ড. আলি আস-সাল্লাবি
পাখির উড়াল-কৌশলের গভীর পর্যবেক্ষণ একজন মানুষকে পূর্ণরূপে বিশ্বাসী হতে এবং আল্লাহর আনুগত্যে নিজেকে সঁপে দিতে সাহায্য করে। আল্লাহ তাআলা সর্বোৎকৃষ্ট সৃজনশীলতার অধিকারী এবং পাখি তাঁর এক আশ্চর্য সৃষ্টি। আজকের দিনে পাখি-বিশেষজ্ঞরা এমন এক সত্যে উপনীত হয়েছেন, যা জানলে অবিশ্বাসী মানুষও আল্লাহর মহিমা ও শক্তিমত্তায় বিশ্বাস স্থাপন করতে বাধ্য হবেন। আকার-আকৃতি ও রঙের কারণেই কেবল পাখিরা বৈচিত্র্যময় নয়; বরং উড়াল-শৈলীতেও এক পাখি আরেক পাখি থেকে ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। আকাশে ওড়ার কৌশল আবিষ্কার করতে বিজ্ঞানীরা হাজার বছর ধরে গবেষণায় বুঁদ হয়ে ছিলেন। প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ ওড়ার স্বপ্ন দেখে এসেছে; তবে বিংশ শতাব্দীর শুরুতে এসেই উড়োজাহাজ আবিষ্কারের মাধ্যমে তা পূর্ণতা লাভ করেছে।
শূন্যে উড়াল দেওয়ার যে কৌশলগুলো রপ্ত করিয়ে আল্লাহ তাআলা পাখি সৃষ্টি করেছেন, পবিত্র কোরআনে সেগুলোর দিকে ইঙ্গিতপূর্ণ বিবরণ এসেছে। দুটি আয়াতের ভাষ্যে পাখিদের উড়াল-কৌশল আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়। আয়াত দুটিতে আলোচিত পাখির বৈশিষ্ট্যে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। নিচে আয়াত দুটি এবং বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরা হলো—
প্রথম আয়াত
আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘তারা কি তাদের ওপরের দিকে পাখিগুলোর প্রতি লক্ষ্য করে না, যারা ডানা মেলে ধরে আবার গুটিয়ে নেয় তথা ডানা ঝাপটিয়ে ওড়ে? দয়াময় ছাড়া অন্য কেউই তাদের স্থির রাখেন না। নিশ্চয়ই তিনি সবকিছুর সম্যক দ্রষ্টা।’ (সুরা মুলক, আয়াত: ১৯)
এ আয়াতের আলোকে পাখির উড়াল-কৌশল—
অবস্থান: ‘তাদের ওপরের দিকে’ অর্থাৎ, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের এমন স্তরে তারা চলাচল করে, যেখানে বায়ুচাপ ও অক্সিজেন বিদ্যমান থাকায় জীবনধারণ সম্ভব।
ধরন: ‘ডানা মেলে ধরে’ অর্থাৎ, প্রায় পুরো সময়জুড়েই তারা ডানা মেলে ধরে উড়তে থাকে। এ দৃশ্য মোটেও অপরিচিত নয়। তবে তা কেবল কয়েক ধরনের পাখির ক্ষেত্রে দেখা যায়।
মাধ্যম: ‘গুটিয়ে নেয়’ বা ‘ডানা ঝাপটিয়ে ওড়ে’ অর্থাৎ, মাধ্যাকর্ষণ শক্তির বিপরীতে ওড়ার সক্ষমতা অর্জনের মাধ্যম হলো ডানা মেলা এবং গুটানো।
এ ছাড়া আয়াতের ভাষ্য অনুযায়ী ‘দয়াময়’ই তাদের শূন্যে ধরে রাখেন।
দ্বিতীয় আয়াত
আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘তারা কি আকাশের শূন্যগর্ভে নিয়ন্ত্রণাধীন পাখিদের দিকে লক্ষ্য করে না? আল্লাহই ওদের স্থির রাখেন। অবশ্যই এতে বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য রয়েছে শিক্ষা।’ (সুরা নাহল, আয়াত: ৭৯)
এ আয়াতের আলোকে পাখির উড়াল-কৌশল
ধরন: ‘নিয়ন্ত্রণাধীন’ অর্থাৎ, আল্লাহ তাআলা মানুষের সেবায় তাদের নিয়োজিত রেখেছেন এবং মানুষই তাদের নিয়ন্ত্রণ করে। মালপত্রসহ মানুষকে বহন করে খুব দ্রুততার সঙ্গে তারা দূরের গন্তব্যে পৌঁছে দেয়। এ বৈশিষ্ট্য আগের আয়াতে উল্লিখিত পাখিদের বৈশিষ্ট্যের বিপরীত। কারণ সেগুলোর ব্যাপারে ‘নিয়ন্ত্রণাধীন’ তথা মানুষের নিয়ন্ত্রণে থাকার কথা বলা হয়নি।
অবস্থান: ‘আকাশের শূন্যগর্ভে’—এ শব্দদ্বয়ের মর্মে ভূপৃষ্ঠ বা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে আকাশের সর্বোচ্চ স্তরগুলো পর্যন্ত অন্তর্ভুক্ত আছে। উড়োজাহাজ যখন ৩৭ হাজার ফুট ওপরের আকাশ দিয়ে ওড়ে, তখন সেটি এমন কিছু বিশেষ স্থান অতিক্রম করে, যেখানে উড়োজাহাজের দরজা বা জানালা খোলা হলে এবং কৃত্রিম অক্সিজেন গ্রহণ করা না হলে সকল যাত্রীই তিন মিনিটের মধ্যে মারা যাবে। এ কথা প্রায় সব মানুষই জানে; বিশেষ করে নভোচারীরা এ তথ্য খুব ভালো করেই জানেন।
‘আল্লাহই তাদের শূন্যে স্থির রাখেন’—এখানে ‘আল্লাহ’র নামে স্থির রাখা ও সুরক্ষা দেওয়ার কথা এসেছে। আগের আয়াতে এসেছিল ‘দয়াময়’-এর নামে।
যাতায়াতের প্রধানতম মাধ্যম সামুদ্রিক জাহাজের ব্যাপারেও মানুষের নিয়ন্ত্রণে থাকার কথা কোরআনে এসেছে। সেটির ওপর ভিত্তি করে আমরা বলতে পারি, আকাশের শূন্যগর্ভে নিয়ন্ত্রণাধীন পাখির কথা বলে কোরআনে সূক্ষ্মভাবে আধুনিক যুগের অন্যতম যোগাযোগ মাধ্যম উড়োজাহাজের দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে।
মোটকথা আয়াত দুটি পবিত্র কোরআনের সায়েন্টিফিক মিরাকলগুলোর দুটি মিরাকলের দিকেই ইঙ্গিত করে। এক. নিয়ন্ত্রণাধীন পাখি এবং দুই. ডানা মেলে ধরা পাখি।
এক. নিয়ন্ত্রণাধীন পাখি
‘তারা কি আকাশের শূন্যগর্ভে নিয়ন্ত্রণাধীন পাখিদের লক্ষ্য করে না? আল্লাহই ওদের স্থির রাখেন’—এ আয়াতে পাখির দেহে এবং বায়ুস্রোতে আল্লাহ তাআলার সেট করে দেওয়া ফাংশনের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে, যার মাধ্যমে পাখিরা উড়তে পারে। পাখির আকাশে ওড়া এবং শূন্যে ভেসে বেড়ানোর জন্য দুটি উপাদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এক. হালকা ওজনের হওয়া এবং দুই. অতিমাত্রায় শক্তি ও বলপ্রয়োগ করা। এ ছাড়া দুটি ডানাও থাকা চাই, যা পাখিকে সহজভাবে আকাশে উড়তে এবং শূন্যে ভেসে বেড়াতে সহায়তা করে।
হালকা ওজন: পাখির ওড়ার ক্ষেত্রে এটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, যা পাখিদের দেহাবয়বে বিভিন্নভাবে বিদ্যমান। যেমন—
পালকের গঠন: জীবনের ধারাবাহিকতা রক্ষা করার জন্য পাখি তার পালকগুলো আবশ্যকভাবে পরিষ্কার রাখে এবং সব সময় উড়াল দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকে। পালকের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পাখি তার লেজের নিচে অবস্থিত তৈলাক্ত গ্রন্থির ব্যবহার করতে অভ্যস্ত। ওই তেলের মাধ্যমেই পাখিরা তাদের পালক পরিচ্ছন্ন ও ঝকঝকে রাখে। তেমনিভাবে সাঁতার কাটা, ডুব দেওয়া এবং বৃষ্টিমুখর আবহাওয়ায় চলাফেরা করার সময় সেই তেল তাদের পালকগুলোকে ভিজে যাওয়া থেকে রক্ষা করে।
কঙ্কাল: ফাঁপা ও হালকা হাড্ডি দিয়েই আল্লাহ পাখি সৃষ্টি করেছেন। তবে দেখতে কোমল মনে হলেও ভেতরের ভিত্তি মজবুত হওয়ার কারণে তা খুবই শক্ত। পাখির শ্বাসনালির সঙ্গে সংযুক্ত কিছু বায়বীয় শূন্যস্থান রয়েছে, যা তাদের শ্বাস নিতে, প্রাণবন্ত থাকতে এবং হালকা হতে সহায়তা করে। তেমনিভাবে তা অধিক পরিমাণে অক্সিজেন নেওয়ারও সুযোগ করে দেয়।
অতিমাত্রায় বলপ্রয়োগ: পাখি-দেহের এরোডাইনামিক আকৃতি তাকে তুলনামূলক কম প্রতিরোধের মাধ্যমে বাতাসের স্রোত কাটতে সহায়তা করে। শূন্যে উড়াল দিতে এবং সামনের দিকে এগিয়ে যেতে তার পাখাগুলির অবদানও কম নয়।
দুই. ডানা মেলে ধরা পাখি
পাখির উড়াল-কৌশলে এমন সব অবাক করা শিক্ষা রয়েছে, যা কেবল অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং তথা উড্ডয়ন প্রকৌশল এবং ডাইনামিক্স তথা গতিবিদ্যার সমৃদ্ধি ও উৎকর্ষের কারণেই মানুষের সামনে এসেছে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, দুটি শান্ত ডানার সাহায্যেই, নাড়াচাড়া না করেই পাখিরা শূন্যে উড়তে পারে, এমনকি তারা উড়তে উড়তে দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যেতে পারে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তারা কি তাদের ওপর দিকে পাখিগুলো লক্ষ করে না, যারা ডানা মেলে ধরে আবার গুটিয়ে নেয় তথা ডানা ঝাপটিয়ে ওড়ে? দয়াময় ছাড়া অন্য কেউই তাদের ধরে রাখে না। নিশ্চয়ই তিনি সবকিছু ভালোভাবে দেখেন।’ (সুরা মুলক, আয়াত: ১৯)
বিজ্ঞান বলে, ডানা মেলে ধরা পাখিগুলো এমন সহায়ক বায়ুস্রোতে ভেসে বেড়ায়, যেটি কোনো প্রতিবন্ধকের সঙ্গে বাতাসের সংঘর্ষের কারণে অথবা উষ্ণ বায়ুর কলামগুলো ওপরে ওঠার ফলে সৃষ্টি হয়। বায়ু শান্ত থাকলে কলামগুলো দাঁড়িয়ে থাকে এবং পাখিরা ডানা মেলে ধরে সর্পিল গতিতে ওড়ে। বায়ুপ্রবাহ প্রবল হলে কলামগুলো অনুভূমিক হয়ে উল্টে যায়; তখন পাখিরা লম্বা সরলরেখায় ডানা মেলে ধরে উড়ে চলে। বিজ্ঞান আরও জানায়, প্রত্যেক পাখি যখন ডানা ঝাপটায়, তখন তা তার ঠিক পেছনের পাখিটি থেকে এক স্তর ওপরে উঠে যায় এবং এর ওপর ভিত্তি করেই পরিযায়ী পাখিরা (আল্লাহর ইশারায়) সম্মিলিতভাবে ইংরেজি ভি আকৃতি ধারণ করে। এ পদ্ধতিতে তারা একা পথচলা পাখির তুলনায় কমপক্ষে ৭১ শতাংশ বেশি দ্রুতবেগে পথ চলতে পারে। সেই গতিপথ থেকে কোনো পাখি বের হয়ে গেলে হঠাৎ সে মাধ্যাকর্ষণ ও বায়ুপ্রবাহের শক্ত প্রতিরোধের মুখে পড়ে। তাই সে দ্রুতই দলীয় সিকুয়েন্সে ফিরে আসে, যাতে সংঘবদ্ধতার শক্তি ও সহায়তার নাগাল পায়। তাদের দলনেতা যখন বাতাস প্রতিরোধ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে, তখন সে পেছনে চলে যায় এবং অন্য একজন দলনেতার জন্য নেতৃত্বের জায়গা ছেড়ে দেয়। এভাবেই পর্যায়ক্রমে তারা নেতৃত্ব দিয়ে থাকে। ওড়ার সময় পেছনের সদস্যরা সামনের সদস্যদের উৎসাহ জোগাতে বিরামহীন চিৎকার-চেঁচামেচি করতে থাকে।
পাখিদের উড়াল-কৌশল তথা ডানা মেলে ধরা এবং ডানা ঝাপটানো-ই আধুনিক বিজ্ঞানের অন্যতম শাখা অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মূল ভিত্তি। একশো বছর আগেও এ সত্য মানুষের অজানা ছিল; অথচ সে বিষয়ে কোরআন আগেই ইঙ্গিত করেছে। তাই এ তত্ত্বকে আমরা কোরআনের অন্যতম সায়েন্টিফিক মিরাকল দাবি করতেই পারি।
ডানা মেলে ধরার অর্থ পাখির দুই ডানা নাড়াচাড়া না করে সোজাসুজি মেলে ধরা। দূরের পথ পাড়ি দিতে পাখি শূন্যে ভেসে বেড়ায়—চলা বা ওপরে ওঠার সময় তারা বায়ুস্রোতের সাহায্য নেয় এবং ধীরে অবতরণের সময় মাধ্যাকর্ষণের সাহায্য নেয়। শূন্যে ভেসে বেড়াতে তার ডানা ঝাপটানো তথা অনবরত ওপর-নিচ করার প্রয়োজন পড়ে না। প্রথমবারের ঝাপটানো তাকে সামনের দিকে নিয়ে যায় এবং দ্বিতীয়বার ঝাপটানো তাকে ওপরের দিকে তুলে দেয়; এরপর সে পাখা মেলে ধরে ভেসে চলে।
বিজ্ঞান নিশ্চিত করে যে, পাখির ডানাই উড়োজাহাজ তৈরির ক্ষেত্রে রোলমডেল হিসেবে কাজ করেছে। ধারাবাহিক ওড়ার জন্য কিছু পাখির ডানা ছোট ও মজবুত হয়। দ্রুত গতিতে উড়ার জন্য কিছুর ডানা চিকন ও ধারালো হয়। ওপরে ওঠার সুবিধার্থে কিছু পাখা লম্বা ও প্রশস্ত হয়। বায়ুমণ্ডলে সহজে ভেসে বেড়ানোর জন্য কিছু পাখা চিকন ও লম্বা হয়। পাখিদের উড়াল-কৌশল গবেষণা করেই আজকের দিনে বিভিন্ন মডেলের উড়োজাহাজ তৈরি হচ্ছে।
আল্লাহর তাআলা প্রত্যেক পাখির দেহকেই ওড়ার জন্য পূর্ণ উপযোগী করে সৃষ্টি করেছেন এবং প্রয়োজনীয় সকল উপাদান তাতে সরবরাহ করেছেন। কিছু পাখি কয়েক মাস ধরে আকাশে উড়তে থাকে; শূন্যেই তারা খাওয়া-দাওয়া করে এবং ঘুমোয়। এই ঐশ্বরিক উড়াল-কৌশল দেখেই বিজ্ঞানীরা উড়োজাহাজ তৈরি করেছেন এবং এই প্রযুক্তিকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।
ড. আলি আস-সাল্লাবি: লিবিয়ান ইতিহাসবিদ, ইসলামি আইনবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
আল-জাজিরা আরবি থেকে অনূদিত
অনুবাদ: ইজাজুল হক
পাখির উড়াল-কৌশলের গভীর পর্যবেক্ষণ একজন মানুষকে পূর্ণরূপে বিশ্বাসী হতে এবং আল্লাহর আনুগত্যে নিজেকে সঁপে দিতে সাহায্য করে। আল্লাহ তাআলা সর্বোৎকৃষ্ট সৃজনশীলতার অধিকারী এবং পাখি তাঁর এক আশ্চর্য সৃষ্টি। আজকের দিনে পাখি-বিশেষজ্ঞরা এমন এক সত্যে উপনীত হয়েছেন, যা জানলে অবিশ্বাসী মানুষও আল্লাহর মহিমা ও শক্তিমত্তায় বিশ্বাস স্থাপন করতে বাধ্য হবেন। আকার-আকৃতি ও রঙের কারণেই কেবল পাখিরা বৈচিত্র্যময় নয়; বরং উড়াল-শৈলীতেও এক পাখি আরেক পাখি থেকে ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। আকাশে ওড়ার কৌশল আবিষ্কার করতে বিজ্ঞানীরা হাজার বছর ধরে গবেষণায় বুঁদ হয়ে ছিলেন। প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ ওড়ার স্বপ্ন দেখে এসেছে; তবে বিংশ শতাব্দীর শুরুতে এসেই উড়োজাহাজ আবিষ্কারের মাধ্যমে তা পূর্ণতা লাভ করেছে।
শূন্যে উড়াল দেওয়ার যে কৌশলগুলো রপ্ত করিয়ে আল্লাহ তাআলা পাখি সৃষ্টি করেছেন, পবিত্র কোরআনে সেগুলোর দিকে ইঙ্গিতপূর্ণ বিবরণ এসেছে। দুটি আয়াতের ভাষ্যে পাখিদের উড়াল-কৌশল আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়। আয়াত দুটিতে আলোচিত পাখির বৈশিষ্ট্যে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। নিচে আয়াত দুটি এবং বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরা হলো—
প্রথম আয়াত
আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘তারা কি তাদের ওপরের দিকে পাখিগুলোর প্রতি লক্ষ্য করে না, যারা ডানা মেলে ধরে আবার গুটিয়ে নেয় তথা ডানা ঝাপটিয়ে ওড়ে? দয়াময় ছাড়া অন্য কেউই তাদের স্থির রাখেন না। নিশ্চয়ই তিনি সবকিছুর সম্যক দ্রষ্টা।’ (সুরা মুলক, আয়াত: ১৯)
এ আয়াতের আলোকে পাখির উড়াল-কৌশল—
অবস্থান: ‘তাদের ওপরের দিকে’ অর্থাৎ, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের এমন স্তরে তারা চলাচল করে, যেখানে বায়ুচাপ ও অক্সিজেন বিদ্যমান থাকায় জীবনধারণ সম্ভব।
ধরন: ‘ডানা মেলে ধরে’ অর্থাৎ, প্রায় পুরো সময়জুড়েই তারা ডানা মেলে ধরে উড়তে থাকে। এ দৃশ্য মোটেও অপরিচিত নয়। তবে তা কেবল কয়েক ধরনের পাখির ক্ষেত্রে দেখা যায়।
মাধ্যম: ‘গুটিয়ে নেয়’ বা ‘ডানা ঝাপটিয়ে ওড়ে’ অর্থাৎ, মাধ্যাকর্ষণ শক্তির বিপরীতে ওড়ার সক্ষমতা অর্জনের মাধ্যম হলো ডানা মেলা এবং গুটানো।
এ ছাড়া আয়াতের ভাষ্য অনুযায়ী ‘দয়াময়’ই তাদের শূন্যে ধরে রাখেন।
দ্বিতীয় আয়াত
আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘তারা কি আকাশের শূন্যগর্ভে নিয়ন্ত্রণাধীন পাখিদের দিকে লক্ষ্য করে না? আল্লাহই ওদের স্থির রাখেন। অবশ্যই এতে বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য রয়েছে শিক্ষা।’ (সুরা নাহল, আয়াত: ৭৯)
এ আয়াতের আলোকে পাখির উড়াল-কৌশল
ধরন: ‘নিয়ন্ত্রণাধীন’ অর্থাৎ, আল্লাহ তাআলা মানুষের সেবায় তাদের নিয়োজিত রেখেছেন এবং মানুষই তাদের নিয়ন্ত্রণ করে। মালপত্রসহ মানুষকে বহন করে খুব দ্রুততার সঙ্গে তারা দূরের গন্তব্যে পৌঁছে দেয়। এ বৈশিষ্ট্য আগের আয়াতে উল্লিখিত পাখিদের বৈশিষ্ট্যের বিপরীত। কারণ সেগুলোর ব্যাপারে ‘নিয়ন্ত্রণাধীন’ তথা মানুষের নিয়ন্ত্রণে থাকার কথা বলা হয়নি।
অবস্থান: ‘আকাশের শূন্যগর্ভে’—এ শব্দদ্বয়ের মর্মে ভূপৃষ্ঠ বা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে আকাশের সর্বোচ্চ স্তরগুলো পর্যন্ত অন্তর্ভুক্ত আছে। উড়োজাহাজ যখন ৩৭ হাজার ফুট ওপরের আকাশ দিয়ে ওড়ে, তখন সেটি এমন কিছু বিশেষ স্থান অতিক্রম করে, যেখানে উড়োজাহাজের দরজা বা জানালা খোলা হলে এবং কৃত্রিম অক্সিজেন গ্রহণ করা না হলে সকল যাত্রীই তিন মিনিটের মধ্যে মারা যাবে। এ কথা প্রায় সব মানুষই জানে; বিশেষ করে নভোচারীরা এ তথ্য খুব ভালো করেই জানেন।
‘আল্লাহই তাদের শূন্যে স্থির রাখেন’—এখানে ‘আল্লাহ’র নামে স্থির রাখা ও সুরক্ষা দেওয়ার কথা এসেছে। আগের আয়াতে এসেছিল ‘দয়াময়’-এর নামে।
যাতায়াতের প্রধানতম মাধ্যম সামুদ্রিক জাহাজের ব্যাপারেও মানুষের নিয়ন্ত্রণে থাকার কথা কোরআনে এসেছে। সেটির ওপর ভিত্তি করে আমরা বলতে পারি, আকাশের শূন্যগর্ভে নিয়ন্ত্রণাধীন পাখির কথা বলে কোরআনে সূক্ষ্মভাবে আধুনিক যুগের অন্যতম যোগাযোগ মাধ্যম উড়োজাহাজের দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে।
মোটকথা আয়াত দুটি পবিত্র কোরআনের সায়েন্টিফিক মিরাকলগুলোর দুটি মিরাকলের দিকেই ইঙ্গিত করে। এক. নিয়ন্ত্রণাধীন পাখি এবং দুই. ডানা মেলে ধরা পাখি।
এক. নিয়ন্ত্রণাধীন পাখি
‘তারা কি আকাশের শূন্যগর্ভে নিয়ন্ত্রণাধীন পাখিদের লক্ষ্য করে না? আল্লাহই ওদের স্থির রাখেন’—এ আয়াতে পাখির দেহে এবং বায়ুস্রোতে আল্লাহ তাআলার সেট করে দেওয়া ফাংশনের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে, যার মাধ্যমে পাখিরা উড়তে পারে। পাখির আকাশে ওড়া এবং শূন্যে ভেসে বেড়ানোর জন্য দুটি উপাদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এক. হালকা ওজনের হওয়া এবং দুই. অতিমাত্রায় শক্তি ও বলপ্রয়োগ করা। এ ছাড়া দুটি ডানাও থাকা চাই, যা পাখিকে সহজভাবে আকাশে উড়তে এবং শূন্যে ভেসে বেড়াতে সহায়তা করে।
হালকা ওজন: পাখির ওড়ার ক্ষেত্রে এটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, যা পাখিদের দেহাবয়বে বিভিন্নভাবে বিদ্যমান। যেমন—
পালকের গঠন: জীবনের ধারাবাহিকতা রক্ষা করার জন্য পাখি তার পালকগুলো আবশ্যকভাবে পরিষ্কার রাখে এবং সব সময় উড়াল দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকে। পালকের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পাখি তার লেজের নিচে অবস্থিত তৈলাক্ত গ্রন্থির ব্যবহার করতে অভ্যস্ত। ওই তেলের মাধ্যমেই পাখিরা তাদের পালক পরিচ্ছন্ন ও ঝকঝকে রাখে। তেমনিভাবে সাঁতার কাটা, ডুব দেওয়া এবং বৃষ্টিমুখর আবহাওয়ায় চলাফেরা করার সময় সেই তেল তাদের পালকগুলোকে ভিজে যাওয়া থেকে রক্ষা করে।
কঙ্কাল: ফাঁপা ও হালকা হাড্ডি দিয়েই আল্লাহ পাখি সৃষ্টি করেছেন। তবে দেখতে কোমল মনে হলেও ভেতরের ভিত্তি মজবুত হওয়ার কারণে তা খুবই শক্ত। পাখির শ্বাসনালির সঙ্গে সংযুক্ত কিছু বায়বীয় শূন্যস্থান রয়েছে, যা তাদের শ্বাস নিতে, প্রাণবন্ত থাকতে এবং হালকা হতে সহায়তা করে। তেমনিভাবে তা অধিক পরিমাণে অক্সিজেন নেওয়ারও সুযোগ করে দেয়।
অতিমাত্রায় বলপ্রয়োগ: পাখি-দেহের এরোডাইনামিক আকৃতি তাকে তুলনামূলক কম প্রতিরোধের মাধ্যমে বাতাসের স্রোত কাটতে সহায়তা করে। শূন্যে উড়াল দিতে এবং সামনের দিকে এগিয়ে যেতে তার পাখাগুলির অবদানও কম নয়।
দুই. ডানা মেলে ধরা পাখি
পাখির উড়াল-কৌশলে এমন সব অবাক করা শিক্ষা রয়েছে, যা কেবল অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং তথা উড্ডয়ন প্রকৌশল এবং ডাইনামিক্স তথা গতিবিদ্যার সমৃদ্ধি ও উৎকর্ষের কারণেই মানুষের সামনে এসেছে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, দুটি শান্ত ডানার সাহায্যেই, নাড়াচাড়া না করেই পাখিরা শূন্যে উড়তে পারে, এমনকি তারা উড়তে উড়তে দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যেতে পারে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তারা কি তাদের ওপর দিকে পাখিগুলো লক্ষ করে না, যারা ডানা মেলে ধরে আবার গুটিয়ে নেয় তথা ডানা ঝাপটিয়ে ওড়ে? দয়াময় ছাড়া অন্য কেউই তাদের ধরে রাখে না। নিশ্চয়ই তিনি সবকিছু ভালোভাবে দেখেন।’ (সুরা মুলক, আয়াত: ১৯)
বিজ্ঞান বলে, ডানা মেলে ধরা পাখিগুলো এমন সহায়ক বায়ুস্রোতে ভেসে বেড়ায়, যেটি কোনো প্রতিবন্ধকের সঙ্গে বাতাসের সংঘর্ষের কারণে অথবা উষ্ণ বায়ুর কলামগুলো ওপরে ওঠার ফলে সৃষ্টি হয়। বায়ু শান্ত থাকলে কলামগুলো দাঁড়িয়ে থাকে এবং পাখিরা ডানা মেলে ধরে সর্পিল গতিতে ওড়ে। বায়ুপ্রবাহ প্রবল হলে কলামগুলো অনুভূমিক হয়ে উল্টে যায়; তখন পাখিরা লম্বা সরলরেখায় ডানা মেলে ধরে উড়ে চলে। বিজ্ঞান আরও জানায়, প্রত্যেক পাখি যখন ডানা ঝাপটায়, তখন তা তার ঠিক পেছনের পাখিটি থেকে এক স্তর ওপরে উঠে যায় এবং এর ওপর ভিত্তি করেই পরিযায়ী পাখিরা (আল্লাহর ইশারায়) সম্মিলিতভাবে ইংরেজি ভি আকৃতি ধারণ করে। এ পদ্ধতিতে তারা একা পথচলা পাখির তুলনায় কমপক্ষে ৭১ শতাংশ বেশি দ্রুতবেগে পথ চলতে পারে। সেই গতিপথ থেকে কোনো পাখি বের হয়ে গেলে হঠাৎ সে মাধ্যাকর্ষণ ও বায়ুপ্রবাহের শক্ত প্রতিরোধের মুখে পড়ে। তাই সে দ্রুতই দলীয় সিকুয়েন্সে ফিরে আসে, যাতে সংঘবদ্ধতার শক্তি ও সহায়তার নাগাল পায়। তাদের দলনেতা যখন বাতাস প্রতিরোধ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে, তখন সে পেছনে চলে যায় এবং অন্য একজন দলনেতার জন্য নেতৃত্বের জায়গা ছেড়ে দেয়। এভাবেই পর্যায়ক্রমে তারা নেতৃত্ব দিয়ে থাকে। ওড়ার সময় পেছনের সদস্যরা সামনের সদস্যদের উৎসাহ জোগাতে বিরামহীন চিৎকার-চেঁচামেচি করতে থাকে।
পাখিদের উড়াল-কৌশল তথা ডানা মেলে ধরা এবং ডানা ঝাপটানো-ই আধুনিক বিজ্ঞানের অন্যতম শাখা অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মূল ভিত্তি। একশো বছর আগেও এ সত্য মানুষের অজানা ছিল; অথচ সে বিষয়ে কোরআন আগেই ইঙ্গিত করেছে। তাই এ তত্ত্বকে আমরা কোরআনের অন্যতম সায়েন্টিফিক মিরাকল দাবি করতেই পারি।
ডানা মেলে ধরার অর্থ পাখির দুই ডানা নাড়াচাড়া না করে সোজাসুজি মেলে ধরা। দূরের পথ পাড়ি দিতে পাখি শূন্যে ভেসে বেড়ায়—চলা বা ওপরে ওঠার সময় তারা বায়ুস্রোতের সাহায্য নেয় এবং ধীরে অবতরণের সময় মাধ্যাকর্ষণের সাহায্য নেয়। শূন্যে ভেসে বেড়াতে তার ডানা ঝাপটানো তথা অনবরত ওপর-নিচ করার প্রয়োজন পড়ে না। প্রথমবারের ঝাপটানো তাকে সামনের দিকে নিয়ে যায় এবং দ্বিতীয়বার ঝাপটানো তাকে ওপরের দিকে তুলে দেয়; এরপর সে পাখা মেলে ধরে ভেসে চলে।
বিজ্ঞান নিশ্চিত করে যে, পাখির ডানাই উড়োজাহাজ তৈরির ক্ষেত্রে রোলমডেল হিসেবে কাজ করেছে। ধারাবাহিক ওড়ার জন্য কিছু পাখির ডানা ছোট ও মজবুত হয়। দ্রুত গতিতে উড়ার জন্য কিছুর ডানা চিকন ও ধারালো হয়। ওপরে ওঠার সুবিধার্থে কিছু পাখা লম্বা ও প্রশস্ত হয়। বায়ুমণ্ডলে সহজে ভেসে বেড়ানোর জন্য কিছু পাখা চিকন ও লম্বা হয়। পাখিদের উড়াল-কৌশল গবেষণা করেই আজকের দিনে বিভিন্ন মডেলের উড়োজাহাজ তৈরি হচ্ছে।
আল্লাহর তাআলা প্রত্যেক পাখির দেহকেই ওড়ার জন্য পূর্ণ উপযোগী করে সৃষ্টি করেছেন এবং প্রয়োজনীয় সকল উপাদান তাতে সরবরাহ করেছেন। কিছু পাখি কয়েক মাস ধরে আকাশে উড়তে থাকে; শূন্যেই তারা খাওয়া-দাওয়া করে এবং ঘুমোয়। এই ঐশ্বরিক উড়াল-কৌশল দেখেই বিজ্ঞানীরা উড়োজাহাজ তৈরি করেছেন এবং এই প্রযুক্তিকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।
ড. আলি আস-সাল্লাবি: লিবিয়ান ইতিহাসবিদ, ইসলামি আইনবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
আল-জাজিরা আরবি থেকে অনূদিত
অনুবাদ: ইজাজুল হক
আল্লাহর ভালোবাসা পাওয়া মুমিনের সবচেয়ে বড় অর্জন। তাঁর প্রিয় হতে চাইলে তাঁর আনুগত্য করতে হবে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা কিছু গুণের কথা বলেছেন, যা অর্জনকারীকে তিনি ভালোবাসেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন।
১৮ মিনিট আগেসন্ধ্যাবেলার কিছু গুরুত্বপূর্ণ আমল রয়েছে। মহানবী (সা.) সাহাবিদের এসব আমল করার উপদেশ দিতেন। এখানে কয়েকটি আমলের
১ দিন আগেইবাদতের নিয়তে করা সব কাজই নেক আমলের অন্তর্ভুক্ত। আর নেক আমল মানুষের জীবনের প্রকৃত সম্পদ। এর মাধ্যমে পাওয়া যাবে জান্নাত। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘এবং যারা ইমান এনেছে ও সৎকর্ম করেছে, তারাই জান্নাতের অধিকারী, তারা সেখানে চিরকাল থাকবে।’ (সুরা বাকারা: ৮২)
২ দিন আগেভ্রমণের সময় নামাজের ক্ষেত্রে বিশেষ ছাড় দিয়েছে ইসলাম। কোনো ব্যক্তি নিজের আবাসস্থল থেকে ৪৮ মাইল তথা ৭৮ কিলোমিটার দূরের কোনো গন্তব্যে ভ্রমণের নিয়তে বের হয়ে তাঁর এলাকা পেরিয়ে গেলেই শরিয়তের দৃষ্টিতে সে মুসাফির হয়ে যায়। (জাওয়াহিরুল ফিকহ: ১/৪৩৬)
৩ দিন আগে