Ajker Patrika

নিবিড় ইবাদতের ১০ দিন

মুফতি ইশমাম আহমেদ
নিবিড় ইবাদতের ১০ দিন

আমাদের কাছে রমজানের শুরুর দিকে ইবাদত-বন্দেগির যে গুরুত্ব থাকে, শেষের দিকে এসে সেই আগ্রহ স্বাভাবিকভাবেই হারিয়ে যায়। তবে কোরআন-হাদিস থেকে বোঝা যায়, রমজানের শুরুর দিনগুলো যত ফজিলতপূর্ণ, শেষের দিকের দিনগুলো তার চেয়ে অনেক বেশি ফজিলতপূর্ণ। বিশেষ করে রমজানের শেষ ১০ দিনের মর্যাদা বছরের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। তাই এ সময়টি নিবিড়ভাবে ইবাদতে কাটানো উচিত।

ইতিকাফ ইবাদতের সুবর্ণ সুযোগ

রমজানের শেষ দশকটি নিভৃতে আল্লাহ তাআলার ইবাদতে কাটাতে ইতিকাফই হতে পারে সবচেয়ে সেরা মাধ্যম। ইতিকাফের মাধ্যমে একজন মানুষ জাগতিক সব ব্যস্ততাকে এক পাশে রেখে ১০ দিনের জন্য নিজেকে আল্লাহর দরবারে সঁপে দেওয়ার সুযোগ পায়। রোজা ফরজ হওয়ার পর থেকে মহানবী (সা.) কখনোই ইতিকাফ পরিত্যাগ করেননি। তাঁর সহধর্মিণীরাও ইতিকাফ করেছেন আজীবন। রমজানের পূর্ণ ফজিলত পেতে হলে ইতিকাফের বিকল্প নেই। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ রাত শবে কদর অন্বেষণেও ইতিকাফের বিকল্প নেই।

মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘আমি শবে কদরের খোঁজে (রমজানের) প্রথম ১০ দিন ইতিকাফ করলাম। এরপর ইতিকাফ করলাম মধ্যবর্তী ১০ দিন। এরপর অহির মাধ্যমে আমাকে জানানো হলো যে তা শেষ ১০ দিনে। সুতরাং তোমাদের যে ইতিকাফ করতে চাইবে, সে যেন ইতিকাফ করে।’ এরপর মানুষ তাঁর সঙ্গে ইতিকাফে শরিক হয়। (মুসলিম)। তাই আমাদের উচিত, ইতিকাফ করে সম্পূর্ণভাবে ইবাদতে ডুব দেওয়া এবং আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জনের সর্বাত্মক চেষ্টা করা।

শবে কদরে ফেরেশতাদের আনাগোনা

শবে কদর রমজানের কোন রাতটি—তা নির্ধারণ করে দেননি আল্লাহ তাআলা। তবে হাদিসে উল্লিখিত বিভিন্ন ইঙ্গিতপূর্ণ কথা থেকে বোঝা যায়, শবে কদর রমজানের শেষ দশকে হয়ে থাকে। বিশেষ করে বিজোড় রাতগুলোর যেকোনো একটি শবে কদর হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। এভাবে শবে কদরের অবস্থান রহস্যপূর্ণ রাখার কারণ হলো, বান্দা যেন রমজানের শেষ দিনগুলোতে বেশি করে আল্লাহর ইবাদতে লিপ্ত হয় এবং তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। সুতরাং হাজার বছরের চেয়ে সেরা রাতের ফজিলত পেতে হলে এই ১০ দিন নিজেকে ইবাদতে জুড়ে রাখার কোনো বিকল্প নেই। তবেই পাওয়া যাবে জিবরাইল (আ.)-এর নেতৃত্বে পৃথিবীর বুকে নেমে আসা এক ঝাঁক ফেরেশতার শুভ্র পরশ। পাওয়া যাবে ফজর পর্যন্ত পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে দেওয়া আল্লাহ তাআলার বিশেষ প্রশান্তির নিয়ামত। পাওয়া যাবে পরকালীন মুক্তির দিশা। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘এ রাতে ফেরেশতাগণ ও জিবরাইল প্রতি কাজে তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে অবতীর্ণ হয়। এ রাত (আদ্যোপান্ত) শান্তি ফজর হওয়া পর্যন্ত।’ (সুরা কদর: ৪)

রাতের জায়নামাজে রহমত প্রার্থনা

রোজার কারণে রমজানের দিনগুলো যেমন আল্লাহ তাআলার কাছে অত্যন্ত প্রিয়, তেমনি রাতগুলোও তাঁর কাছে অত্যন্ত প্রিয়। বান্দা সারা দিন রোজা রাখার পরও দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে রাত জেগে তারাবি, কিয়ামুল লাইল ও তাহাজ্জুদ আদায় করেন, তখন আল্লাহ তাআলা অত্যন্ত আনন্দিত হন। তাঁর রহমতের ভান্ডার নিয়ে নেমে আসেন নিচের আকাশে। ডাক দিয়ে বান্দার প্রয়োজনের কথা জিজ্ঞেস করেন। ক্ষমার বার্তা ছড়িয়ে দেন। হাদিসে এসেছে, মহানবী (সা.) বলেন, প্রতি রাত্রে শেষ তৃতীয়াংশে আমাদের মর্যাদাবান বরকতের মালিক ও মহান প্রতিপালক দুনিয়ার আকাশে নেমে আসেন এবং বলেন—যে আমাকে ডাকবে, আমি তার ডাকে সাড়া দেব। যে আমার কাছে কিছু প্রার্থনা করবে, আমি তাকে তা দান করব। যে আমার কাছে মাফ চাইবে, আমি তাকে মাফ করে দেব।’ (বুখারি ও মুসলিম) তাই রমজানের শেষ দশকে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়ার সেরা মাধ্যম হতে পারে শেষ রাতের তাহাজ্জুদ।

মানুষের সেবা শ্রেষ্ঠতম ইবাদত

দান-সদকা ও সাহায্য-সহযোগিতার মাধ্যমে মানুষের পাশে দাঁড়ানো রমজানের শেষ দশকের অন্যতম সেরা আমল। বিশেষ করে জাকাত, ফিতরা, সাধারণ দানের সেরা মৌসুম এটি। এমনিতেই রমজানে প্রতিটি ভালো কাজের সওয়াব ৭০ গুণ বেশি, তো এ সময়ে দান-সদকা করলে একদিকে যেমন দাতার সওয়াবের ঝুলি সমৃদ্ধ হয়, তেমনি সমাজের অসহায়-গরিব মানুষেরা একটু ভালো খেয়ে-পরে রোজা রাখতে পারে এবং ঈদের দিনটি আনন্দে উদ্‌যাপন করতে পারে। তাই ইবাদত কেবল নামাজ রোজায় সীমাবদ্ধ না রেখে দানের হাতও প্রসারিত করতে হবে। মহানবী (সা.) রমজানে সর্বাধিক দান-সদকা করতেন। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) পবিত্র রমজান মাসে বিপুল পরিমাণে দান করতেন। (সুনানে তিরমিজি: ২৩৫১)

ক্ষমাহীন এ জীবন অভিশপ্ত

রমজানের মতো ফজিলতের মাস পেয়েও আল্লাহর কাছে তওবা করে ক্ষমা পাওয়ার সৌভাগ্য যার হয়নি, সে পৃথিবীর সবচেয়ে অভিশপ্ত ব্যক্তি। ক্ষমাহীন এই অভিশপ্ত জীবনে কোনো প্রশান্তি নেই। পরকালের অনন্ত জীবনেও নেই কোনো শান্তির বার্তা। হাদিসে এসেছে, হজরত মুহাম্মদ (সা.) একদিন মসজিদের মিম্বারে পা রেখে বলে উঠলেন, ‘আমিন।’ এভাবে পরের দুই কদমেও আমিন বললেন। সাহাবায়ে কেরাম অবাক হলেন। তাঁরা রাসুলের এমন কাণ্ড আগে কখনো দেখেননি। খুতবা শেষ হলে তিনি মিম্বার থেকে নামলেন। সাহাবায়ে কেরাম কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল, আপনাকে তো আগে কখনো এমনটা করতে দেখিনি। আজ কেন এমন অদ্ভুত আচরণ করলেন?’ জবাবে রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘আমি যখন প্রথম সিঁড়িতে পা রাখলাম, তখন জিবরাইল (আ.) উপস্থিত হয়ে বললেন—ধ্বংস হোক ওই ব্যক্তি, যে রমজান মাস পেয়েও অতীতের গুনাহ মাফ করাতে পারল না। তখন আমি বললাম, আমিন।’ এরপর অন্য দুই ‘আমিন’-এরও ব্যাখ্যা দিলেন। (বায়হাকি)

সুতরাং আজই প্রতিজ্ঞা করি, জাগতিক ব্যস্ততা কমিয়ে রমজানের বাকি ১০টি দিন নিভৃতে আল্লাহর ইবাদত করি এবং তাঁর কাছে ক্ষমা চেয়ে জীবনকে পরিশুদ্ধ করি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত