Ajker Patrika

হামাস নয়, গাজা শাসন করবে ‘আন্তর্জাতিক প্রশাসন’, আরও যা আছে প্রস্তাবে

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ০৪ মার্চ ২০২৫, ১১: ৪৭
হামাসকে বাদ দিয়েই গাজা শাসনের পরিকল্পনা করেছে মিসর। ছবিতে ইসরায়েলি হামলায় বিধ্বস্ত ভবনের ওপর বসে আছেন এক ফিলিস্তিনি। ছবি: এএফপি
হামাসকে বাদ দিয়েই গাজা শাসনের পরিকল্পনা করেছে মিসর। ছবিতে ইসরায়েলি হামলায় বিধ্বস্ত ভবনের ওপর বসে আছেন এক ফিলিস্তিনি। ছবি: এএফপি

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের গাজাকে মধ্যপ্রাচ্যের রিভেরায় পরিণত করার পরিকল্পনার মোকাবিলায় মিসর একটি বিকল্প প্রস্তাব তৈরি করেছে। এই প্রস্তাব অনুসারে, গাজার শাসনভার আর হামাসের থাকবে না। বরং আরব, মুসলিম ও পশ্চিমা দেশগুলো নিয়ন্ত্রিত অন্তর্বর্তী সংস্থাগুলোর মাধ্যমে অর্থাৎ, আন্তর্জাতিক একটি প্রশাসনের মাধ্যমে গাজা শাসন করা হবে। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের হাতে আসা পরিকল্পনার খসড়া দলিল থেকে এ তথ্য জানা গেছে।

মিসরের গাজা-সংক্রান্ত এই দৃষ্টিভঙ্গি আজ মঙ্গলবার আরব লীগের শীর্ষ সম্মেলনে উপস্থাপনের কথা আছে। তবে এতে স্পষ্টভাবে বলা হয়নি, এই প্রস্তাব চূড়ান্ত শান্তিচুক্তির আগে কার্যকর হবে, নাকি পরে। যুদ্ধের পর গাজার শাসনব্যবস্থা কেমন হবে এটাই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় অমীমাংসিত প্রশ্ন। হামাস এখন পর্যন্ত কোনো বাহ্যিক শক্তির চাপিয়ে দেওয়া পরিকল্পনা মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।

কায়রোর প্রস্তাবটি গাজা পুনর্গঠনের অর্থায়ন কে করবে বা সেখানকার শাসনব্যবস্থা কীভাবে পরিচালিত হবে এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো স্পষ্ট করেনি। এমনকি শক্তিশালী ও সশস্ত্র হামাসকে কীভাবে দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে, সে বিষয়েও কোনো বিবরণ এতে নেই।

মিসরের পরিকল্পনা অনুসারে, ‘গভর্ন্যান্স অ্যাসিস্ট্যান্স মিশন’ নামে একটি সংস্থা অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য হামাসের জায়গায় গাজা শাসনের জায়গা নেবে এবং এটি অঞ্চলটির মানবিক সহায়তা ও পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু করবে।

প্রস্তাবের ভূমিকায় বলা হয়েছে, ‘যদি হামাস গাজার স্থানীয় প্রশাসনের ওপর আধিপত্য বিস্তারকারী সশস্ত্র রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে থেকে যায়, তাহলে গাজা পুনর্গঠন ও পুনর্বাসনের জন্য কোনো বড় আন্তর্জাতিক অর্থায়ন আসবে না।’ এর আগে মিসরের গাজা-সংক্রান্ত প্রস্তাবে এমন কোনো বিশদ তথ্য প্রকাশিত হয়নি।

মিসর, জর্ডান এবং উপসাগরীয় আরব দেশগুলো প্রায় এক মাস ধরে ট্রাম্পের পরিকল্পনার মোকাবিলায় কূটনৈতিক উদ্যোগ নেওয়ার চেষ্টা করছে। একাধিক বিকল্প পরিকল্পনার কথা শোনা যাচ্ছে, তবে মিসরের প্রস্তাবকেই সবচেয়ে সম্ভাবনাময় বলে মনে করা হচ্ছে। আরব নেতারা এই প্রস্তাব সমর্থন করবেন কি না, তা রয়টার্স নিশ্চিত করতে পারেনি।

এই পরিকল্পনায় কে ‘গভর্ন্যান্স মিশন’ পরিচালনা করবে, তা নির্দিষ্ট করা হয়নি। তবে এতে বলা হয়েছে, ‘গাজার পুনরুদ্ধার ত্বরান্বিত করতে গাজার ও অন্যান্য স্থানের ফিলিস্তিনি বিশেষজ্ঞদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো হবে।’ এ ছাড়া এই পরিকল্পনায় মার্কিন প্রস্তাব অনুযায়ী ফিলিস্তিনিদের গণচ্যুতির কড়া বিরোধিতা করা হয়েছে। মিসর ও জর্ডানের মতো দেশগুলো এটি তাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে দেখছে।

এদিকে, হামাসের সিনিয়র কর্মকর্তা সামি আবু জুহরি রয়টার্সকে বলেছেন, তাঁরা মিসরের এমন কোনো প্রস্তাবের কথা জানেন না। তিনি বলেন, ‘গাজার ভবিষ্যৎ কেবল ফিলিস্তিনিরাই নির্ধারণ করবে। হামাস কোনো বাহ্যিক শক্তির চাপিয়ে দেওয়া প্রকল্প বা অ-ফিলিস্তিনি প্রশাসন মেনে নেবে না এবং গাজায় কোনো বিদেশি বাহিনীর উপস্থিতিও মেনে নেওয়া হবে না।’

মিসরের খসড়ায় ভবিষ্যৎ নির্বাচন নিয়ে কোনো আলোচনা করা হয়নি। মিসরের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে রয়টার্সের মন্তব্যের অনুরোধে সাড়া দেয়নি। একইভাবে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ও কোনো মন্তব্য করেনি, যদিও যেকোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ইসরায়েলের সম্মতি গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হচ্ছে।

ফিলিস্তিনি ইসলামপন্থী সংগঠন হামাস ২০০৭ সাল থেকে উপকূলীয় গাজা শাসন করছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস ইসরায়েলে হামলা চালায়, যাতে ১ হাজার ২০০ জনের মতো নিহত হয়। প্রতিক্রিয়ায় সেদিন থেকেই এরপর টানা ১৫ মাসের বেশি ইসরায়েল গাজায় হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যায়। এতে পুরো গাজা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়ার পাশাপাশি ৪৮ হাজারে বেশি মানুষ নিহত হয়, আহত হয় ১ লাখ ১১ হাজারের বেশি, যাদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু। এ ছাড়া, এখনো নিখোঁজ প্রায় ১৪ হাজার।

পরে মিসর, কাতার ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি এক যুদ্ধবিরতি সাময়িকভাবে সংঘাত থামায়। তবে এই যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপ গত শনিবার শেষ হয়ে গেছে এবং দ্বিতীয় ধাপ শুরু হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

যাই হোক, হামাস অস্ত্র সংবরণে অস্বীকৃতি জানালে বা রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়াতে না চাইলে কী করা হবে, সে সম্পর্কে খসড়ায় কিছু বলা হয়নি। এই প্রস্তাবে একটি ‘আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা বাহিনী’ গঠনের কথা বলা হয়েছে, যা মূলত আরব দেশগুলোর সেনাদের নিয়ে গঠিত হবে এবং এটি হামাসের বদলে গাজার নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করবে। পরবর্তীতে নতুন এক স্থানীয় পুলিশ বাহিনী গঠন করা হবে।

নিরাপত্তা ও প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানগুলো একটি ‘পরিচালনা বোর্ডের’ অধীনে পরিচালিত হবে। মূলত আরব দেশগুলো ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি), যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও এর সদস্য রাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশের সমন্বয়ে গঠিত হবে এই পরিচালনা বোর্ড।

এই পরিকল্পনায় ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের জন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক ভূমিকা নির্ধারণ করা হয়নি। জরিপ অনুসারে, গাজা ও পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিদের মধ্যে এই কর্তৃপক্ষের জনপ্রিয়তা খুব কম। এক ফিলিস্তিনি কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেছেন, ‘গাজা পশ্চিম তীরের মতোই ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের অধীনে পড়ে এবং এটি অবশ্যই ফিলিস্তিনিরাই পরিচালনা করবে।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা মিসরীয়দের সঙ্গে একমত হয়েছি যে, গাজা পরিচালনায় ফিলিস্তিনি বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হবে, যা ছয় মাসের জন্য ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে সহায়তা করবে। এই কমিটি ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমন্বয় করবে, তবে কোনো বিদেশি সংস্থার অধীন থাকবে না।’

এর আগে, ২০০৭ সালে হামাস এক সংক্ষিপ্ত গৃহযুদ্ধের মাধ্যমে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে গাজা থেকে উৎখাত করে। অঞ্চলটিতে তারা বিরোধীদের কঠোরভাবে দমন করে। ইরানের সমর্থনে তারা একটি বিশাল সামরিক কাঠামো ও বিস্তৃত টানেল বা সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্ক তৈরি করে, যার বেশির ভাগই ইসরায়েল ধ্বংস করেছে বলে দাবি করেছে।

গাজা পুনর্গঠনে কে অর্থায়ন করবে, তা মিসরের পরিকল্পনায় বলা হয়নি। জাতিসংঘের হিসাবে, এই কাজের জন্য ৫৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি প্রয়োজন। রয়টার্সের দুটি সূত্র জানিয়েছে, প্রাথমিকভাবে অন্তত ২০ বিলিয়ন ডলার উপসাগরীয় ও আরব দেশগুলোকে দিতে হবে।

মিসরের পরিকল্পনা অনুযায়ী, বোর্ডভুক্ত দেশগুলো একটি তহবিল গঠন করবে এবং দাতা সম্মেলনের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন ও পুনর্গঠনের জন্য অর্থ সংগ্রহের ব্যবস্থা করবে। তবে কোনো নির্দিষ্ট অর্থনৈতিক প্রতিশ্রুতি এই পরিকল্পনায় উল্লেখ নেই।

সৌদি আরব, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো তেল-গ্যাস সমৃদ্ধ দেশগুলো প্রধান অর্থায়নকারী হতে পারে। সংযুক্ত আরব আমিরাত হামাস ও অন্যান্য উগ্র সংগঠনকে অস্তিত্বের জন্য হুমকি হিসেবে দেখে। ফলে হামাস ক্ষমতায় থাকলে তারা কোনো ধরনের অর্থায়ন করবে না।

এই খসড়ায় একটি ‘সিভিল সোসাইটি অ্যাডভাইজরি বোর্ড’ গঠনের কথাও বলা হয়েছে, যেখানে শিক্ষাবিদ, এনজিও নেতা এবং অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিরা থাকবেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত