Ajker Patrika

ভারতে রাজনৈতিক পরামর্শক পেশার বাজার ৩০ কোটি ডলার, ভাগ্য খুলেছে উচ্চশিক্ষিত বেকারদের

ভারতে রাজনৈতিক পরামর্শক পেশার বাজার ৩০ কোটি ডলার, ভাগ্য খুলেছে উচ্চশিক্ষিত বেকারদের

ভারতের জাতীয় নির্বাচনে কে বা কারা বিজেপিকে ভোট দেবে না তাদের তালিকা তৈরি করতে বেকারদের নিয়োগ দিচ্ছে দলটি। এদের কাজ হলো—বিজেপিকে ভোট দিতে অনিচ্ছুক নাগরিকদের বয়স, লিঙ্গ, জাত, ধর্ম তালিকাবদ্ধ করা এবং বিজেপির স্বার্থে এসব তথ্য কীভাবে কাজে লাগানো যায় সেই কৌশল বের করা। 

কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল–জাজিরা এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।

গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে বিজেপির এমন একটি প্রকল্পে পরামর্শকের চাকরি পাওয়া যুবক নীরাজ (ছদ্মনাম) বলেন, ‘আমাদের সবাইকে জয়েন্ট এন্ট্রান্স এক্সাম (জেইই) দিয়ে ঢুকতে হয়। যারা সমস্যা সমাধান করতে সিদ্ধহস্ত তাঁদেরই নেওয়া হয়।’ 

ভারতের বেশির ভাগ শীর্ষ সরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং, আইন ও ব্যবস্থাপনা কলেজে একযোগে এই জেইই পরীক্ষা হয়। ২৩টি আইআইটিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে লাখ লাখ শিক্ষার্থী এই পরীক্ষা দেয়। নীরাজ সেই কয়েকজনের মধ্যে একজন। নীরাজের মতো ভারতের শীর্ষ ইঞ্জিনিয়ারিং এবং বিজনেস স্কুল থেকে পাস করা শত শত গ্র্যাজুয়েট সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিজেপির রাজনৈতিক প্রচারণায় যোগ দিয়েছেন। 

আইআইটি থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি নেওয়া ছাত্রদের মধ্যে রয়েছেন গুগলের সিইও সুন্দর পিচাই এবং টুইটারের (বর্তমানে এক্স) সাবেক সিইও পরাগ আগরওয়াল, অথবা ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট থেকে এমবিএ করা পেপসিকোর সাবেক সিইও ইন্দ্রা নুইয়ি। কিন্তু গত কয়েক বছরে টেক জায়ান্টগুলোতে নিয়োগ কমে যাওয়া এবং ছাঁটাইয়ের কারণে পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। 

এসব গ্র্যাজুয়েটের মেধা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ভারতের বিপুলসংখ্যক ভোটারের তথ্য সংগ্রহ এবং বিশ্লেষণের দক্ষতা এই গ্র্যাজুয়েটদের রাজনৈতিক পরামর্শক করে তুলেছে। এই চাকরির বাজারের আকার প্রায় ৩০ কোটি মার্কিন ডলারের সমান। বিভিন্ন স্বতন্ত্র প্রার্থী, জাতীয় ও আঞ্চলিক দলগুলো তাঁদের দক্ষতা কাজে লাগাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। 

উল্লেখিত প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে স্নাতকদের আকৃষ্ট করার জন্য বেশির ভাগ দল রাজনৈতিক পরামর্শদাতার ফেলোশিপ অফার করছে। চাকরিগুলো চুক্তিভিত্তিক এবং স্বল্পমেয়াদি (সাধারণত তিন মাস থেকে তিন বছর পর্যন্ত) হলেও বেতন বেশ ভালো। বিশেষ সুবিধাসহ এই অভিজ্ঞতা ভবিষ্যৎ গড়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দেয়। 

দিল্লির রাজনৈতিক পরামর্শক সংস্থা ‘পলিটিক অ্যাডভাইজার’–এর পরিচালক ও কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার অঙ্কিত লাল বলেন, ‘এখানে ক্ষমতার কাছাকাছি থাকার আকর্ষণও রয়েছে।’ 

ত্রিপুরায় নীরাজ ও তাঁর সহকর্মীরা ভোটারদের তথ্য সংগ্রহ এবং বিশ্লেষণ করেছিলেন। এতে দেখা যায়, বিজেপি উত্তরে ভালো অবস্থানে রয়েছে। তবে অমরপুর নির্বাচনী এলাকার ছাবিমুড়াসহ কয়েকটি আদিবাসী অঞ্চলের ভোটারেরা অন্য দলের সমর্থক। তাঁদের ভোট বিজেপির বাক্সে আনতে তিনি সেখানকার প্রভাবশালী জামাতিয়া পরিবারের সঙ্গে কথা বলেন এবং তাঁদের দাবি–দাওয়া শোনেন। 

পরিবারগুলো জানায়, তাঁদের বাড়ির নিরাপত্তা প্রাচীর নেই। এরপর রাজ্যের বিজেপি নেতাদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন নীরাজ। নেতাদের সম্মতি নিয়ে ৮০টি জামাতিয়া পরিবারের জন্য কাদা দিয়ে ৪ ফুট উঁচু প্রাচীর নির্মাণ করে দেন। সঙ্গে কিছু ছাগলও দেন তাঁদের। সেসব ছাগলের গায়ে নরেন্দ্র মোদির ছবি আঁকা ছিল। এভাবেই ওই এলাকার ভোটগুলো বিজেপির বাক্সে জড়ো করেন তিনি। নির্বাচনে ওই আসনে বিজেপির প্রার্থী স্বল্প ভোটে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থীকে হারান। 

বিজেপির ত্রিপুরা শাখার মুখপাত্রের কাছে এ বিষয়ে আল–জাজিরা জানতে চাইলে তিনি অবশ্য কোনো মন্তব্য করেননি।

ভারতে ভোটারদের উৎকোচ দেওয়া আইনত অপরাধ হলেও বিজেপির এমন কর্মকাণ্ডের কোনো তদন্ত নেই। এবারের জাতীয় নির্বাচন শুরুর কয়েক মাস আগে থেকে এসব মেধাবী গ্র্যাজুয়েট ভোটারদের সম্পর্কে নানা তথ্য জোগাড় ও বিশ্লেষণ শুরু করেন। তাঁরা বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতাদের জানাতে থাকেন কোন কোন এলাকায় কী কী ‘উপহার’ পাঠাতে হবে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিজেপির কী গুনগান করতে হবে, অন্য দল সম্পর্কে কী গুজব ছড়াতে হবে এবং হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপগুলোতে ভোটারদের কী বার্তা গেলাতে হবে। 

এ ধরনের কর্মকাণ্ডে নৈতিকতা প্রশ্ন উঠলেও কৌশলে তা এড়িয়ে যান এই মেধাবীরা। তাঁরা নিজেদের মনে করেন, ভারতের গণতন্ত্রে নিরপেক্ষ রাজনৈতিক সমস্যার ফয়সালাকারী। আল–জাজিরার সঙ্গে আলাপকালে তাঁদের কয়েকজন বলেছেন, রাজনীতিতে এসব হয়তো ঠিক নয়, কিন্তু এই কাজগুলো তাঁরা কোনো কোনো পক্ষপাতিত্ব করেন না। শুধু সমস্যার সমাধান করে দেন। এটি নিছক পেশাদারি।

এদিকে বসে নেই ভারতের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসও। তেলেঙ্গানায় আইআইটিয়ানদের দিয়ে দলটি ‘ইনক্লুসিভ মাইন্ড’ নামে ১২ সদস্যর একটি নির্বাচনী পরামর্শক দল গঠন করেছে। তাঁরাও একইভাবে ভোটারদের নানা তথ্য সংগ্রহ করছেন এবং বিচার বিশ্লেষণ শেষে কংগ্রেস নেতাদের কাছে চাহিদা পাঠাচ্ছেন। ভারতজুড়ে কংগ্রেসেরও শত শত এমন কর্মী ‘ইনক্লুসিভ মাইন্ডকে’ ভোটারদের নানা তথ্য ও চাহিদা পাঠাচ্ছে। 

অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর পরামর্শক সংস্থাও ইনক্লুসিভ মাইন্ডের মতো ভারতজুড়ে একইভাবে কাজ করছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়াচ্ছে একে অপরের বিরুদ্ধে নানা প্রচার–প্রচারণা। জাকারবার্গের মেটা কোম্পানিও এসব পরামর্শক সংস্থাকে ভোটারদের নানা তথ্য দিচ্ছে বলে জানা গেছে। 

ইনক্লুসিভ মাইন্ড বিভিন্ন সংবাদ যাচাই ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের জনপ্রিয় ব্যক্তিদের প্রভাব বিশ্লেষণ করে। সংস্থাটির ২০–৩০ শতাংশ কর্মী আইআইটিয়ান, ৫ শতাংশ আইআইএম থেকে পাস করা। তাঁরা সবাই ‘তথ্যই রাজা’ মন্ত্রে বিশ্বাসী। 

ফ্যাক্টচেকিং ওয়েবসাইট অল্টনিউজের সহপ্রতিষ্ঠাতা প্রতীক সিনহা একটি রাজনৈতিক পরামর্শদাতা সংস্থাকে ‘অত্যন্ত অস্বচ্ছ’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, সংস্থাটির কোনো নৈতিক ভিত্তি নেই। রাজনৈতিক দলগুলো এমন সংস্থার মাধ্যমে মিথ্যাচার, ভুল তথ্য এবং অনলাইনে ঘৃণা ছড়াচ্ছে। নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে ভুয়া খবর ও ঘৃণামূলক পোস্ট বাড়ছে। সারোগেট (ব্যক্তিগত পেজে অন্যের প্রচারণা), ফেসবুক বিজ্ঞাপনে প্রক্সি পেজ, মিথ্যা তথ্য, বিদ্বেষমূলক বক্তব্য পোস্ট করতে লাখ লাখ টাকা খরচ করা হচ্ছে এবং এই সবই করছেন রাজনৈতিক পরামর্শকেরা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত