সংঘাত পাল্টে দিয়েছে বিদ্রোহীদের দখলে যাওয়া আলেপ্পোর জীবনচিত্র

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ : ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩: ০০

২০১১ সাল থেকে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ চলছে। মাঝে বন্ধ থাকলেও নতুন করে বিদ্রোহীদের হামলা দেশটির দীর্ঘদিন ধরে চলা এই যুদ্ধকে উসকে দিয়েছে। গত বুধবার শুরু হওয়া এ সংঘর্ষে এখন পর্যন্ত ৪৫৭ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস। নিহত ব্যক্তিদের অন্তত ৭২ বেসামরিক নাগরিক। আর বাস্তুচ্যুত হয়েছেন প্রায় ৫০ হাজার মানুষ।

সিরিয়ার গুরুত্বপূর্ণ শহর আলেপ্পো, ইদলিব ও হামায় বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে লড়ছে সিরিয়ার সরকারি বাহিনী। রাজনৈতিক সমাধান না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে ‘মিলিটারি অপারেশন কমান্ড’ বিদ্রোহী গোষ্ঠী। অন্যদিকে বিদ্রোহীদের ‘সন্ত্রাসী’ আখ্যা দিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে লড়াই করবেন বলেছেন সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল–আসাদ। চলমান লড়াইয়ে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হচ্ছে আগেও দীর্ঘ সময় বিদ্রোহীদের দখলে থাকা আলেপ্পো শহরটি।

উত্তর সিরিয়ার আলেপ্পো শহরের একজন ইংরেজি শিক্ষক আবদুলকাফি। ২০ বছর পর প্রথমবারের মতো বাবার দেখা পেলেন তিনি। গতকাল সোমবার তাঁর বাবার সঙ্গে দেখা হয়। বিবিসির একটি ভিডিওতে দেখা যায়, আবদুলকাফি ও তাঁর বাবা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন।

বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আবদুলকাফি বলেন, বাবার বয়স ৮৫ বছর। তিনি কখনো স্বপ্নেও ভাবেননি, মৃত্যুর আগে আবার আমাকে দেখতে পাবেন।

আবদুলকাফির বাবা সৌদি আরবে কর্মরত ছিলেন। সেখান থেকে তিনি যখন ফিরে আসেন, তখন আবদুলকাফি বিদ্রোহী গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রিত এলাকায় চলে গিয়েছিলেন। তাঁদের আর দেখা হয়নি। সম্প্রতি বিদ্রোহী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) ও তাদের মিত্ররা প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের অনুগত বাহিনীর কাছ থেকে আলেপ্পোসহ বেশ কিছু এলাকা দখল করে নেয়। তারপর বাবার দেখা পান আবদুলকাফি।

আবদুলকাফি বলেন, আলেপ্পোর কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। বিদ্রোহী যোদ্ধারা তাঁদের সঙ্গে সম্মানজনক আচরণ করেছে এবং বিদ্যুৎ-পানির সরবরাহ ঠিক আছে বলে জানিয়েছে তাঁরা। তবে তাঁরা পুনরায় যুদ্ধ শুরুর আশঙ্কা করছেন এবং সন্দেহ করছেন যে আল-কায়েদাসংশ্লিষ্ট এই গোষ্ঠীটির কথিত উদারনীতি স্থায়ী হবে।

আবদুলকাফি বলেন, তাঁর পরিবার-পরিজন তাঁকে নিয়ে ভয় পাচ্ছেন। তাঁরা আশঙ্কা করছেন, সরকার পুনরায় শহরটি দখল করলে তাঁদের শাস্তির মুখে পড়তে হতে পারে। আলেপ্পোর প্রতিটি ভবন, রাস্তা এবং কোণায় কোণায় প্রেসিডেন্ট আসাদের ছবি। তিনি মানুষের মন নিয়ন্ত্রণ করছেন।

আলেপ্পোর বাসিন্দা এক নারী জানান, শহরটি বিদ্রোহীদের দখলে যাওয়ার পর এখানকার মানুষ বিভ্রান্ত ও ভীত অবস্থায় আছে। তিনি আরও বলেন, ’আমি প্রথমে বাড়ি থেকে বের হইনি। পরে শুনলাম, বিদ্রোহীরা সাধারণ মানুষকে হয়রানি করছে না। তাই আমি পরিবারের সঙ্গে হাঁটাহাঁটি এবং গাড়ি চালাতে বের হলাম। সবকিছু তুলনামূলকভাবে শান্ত ছিল কিন্তু সবাই ভীত এবং উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিল। তাঁদের চেহারা ও প্রতিক্রিয়ায় তা বোঝা যাচ্ছিল। কেউ স্বস্তিতে ছিল না।’

ওই নারী আরও বলেন, ’মানুষ এখন ভীত। কারণ আমরা কাউকে বিশ্বাস করতে পারছি না বা জানি না যে কী হতে চলেছে। আমাদের সবাই হতাশ করেছে। আমরা জানি না, আমাদের ভাগ্যে কী অপেক্ষা করছে।’

আলেপ্পোর বাসিন্দারা আবার যুদ্ধ শুরুর ভয়ে আতঙ্কে রয়েছেন। স্থানীয় এক ব্যক্তি বলেন, তাঁর সবচেয়ে বড় উদ্বেগ ছিল, যেকোনো সময় শহরটি বোমাবর্ষণের শিকার হতে পারে। তাঁরা দোকানে যাওয়া পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছেন। আমরা সম্পূর্ণ আতঙ্কের মধ্যে বসবাস করছি। এই বিমান হামলাগুলো তাঁকে যুদ্ধের শুরুর দিককার কথা মনে করিয়ে দিয়েছে।

আলেপ্পোর আর্মেনিয়ানদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন গ্রিক-আর্মেনিয়ান রাজনৈতিক বিশ্লেষক জর্জ মেনেশিয়ান। তিনি বলেন, বিদ্রোহী গোষ্ঠী শহর দখলের পর খ্রিস্টানদের কোনো সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়নি। তাঁরা নিশ্চিত করেন, কোনো ক্ষতি করা হবে না। তবে বিদ্রোহীদের প্রতিশ্রুতিতে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন বিদ্রোহীরা। কারণ এর আগে জিহাদী গোষ্ঠীগুলো এমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে পরে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে।

ইদলিবের এইচটিএস-নিয়ন্ত্রিত আল-দানা শহরের বাসিন্দা আবদুলকাফি এ বিষয়ে বলেন, সংখ্যালঘুদের এই গোষ্ঠীর কাছ থেকে ভয়ের কিছু নেই, যদিও তিনি তাদের সঙ্গে একমত নন। তারা অনেক বেশি নমনীয়তা দেখাচ্ছে, কারণ বিদ্রোহীদের বিশ্বের কাছ থেকে গ্রহণযোগ্যতা প্রয়োজন। তবে এর মানে এই নয়, আমি তাঁদের পছন্দ করি।

সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের প্রথম দিকেই আলেপ্পো দখল করেছিল বিদ্রোহীরা। ২০১৬ সালে শহরটি রাশিয়ার সহায়তায় পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয় সিরিয়ার সরকারি বাহিনী। তারপর থেকে, শহরটি সরাসরি যুদ্ধ থেকে অনেকটা মুক্ত ছিল। যুদ্ধের আগে দেশের বাণিজ্যিক কেন্দ্র ছিল এই শহরটি। সিরিয়ার সরকার শহরটি পুনর্গঠন করার দাবি করলেও এনজিও ও সাংবাদিকরা সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেছে।

সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে এরই মধ্যে ৩ লাখের বেশি মানুষ মারা গেছেন এবং ৬০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। আবার শুরু হওয়ার পর এই সংখ্যা কয়েক গুণ বাড়তে পারে এ শঙ্কায় যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানিয়ে এক বিবৃতিতে জাতিসংঘের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক বলেন, সিরিয়ার মানুষ প্রায় ১৪ বছর ধরে সংঘাত সহ্য করে যাচ্ছেন। এর একটি রাজনৈতিক সমাধান তাঁদের প্রাপ্য। আর রক্তপাত নয়।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত