ইসলামে প্রতিবন্ধীর বিশেষ মর্যাদা

ইজাজুল হক, ঢাকা
প্রকাশ : ০১ ডিসেম্বর ২০২১, ১৫: ৪২

প্রতিবন্ধীরা সমাজের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তাদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করা এবং অন্য দশজন মানুষের মতো তাদের সঙ্গে সম্মানজনক আচরণ করা মোমিনের জন্য অপরিহার্য। তাদের নিয়ে হাসি-ঠাট্টা ও রসিকতা করা কঠিন অপরাধ। তাদের নাগরিক মর্যাদা ও অধিকার নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন রাসুল (সা.)। 

একমাত্র আল্লাহ তাআলাই পূর্ণাঙ্গ এবং সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী—মানুষের ভেতর এই অনুভূতি জাগ্রত করতেই পৃথিবীতে তিনি স্বাভাবিকের পাশাপাশি কিছু ব্যতিক্রম মানুষও সৃষ্টি করেছেন। স্বাভাবিক মানুষগুলো যেন তা থেকে শিক্ষাগ্রহণ করে এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ হয়। আর যাদের পূর্ণতা দেননি, তাদের জন্য বিনিময়ে রেখেছেন তাঁর সন্তুষ্টি, দয়া, ক্ষমা এবং জান্নাতের অফুরন্ত নেয়ামত। হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি যার দুই প্রিয় বস্তু (দুই চোখ) নিয়ে নিই, অতঃপর সে ধৈর্য ধরে এবং নেকির আশা করে, তাহলে আমি তার জন্য এর বিনিময়ে জান্নাত ছাড়া অন্য কিছুতে সন্তুষ্ট হই না।’ (তিরমিজি, হাদিস: ২৪০১) 

আল্লাহর কাছে প্রতিবন্ধীর মর্যাদা অনেক বেশি। প্রতিবন্ধীর প্রতি ভ্রুক্ষেপ করতে দেরি করার কারণে স্বয়ং রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে আল্লাহ তাআলা মৃদু তিরস্কারের সুরে কথা বলেছেন। একদিন রাসুল (সা) কুরাইশ নেতাদের সঙ্গে কথা বলছিলেন। এমন সময় অন্ধ সাহাবি আবদুল্লাহ বিন উম্মে মাকতুম (রা.) এসে রাসুল (সা.)-কে কিছু বিষয়ে প্রশ্ন করেন। রাসুল (সা.) অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেন। কুরাইশ নেতাদের সামনে এভাবে চলে আসা তিনি অপছন্দ করেন। কিন্তু আবদুল্লাহ বিন উম্মে মাকতুম (রা.) দৃষ্টিহীন হওয়ায় তা আঁচ করতে পারেননি। কিছুক্ষণ পরই এ বিষয়ে আয়াত নাজিল হয়। আল্লাহ বলেন, ‘তিনি ভ্রু কুঞ্চিত করেছেন এবং মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। কারণ, তার কাছে অন্ধ লোকটি এসেছে।’ (সুরা আবাসা, আয়াত: ১-২) 

এ ঘটনার পর থেকে আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুমের সঙ্গে দেখা হলে নবী করিম (সা.) বলতেন, ‘তাকে স্বাগতম, যার ব্যাপারে আমার রব আমাকে তিরস্কার করেছেন।’ (তাফসিরে কুরতুবি: ১৯ / ১৮৪) 

প্রতিবন্ধী ও অক্ষম ব্যক্তিদের জন্য শরিয়তের বিধিবিধান পালনে ছাড় দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেক ফরজ বিধান তাদের সাধ্যের ওপর নির্ভর করবে। তাই নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত ও জিহাদের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিধানগুলো প্রতিবন্ধীদের জন্য পালন করা আবশ্যক নয়। মানসিক ভারসাম্যহীন হলে তো কোনো বিধানই তার জন্য প্রযোজ্য নয়। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘তিন ব্যক্তি থেকে কলম উঠিয়ে রাখা হয়েছে অর্থাৎ, বিধিবিধান প্রয়োগ করা থেকে বিরত রাখা হয়েছে। ঘুমন্ত ব্যক্তি যতক্ষণ না সে জাগ্রত হয়, নাবালেগ যতক্ষণ না সে বালেগ হয় এবং পাগল যতক্ষণ না সে জ্ঞান ফিরে পায় বা সুস্থ হয়।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস: ২০৪১) 

প্রতিবন্ধীর প্রতি সহায়তার হাত না বাড়িয়ে বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া, কষ্ট দেওয়া এবং উপহাস করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। হাদিসে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে অন্ধকে পথ ভুলিয়ে দেয় সে অভিশপ্ত।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস: ১৮৭৫) 

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর অনুসরণ করে মুসলিম খলিফারাও প্রতিবন্ধীদের যত্ন নেন। তাদের শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক চাহিদা পূরণ করেন। দ্বিতীয় খলিফা ওমর (রা.) সামাজিক নিরাপত্তাবিষয়ক নীতিমালা প্রণয়ন করে সমাজের অসহায়-প্রতিবন্ধী লোকদের নাম তাতে যুক্ত করার ব্যবস্থা করেন এবং প্রত্যেকের জন্য নির্ধারিত পরিমাণ ভাতার ব্যবস্থা করেন। খলিফা ওমর ইবনে আবদুল আজিজ সব প্রদেশে প্রতিবন্ধীদের তালিকা তৈরির ফরমান জারি করেন। প্রতি দুজন প্রতিবন্ধীর দেখভালের জন্য একজন খাদেম নিযুক্ত করেন। উমাইয়া খলিফা ওয়ালিদ প্রতিবন্ধীদের জন্য সর্বপ্রথম বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সেবাকেন্দ্র চালু করেন। 

মুসলিম সমাজব্যবস্থায় প্রতিবন্ধীর দায়িত্ব নেওয়া ফরজে কেফায়া। রাষ্ট্র যদি এই দায়িত্ব পালন না করে কিংবা একটি দেশের কোনো নাগরিকই যদি তাদের সেবায় এগিয়ে না আসে, তাহলে সমাজের প্রতিটি মুসলমান এর জন্য দায়ী ও গুনাহগার হবে। পরকালে এ জন্য কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। 

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত