডলেন দেশটির রাজনীতিতে নতুন কৌশল নিয়েছেন। তিনি শহরের যুবকদের হতাশাকে কাজে লাগাচ্ছেন।

দেশটির যুবকেরা ফুটবলার ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর ‘সিআর৭ ’-এর মতো তাঁকে ‘ভিএম৭’ বলে ডাকেন। তিনি বিদেশ থেকে ফেসবুক লাইভে বিক্ষোভের বিভিন্ন কৌশল ঘোষণা করেন, যার মধ্যে রয়েছে ট্রাফিক জ্যাম তৈরি করা বা রান্নার পাত্র বাজিয়ে প্রতিবাদ করা।

মন্ডলেনের অনুসারীরা আরও এক ধাপ এগিয়ে গেছেন। ক্ষুব্ধ জনতা পুলিশ স্টেশন, আদালত ও ফ্রেলিমো দলের অফিসে হামলা চালিয়েছে। এক শহরে কারাগার ভেঙে কয়েদিদের মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। বিক্ষোভকারীরা দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে প্রধান সীমান্ত বেশ কয়েকবার বন্ধ করে দিয়েছে।

অর্থনীতি ও দুর্নীতির প্রতি ক্ষোভ

বিক্ষোভকারীরা বলছেন, নির্বাচনের ফলাফলের মতো অর্থনীতিও তাঁদের বিরুদ্ধে চলছে। মোজাম্বিকের গড় দারিদ্র্যের হার নয় বছর আগের চেয়ে আরও বেড়েছে। বার্ষিক মাথাপিছু গড় আয় মাত্র ৬০০ মার্কিন ডলার, যা বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম।

জনগণের দল হিসেবে দাবি করা ফ্রেলিমোকে এখন দুর্নীতির দুষ্টচক্রে আক্রান্ত হিসেবে বলে মনে করে দেশটির অধিকাংশ মানুষ। এক দশক আগে লন্ডনের ব্যাংকার এবং লেবাননের জাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গোপনে ১ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি ঋণ নেন। এই ঋণের বেশির ভার টাকাই লোপাট করে ফ্রেলিমো কর্মকর্তারা। ২০১৬ সালে এই গোপন ঋণের গোমর ফাঁস হলে অর্থনীতি ভেঙে পড়ে।

এ ঋণের টাকা দিয়ে বেশি দামে কেনা মাছ ধরার ট্রলার এখন বন্দরে অচলাবস্থায় পড়ে আছে। চলতি মাসে এগুলো নিলামে তোলা হলে একটি ক্রেতাও পাওয়া যায়নি।

মোজাম্বিকে বৈদেশিক পুঁজি প্রবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদ রপ্তানি থেকে লাভবান হচ্ছেন রাজনীতিবিদরা। সমাজবিজ্ঞানী জোয়াও ফেইজো বলেছেন, ‘ফ্রেলিমো কোনো রাজনৈতিক দল নয়, এটি ব্যবসার ধান্ধাবাজি।’

দেশটির উত্তরের প্রদেশ কাবো ডেলগাডো এখন রুবি, হেরোইন ও কাঠ পাচারের প্রধান রুট হয়ে উঠেছে। এখানেই স্থানীয় ইসলামিক স্টেট শাখা তাঁদের ঘাঁটি তৈরি করেছে এবং বঞ্চিতদের নিজেদের দলে ভেড়াচ্ছে। ২০২১ সালে জিহাদিরা শত শত বেসামরিক মানুষ হত্যার পর টোটালএনার্জিজ সেখানে একটি বিশাল গ্যাস প্রকল্প স্থগিত করে।

প্রদেশটিতে বিক্ষোভকারীরা স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রথম গুলি চালানোর জন্য পরিচিত আলবার্তো চিপান্ডের একটি মূর্তি ভেঙে ফেলেছে। বর্তমানে চিপান্ডে নিজেকে বহু ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত করেছেন।

মোজাম্বিকে গত অক্টোবরে জাতীয় নির্বাচনে ভোট কারচুপির পর থেকে বিক্ষোভ ও সহিংসতা সৃষ্টি হয়েছে। ছবি: সংগৃহীত
মোজাম্বিকে গত অক্টোবরে জাতীয় নির্বাচনে ভোট কারচুপির পর থেকে বিক্ষোভ ও সহিংসতা সৃষ্টি হয়েছে। ছবি: সংগৃহীত

ফ্রেলিমো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে গুলি চালাচ্ছে। ১০ ডিসেম্বর মনিটরিং গ্রুপ প্লাটফর্মা ইলেক্টোরাল ডিসাইড জানায়, নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে এ পর্যন্ত অন্তত ১১০ জন নিহত হয়েছেন। এদের মধ্যে শিশুরাও রয়েছে।

পুলিশ কর্মকর্তারা বিক্ষোভকারীদের সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে অভিযোগ করেছেন, তাঁরা শিশুদের মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে।

অ্যাকটিভিস্ট কুইতেরিয়া গুইরেঙ্গানে বলেন, ‘বিক্ষোভ থামছে না। সরকারের ঔদ্ধত্য দেখে মানুষ এতটাই ক্ষুব্ধ যে তাঁরা আর ভয় পাচ্ছেন না।’

বড় সংঘর্ষের আশঙ্কা

বড়দিনের সময় বড় ধরনের সংঘর্ষ হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। সেদিন সাংবিধানিক আদালত নির্বাচনের ফলাফল বৈধ ঘোষণা করার কথা রয়েছে। বিচারকরা জানিয়েছেন, তাঁরা মৃত্যুর হুমকি পেয়েছেন, যদিও হুমকিদাতাদের নাম প্রকাশ করেননি।

অক্টোবরে আদালতে আপিল জমা দেওয়ার প্রস্তুতির সময় বিরোধী দলের এক আইনজীবীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। মন্ডলেন সমর্থকদের বলেছেন, বড়দিনে উৎসবের পরিকল্পনা বাতিল করুন ও আদালতে চ্যাপোর বিজয় ঘোষণা করা হলে রাস্তায় নেমে আসুন।

সমঝোতার পথ বন্ধ

কোনো পক্ষই আপসের পথে হাঁটতে রাজি নয়। মন্ডলেন বলেছেন, নতুন করে নির্বাচন দিলেও তাতে তিনি সন্তুষ্ট হবেন না। বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ফিলিপে নিউসি আলোচনার ইঙ্গিত দিলেও এর প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেননি।

সেনাবাহিনীর মনোভাব এখনো পরিষ্কার নয়। অনিয়মিত নির্বাচন করা প্রতিবেশী সরকারগুলোও এই সংকট নিয়ে নীরব রয়েছে, এই সংঘাত আঞ্চলিক বাণিজ্যে প্রভাব ফেলছে।

নির্বাচনী বিতর্ক মিটলেও মোজাম্বিকের ভেঙে পড়া অর্থনীতি মজবুত করা কঠিন কাজ হবে। শহরের সংখ্যা বৃদ্ধি, স্মার্টফোন ও শিক্ষার প্রসার মানুষের প্রত্যাশা বাড়িয়েছে, কিন্তু সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। পুরো আফ্রিকাজুড়ে সরকারগুলো একই ধরনের সমস্যার মোকাবিলা করছে। মোজাম্বিকে যে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে, এটি শেষ ঘটনা নয়।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ইসরায়েলের ‘হৃৎপিণ্ড’ তেল আবিবে হুতিদের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা

সাগরে নিম্নচাপ, কত দিন বৃষ্টি হতে পারে জানাল আবহাওয়া দপ্তর

শেখ মুজিব ও জিয়াউর রহমান যার যার স্থানে শ্রেষ্ঠ: গয়েশ্বর

র‌্যাব বাতিলের সরকারি সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি: নূর খান লিটন

হাসিনার আমলে রাশিয়ার সঙ্গে ১০০ কোটি ডলারের অস্ত্র চুক্তি, জড়াল টিউলিপের নামও

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত