ইজাজুল হক, ঢাকা
মারইয়াম (আ.) পৃথিবীর ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ নারীদের একজন। পবিত্র কোরআনে তাঁর অনন্য মর্যাদার কথা বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রতি বিশেষ অনুগ্রহ করেছেন এবং তাঁকে পৃথিবীর একমাত্র ব্যতিক্রমী মায়ের মর্যাদা দান করেছেন। তাঁর সন্তান ইসা (আ.)–কে বানিয়েছেন আল্লাহর শক্তিমত্তার নিদর্শন এবং তাঁর প্রেরিত অন্যতম প্রভাবশালী নবী ও রাসুল।
পবিত্র কোরআনের দ্বিতীয় দীর্ঘতম সুরা ‘আলে ইমরান’। আলে ইমরান শব্দ দ্বয়ের অর্থ ইমরানের পরিবার। এটি হজরত ইসা (আ.)–এর পরিবারের নাম। আরবি ভাষায় ‘আলে’ শব্দটি অভিজাত ও সম্মানিত পরিবারকেই নির্দেশ করে। এ সুরার মাধ্যমে তাঁর পরিবারকে বিশেষভাবে সম্মানিত করা হয়েছে। এ ছাড়া মারইয়াম (আ.)–এর নামে একটি স্বতন্ত্র সুরা অবতীর্ণ হয়েছে; সুরাটিতে তাঁর সংগ্রামী জীবন কাহিনির বিবরণ এসেছে। অন্য সুরায়ও তাঁর কথা আলোচিত হয়েছে। কোনো নারীর জন্য এমন বিশেষ সম্মান পবিত্র কোরআনে বিরল।
হজরত ইসা (আ.), মা মারইয়াম (আ.), পরিবার, আকিদা–বিশ্বাস, দাওয়াতি কাজ, সমর্থকগোষ্ঠী ও সম্প্রদায় সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বিস্তারিত আলোকপাত করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনকে যেহেতু কিয়ামত পর্যন্ত অক্ষুণ্ন ও অবিকৃত রাখার অঙ্গীকার করেছেন, তাই নিঃসন্দেহে ইসা (আ.) এবং তাঁর মা মারইয়াম (আ.)–এর জীবনেতিহাসও কিয়ামত পর্যন্ত সুরক্ষিত–অবিকৃত থাকবে।
হজরত ইসা (আ.) যেহেতু বাবা ছাড়াই আল্লাহ তাআলার বিশেষ হুকুমে মায়ের গর্ভে এসেছেন, তাই পবিত্র কোরআনের অসংখ্য স্থানে তাঁর নামের সঙ্গে মারইয়াম (আ.)–এর নাম উচ্চারিত হয়েছে। তবে ইসা (আ.)–এর প্রসঙ্গ ছাড়াও সুরা আলে ইমরানের বিভিন্ন স্থানে মারইয়াম নামটি ছয়বার উচ্চারিত হয়েছে।
মারইয়াম (আ.)–এর জন্ম, হজরত জাকারিয়া (আ.) কর্তৃক তাঁর দায়িত্ব গ্রহণ, তাঁকে ফেরেশতাদের সম্বোধন এবং ইসা (আ.)–এর ব্যাপারে সুসংবাদ দানের কথা বিবৃত হয়েছে। সুরা নিসাতেও স্বতন্ত্রভাবে দুইবার তাঁর নাম এসেছে। এর পরের আয়াতগুলোতে ইসা (আ.)–এর প্রতি অবিশ্বাস এবং মারইয়াম (আ.)–কে অপবাদ দেওয়ার কারণে ইহুদিদের তিরস্কার করা হয়েছে এবং ইসা (আ.) যে আল্লাহর বিশেষ আদেশে মারইয়াম (আ.)–এর গর্ভে এসেছেন, তা সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে।
সুরা মারইয়ামে মারইয়াম (আ.)–এর সংগ্রামী জীবনের গল্প বিস্তারিত বলা হয়েছে। এ সুরাতেও স্বতন্ত্রভাবে দুইবার তাঁর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে ইসা (আ.)–কে গর্ভে ধারণ, জন্ম, নিজ সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে যাওয়া, অপবাদের আঙুল তোলা এবং শিশু ইসার সাক্ষ্যসহ সবকিছুর আলোচনা এসেছে। সুরা মারইয়ামের ১৬ থেকে ৩৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন—
এ গ্রন্থে মারইয়ামের কাহিনি বর্ণনা করো, যখন সে তার পরিবার থেকে আলাদা হয়ে পূর্ব দিকে এক জায়গায় আশ্রয় নিয়েছিল। এরপর তাদের থেকে সে নিজেকে আড়াল করল। এরপর আমি তার কাছে আমার রুহ তথা জিবরাইলকে পাঠালাম। সে তার সামনে পূর্ণ মানুষের রূপে আত্মপ্রকাশ করল। মারইয়াম বলল, ‘আমি তোমার কাছ থেকে পরম করুণাময়ের আশ্রয় প্রার্থনা করছি; তুমি যদি সংযমশীল হও (তাহলে আমার কাছ থেকে সরে যাও)।’ সে বলল, ‘আমি তো তোমার প্রতিপালকের দূত মাত্র। তোমাকে এক পবিত্র পুত্র দান করার জন্য (আমাকে পাঠানো হয়েছে)।’ মারইয়াম বলল, ‘কীভাবে আমার পুত্র হবে, অথচ আমাকে কোনো পুরুষ স্পর্শ করেনি; এবং আমি ব্যভিচারীও নই?’ সে বলল, ‘এভাবেই হবে। তোমার প্রতিপালক বলেছেন—এটা আমার জন্য সহজসাধ্য এবং তাকে আমি এ জন্য সৃষ্টি করব, যেন সে মানুষের জন্য এক নিদর্শন ও আমার পক্ষ থেকে এক অনুগ্রহ হয়। এটা তো এক স্থিরীকৃত ব্যাপার।’
এরপর সে গর্ভে সন্তান ধারণ করল এবং তাকে নিয়ে এক দূরবর্তী স্থানে চলে গেল। প্রসব বেদনা তাকে এক খেজুর গাছের তলায় নিয়ে এল। সে বলল, ‘হায়! এর আগেই যদি আমি মরে যেতাম এবং মানুষের স্মৃতি থেকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হতাম।’ তার নিচের দিক থেকে (জিবরাইল) তাকে ডেকে বলল, ‘তুমি দুঃখ করো না, তোমার নিচের দিকে তোমার প্রতিপালক একটি নদী সৃষ্টি করেছেন। খেজুর গাছের কাণ্ড ধরে তোমার দিকে নাড়া দাও, ওটা তোমার সামনে সদ্য পাকা তাজা খেজুর ফেলতে থাকবে। সুতরাং খাও, পান করো এবং চোখ জুড়াও। মানুষের মধ্যে কাউকেও যদি তুমি দেখো, তাহলে বলো—আমি দয়াময়ের উদ্দেশ্যে চুপ থাকার মানত করেছি। সুতরাং আজ আমি কিছুতেই কোনো মানুষের সঙ্গে কথা বলব না।’
এরপর সে সন্তান নিয়ে তার সম্প্রদায়ের কাছে গেল। তারা বলল, ‘হে মারইয়াম, তুমি তো এক অদ্ভুত কাণ্ড করে বসেছ! হে হারুনের বোন, তোমার বাবা অসৎ ব্যক্তি ছিলেন না এবং তোমার মাও ছিলেন না ব্যভিচারিণী।’
তখন মারইয়াম তার ছেলের দিকে ইশারা করল। তারা বলল, ‘আমরা কোলের বাচ্চার সঙ্গে কীভাবে কথা বলব?’ শিশুটি (অলৌকিকভাবে) বলে উঠল, ‘আমি আল্লাহর বান্দা, তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন, আর আমাকে নবী করেছেন। আমি যেখানেই থাকি না কেন তিনি আমাকে বরকতময় করেছেন আর আমাকে নামাজ ও জাকাতের আদেশ দিয়েছেন—যত দিন আমি জীবিত থাকি। আর (তিনি আমাকে করেছেন) আমার মায়ের প্রতি সদয়, তিনি আমাকে দাম্ভিক–হতভাগ্য করেননি। আমার ওপর আছে শান্তি যেদিন আমি জন্মেছি, যেদিন আমার মৃত্যু হবে আর আমি যেদিন জীবিত হয়ে উত্থিত হব।’ এই হচ্ছে মারইয়ামের পুত্র ইসা, (এটাই) সত্য কথা; যে বিষয়ে লোকেরা সন্দেহ পোষণ করে।’ (সুরা মারইয়াম: ১৬-৩৪)
সুরা তাহরিমে একবার মারইয়াম (আ.)–এর নাম এসেছে; সেখানে তাঁকে বাবার দিকে সম্পর্কিত করা হয়েছে। তাঁর বিশ্বাস, আনুগত্য ও আত্মশুদ্ধির কারণে তাঁর প্রশংসাও করা হয়েছে। এরশাদ হয়েছে, ‘আর (আল্লাহ) দৃষ্টান্ত দিচ্ছেন ইমরান–কন্যা মারইয়ামের, যে তার সম্ভ্রম রক্ষা করেছিল। ফলে আমি তার মধ্যে আমার রুহ ফুঁকে দিয়েছিলাম। সে তার প্রতিপালকের বাণী এবং তাঁর কিতাবগুলোর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছিল। সে ছিল অনুগতদের অন্তর্ভুক্ত।’ (সুরা তাহরিম, আয়াত: ১২)
সুরা আলে ইমরানে মারইয়াম (আ.)–এর গল্প শুরু থেকেই বলা হয়েছে—তাঁর মা তাঁকে গর্ভে ধারণ করেন এবং গর্ভের সন্তানকে আল্লাহর পথে উৎসর্গ করে দেন। আল্লাহ তা কবুল করেন এবং গর্ভের সন্তানকে হেফাজত করেন। বাইতুল মোকাদ্দাসের দায়িত্বশীলেরা শিশু মারইয়ামের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা শুরু করে দেন। ফলে লটারির আয়োজন করতে হলো এবং আল্লাহর নবী জাকারিয়া (আ.) তাঁর দায়িত্ব পেলেন। তাঁর তত্ত্বাবধানে তিনি একজন নেককার চরিত্রবান নারী হিসেবে লালিতপালিত হতে লাগলেন। আল্লাহ তাআলা তাঁর জন্য নিয়মিত আসমানি রিজিক পাঠাতেন। জাকারিয়া (আ.) অবাক হয়ে এগুলোর উৎস সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেন। তিনি জবাবে বলতেন, ‘এগুলো আল্লাহর পক্ষ থেকে হাদিয়া।’ এমন অনুগ্রহ দেখে জাকারিয়া (আ.)–ও আল্লাহর কাছে একটি সন্তান চাইলেন।
সেই কাহিনি বর্ণনা করে সুরা আলে ইমরানের ৩৫ থেকে ৩৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন—
(স্মরণ করো) যখন ইমরানের স্ত্রী বলেছিল, ‘হে আমার প্রতিপালক, আমার গর্ভে যা আছে, তা আমি একান্ত আপনার জন্য স্বাধীন করার মানত করলাম। সুতরাং আমার পক্ষ থেকে তা গ্রহণ করুন। নিশ্চয়ই আপনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞানী।’ এরপর যখন সে সন্তান প্রসব করল, তখন সে বলল, ‘হে আমার প্রতিপালক, আমি কন্যা প্রসব করেছি।’ সে যা প্রসব করেছে সে ব্যাপারে আল্লাহ সম্যক অবগত আর (তার কাঙ্ক্ষিত) পুত্র তো (এই) কন্যার মতো (মহান) নয়। ‘আমি তার নাম মারইয়াম রেখেছি এবং অভিশপ্ত শয়তান থেকে তার ও তার বংশধরদের জন্য আপনার পানাহ চাচ্ছি।’
এরপর তার প্রতিপালক তাকে উত্তমরূপেই গ্রহণ করলেন এবং উত্তমরূপেই তার প্রতিপালন করলেন। আর তিনি তাকে জাকারিয়ার তত্ত্বাবধানে রাখলেন। যখনই জাকারিয়া মেহরাবে তার সঙ্গে দেখা করতে যেত, তখনই তার কাছে খাদ্য–সামগ্রী দেখতে পেত। সে বলত, ‘হে মারইয়াম, এসব তুমি কোথা থেকে পেলে?’ সে বলত, ‘তা আল্লাহর কাছ থেকে। নিশ্চয়ই আল্লাহ যাকে ইচ্ছা অফুরান জীবিকা দান করে থাকেন।’ সেখানেই জাকারিয়া তার প্রতিপালকের কাছে প্রার্থনা করে বলল, ‘হে আমার প্রতিপালক, আমাকে আপনি আপনার কাছ থেকে সৎ বংশধর দান করুন। নিশ্চয়ই আপনি প্রার্থনা শ্রবণকারী’। (সুরা আলে ইমরান: ৩৫-৩৮)
এই সুরার পরের আয়াতগুলোতে ফেরেশতা কর্তৃক মারইয়াম (আ.)–কে সুসংবাদ দেওয়ার গল্পটি এসেছে। ফেরেশতা আল্লাহর বাণী পৌঁছে দিলেন যে, পৃথিবীর সব নারীর মধ্যে তাঁকে সেরা হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছে। আল্লাহকে ভয় করা, পবিত্রতার সঙ্গে জীবন পরিচালনা করা এবং ইবাদতে মগ্ন হওয়া তাঁর জন্য আবশ্যক। এবং এও সুসংবাদ দিলেন, আল্লাহ তাঁকে একটি পুত্রসন্তান দান করবেন, তার নাম হবে ইসা। তিনি আল্লাহর নবী ও রাসুল হবেন। মারইয়াম এসব কথায় অবাক হলে ফেরেশতা বললেন, এসব আল্লাহর আদেশ এবং আল্লাহ যাকে যেভাবে ইচ্ছা সৃষ্টি করেন।
সুরা আলে ইমরানের ৪৪ থেকে ৪৮ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন—
(স্মরণ করো) যখন ফেরেশতারা বলল, ‘হে মারইয়াম, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাকে তাঁর একটি নিদর্শনের সুসংবাদ দিচ্ছেন। তার নাম মারইয়ামের পুত্র ইসা মাসিহ, সে দুনিয়া ও আখেরাতে সম্মানিত ও সান্নিধ্যপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে। সে লোকেদের সঙ্গে দোলনায় থাকা অবস্থায় এবং বয়ঃপ্রাপ্ত অবস্থায় কথা বলবে এবং নেক বান্দাদের অন্তর্গত হবে।’ সে বলল, ‘হে আমার প্রতিপালক, কীভাবে আমার সন্তান হবে? অথচ কোনো পুরুষ আমাকে স্পর্শ করেনি।’ তিনি বললেন, ‘এভাবেই আল্লাহ যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন। তিনি যখন কিছু (সৃষ্টি করবেন বলে) স্থির করেন, তখন বলেন—হও, আর তখনই তা হয়ে যায়। তিনি তাকে শিক্ষা দেবেন লিখন, প্রজ্ঞা, তওরাত ও ইঞ্জিল।’ (সুরা আলে ইমরান: ৪৪-৪৮)
এভাবেই পবিত্র কোরআনে হজরত মারইয়াম (আ.)–এর পবিত্রতা ও মর্যাদার কথা আলোচিত হয়েছে। হাদিসের ভাষ্যেও তাঁকে ইসলামের ইতিহাসের অন্যতম সেরা নারী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তাঁর মর্যাদা ও পবিত্রতায় বিশ্বাসী হওয়া এবং তাঁর পুত্র ইসা (আ.)–কে আল্লাহর নবী ও রাসুল হিসেবে মানা মুসলমানদের আকিদা–বিশ্বাসের অংশ।
মারইয়াম (আ.) পৃথিবীর ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ নারীদের একজন। পবিত্র কোরআনে তাঁর অনন্য মর্যাদার কথা বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রতি বিশেষ অনুগ্রহ করেছেন এবং তাঁকে পৃথিবীর একমাত্র ব্যতিক্রমী মায়ের মর্যাদা দান করেছেন। তাঁর সন্তান ইসা (আ.)–কে বানিয়েছেন আল্লাহর শক্তিমত্তার নিদর্শন এবং তাঁর প্রেরিত অন্যতম প্রভাবশালী নবী ও রাসুল।
পবিত্র কোরআনের দ্বিতীয় দীর্ঘতম সুরা ‘আলে ইমরান’। আলে ইমরান শব্দ দ্বয়ের অর্থ ইমরানের পরিবার। এটি হজরত ইসা (আ.)–এর পরিবারের নাম। আরবি ভাষায় ‘আলে’ শব্দটি অভিজাত ও সম্মানিত পরিবারকেই নির্দেশ করে। এ সুরার মাধ্যমে তাঁর পরিবারকে বিশেষভাবে সম্মানিত করা হয়েছে। এ ছাড়া মারইয়াম (আ.)–এর নামে একটি স্বতন্ত্র সুরা অবতীর্ণ হয়েছে; সুরাটিতে তাঁর সংগ্রামী জীবন কাহিনির বিবরণ এসেছে। অন্য সুরায়ও তাঁর কথা আলোচিত হয়েছে। কোনো নারীর জন্য এমন বিশেষ সম্মান পবিত্র কোরআনে বিরল।
হজরত ইসা (আ.), মা মারইয়াম (আ.), পরিবার, আকিদা–বিশ্বাস, দাওয়াতি কাজ, সমর্থকগোষ্ঠী ও সম্প্রদায় সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বিস্তারিত আলোকপাত করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনকে যেহেতু কিয়ামত পর্যন্ত অক্ষুণ্ন ও অবিকৃত রাখার অঙ্গীকার করেছেন, তাই নিঃসন্দেহে ইসা (আ.) এবং তাঁর মা মারইয়াম (আ.)–এর জীবনেতিহাসও কিয়ামত পর্যন্ত সুরক্ষিত–অবিকৃত থাকবে।
হজরত ইসা (আ.) যেহেতু বাবা ছাড়াই আল্লাহ তাআলার বিশেষ হুকুমে মায়ের গর্ভে এসেছেন, তাই পবিত্র কোরআনের অসংখ্য স্থানে তাঁর নামের সঙ্গে মারইয়াম (আ.)–এর নাম উচ্চারিত হয়েছে। তবে ইসা (আ.)–এর প্রসঙ্গ ছাড়াও সুরা আলে ইমরানের বিভিন্ন স্থানে মারইয়াম নামটি ছয়বার উচ্চারিত হয়েছে।
মারইয়াম (আ.)–এর জন্ম, হজরত জাকারিয়া (আ.) কর্তৃক তাঁর দায়িত্ব গ্রহণ, তাঁকে ফেরেশতাদের সম্বোধন এবং ইসা (আ.)–এর ব্যাপারে সুসংবাদ দানের কথা বিবৃত হয়েছে। সুরা নিসাতেও স্বতন্ত্রভাবে দুইবার তাঁর নাম এসেছে। এর পরের আয়াতগুলোতে ইসা (আ.)–এর প্রতি অবিশ্বাস এবং মারইয়াম (আ.)–কে অপবাদ দেওয়ার কারণে ইহুদিদের তিরস্কার করা হয়েছে এবং ইসা (আ.) যে আল্লাহর বিশেষ আদেশে মারইয়াম (আ.)–এর গর্ভে এসেছেন, তা সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে।
সুরা মারইয়ামে মারইয়াম (আ.)–এর সংগ্রামী জীবনের গল্প বিস্তারিত বলা হয়েছে। এ সুরাতেও স্বতন্ত্রভাবে দুইবার তাঁর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে ইসা (আ.)–কে গর্ভে ধারণ, জন্ম, নিজ সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে যাওয়া, অপবাদের আঙুল তোলা এবং শিশু ইসার সাক্ষ্যসহ সবকিছুর আলোচনা এসেছে। সুরা মারইয়ামের ১৬ থেকে ৩৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন—
এ গ্রন্থে মারইয়ামের কাহিনি বর্ণনা করো, যখন সে তার পরিবার থেকে আলাদা হয়ে পূর্ব দিকে এক জায়গায় আশ্রয় নিয়েছিল। এরপর তাদের থেকে সে নিজেকে আড়াল করল। এরপর আমি তার কাছে আমার রুহ তথা জিবরাইলকে পাঠালাম। সে তার সামনে পূর্ণ মানুষের রূপে আত্মপ্রকাশ করল। মারইয়াম বলল, ‘আমি তোমার কাছ থেকে পরম করুণাময়ের আশ্রয় প্রার্থনা করছি; তুমি যদি সংযমশীল হও (তাহলে আমার কাছ থেকে সরে যাও)।’ সে বলল, ‘আমি তো তোমার প্রতিপালকের দূত মাত্র। তোমাকে এক পবিত্র পুত্র দান করার জন্য (আমাকে পাঠানো হয়েছে)।’ মারইয়াম বলল, ‘কীভাবে আমার পুত্র হবে, অথচ আমাকে কোনো পুরুষ স্পর্শ করেনি; এবং আমি ব্যভিচারীও নই?’ সে বলল, ‘এভাবেই হবে। তোমার প্রতিপালক বলেছেন—এটা আমার জন্য সহজসাধ্য এবং তাকে আমি এ জন্য সৃষ্টি করব, যেন সে মানুষের জন্য এক নিদর্শন ও আমার পক্ষ থেকে এক অনুগ্রহ হয়। এটা তো এক স্থিরীকৃত ব্যাপার।’
এরপর সে গর্ভে সন্তান ধারণ করল এবং তাকে নিয়ে এক দূরবর্তী স্থানে চলে গেল। প্রসব বেদনা তাকে এক খেজুর গাছের তলায় নিয়ে এল। সে বলল, ‘হায়! এর আগেই যদি আমি মরে যেতাম এবং মানুষের স্মৃতি থেকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হতাম।’ তার নিচের দিক থেকে (জিবরাইল) তাকে ডেকে বলল, ‘তুমি দুঃখ করো না, তোমার নিচের দিকে তোমার প্রতিপালক একটি নদী সৃষ্টি করেছেন। খেজুর গাছের কাণ্ড ধরে তোমার দিকে নাড়া দাও, ওটা তোমার সামনে সদ্য পাকা তাজা খেজুর ফেলতে থাকবে। সুতরাং খাও, পান করো এবং চোখ জুড়াও। মানুষের মধ্যে কাউকেও যদি তুমি দেখো, তাহলে বলো—আমি দয়াময়ের উদ্দেশ্যে চুপ থাকার মানত করেছি। সুতরাং আজ আমি কিছুতেই কোনো মানুষের সঙ্গে কথা বলব না।’
এরপর সে সন্তান নিয়ে তার সম্প্রদায়ের কাছে গেল। তারা বলল, ‘হে মারইয়াম, তুমি তো এক অদ্ভুত কাণ্ড করে বসেছ! হে হারুনের বোন, তোমার বাবা অসৎ ব্যক্তি ছিলেন না এবং তোমার মাও ছিলেন না ব্যভিচারিণী।’
তখন মারইয়াম তার ছেলের দিকে ইশারা করল। তারা বলল, ‘আমরা কোলের বাচ্চার সঙ্গে কীভাবে কথা বলব?’ শিশুটি (অলৌকিকভাবে) বলে উঠল, ‘আমি আল্লাহর বান্দা, তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন, আর আমাকে নবী করেছেন। আমি যেখানেই থাকি না কেন তিনি আমাকে বরকতময় করেছেন আর আমাকে নামাজ ও জাকাতের আদেশ দিয়েছেন—যত দিন আমি জীবিত থাকি। আর (তিনি আমাকে করেছেন) আমার মায়ের প্রতি সদয়, তিনি আমাকে দাম্ভিক–হতভাগ্য করেননি। আমার ওপর আছে শান্তি যেদিন আমি জন্মেছি, যেদিন আমার মৃত্যু হবে আর আমি যেদিন জীবিত হয়ে উত্থিত হব।’ এই হচ্ছে মারইয়ামের পুত্র ইসা, (এটাই) সত্য কথা; যে বিষয়ে লোকেরা সন্দেহ পোষণ করে।’ (সুরা মারইয়াম: ১৬-৩৪)
সুরা তাহরিমে একবার মারইয়াম (আ.)–এর নাম এসেছে; সেখানে তাঁকে বাবার দিকে সম্পর্কিত করা হয়েছে। তাঁর বিশ্বাস, আনুগত্য ও আত্মশুদ্ধির কারণে তাঁর প্রশংসাও করা হয়েছে। এরশাদ হয়েছে, ‘আর (আল্লাহ) দৃষ্টান্ত দিচ্ছেন ইমরান–কন্যা মারইয়ামের, যে তার সম্ভ্রম রক্ষা করেছিল। ফলে আমি তার মধ্যে আমার রুহ ফুঁকে দিয়েছিলাম। সে তার প্রতিপালকের বাণী এবং তাঁর কিতাবগুলোর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছিল। সে ছিল অনুগতদের অন্তর্ভুক্ত।’ (সুরা তাহরিম, আয়াত: ১২)
সুরা আলে ইমরানে মারইয়াম (আ.)–এর গল্প শুরু থেকেই বলা হয়েছে—তাঁর মা তাঁকে গর্ভে ধারণ করেন এবং গর্ভের সন্তানকে আল্লাহর পথে উৎসর্গ করে দেন। আল্লাহ তা কবুল করেন এবং গর্ভের সন্তানকে হেফাজত করেন। বাইতুল মোকাদ্দাসের দায়িত্বশীলেরা শিশু মারইয়ামের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা শুরু করে দেন। ফলে লটারির আয়োজন করতে হলো এবং আল্লাহর নবী জাকারিয়া (আ.) তাঁর দায়িত্ব পেলেন। তাঁর তত্ত্বাবধানে তিনি একজন নেককার চরিত্রবান নারী হিসেবে লালিতপালিত হতে লাগলেন। আল্লাহ তাআলা তাঁর জন্য নিয়মিত আসমানি রিজিক পাঠাতেন। জাকারিয়া (আ.) অবাক হয়ে এগুলোর উৎস সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেন। তিনি জবাবে বলতেন, ‘এগুলো আল্লাহর পক্ষ থেকে হাদিয়া।’ এমন অনুগ্রহ দেখে জাকারিয়া (আ.)–ও আল্লাহর কাছে একটি সন্তান চাইলেন।
সেই কাহিনি বর্ণনা করে সুরা আলে ইমরানের ৩৫ থেকে ৩৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন—
(স্মরণ করো) যখন ইমরানের স্ত্রী বলেছিল, ‘হে আমার প্রতিপালক, আমার গর্ভে যা আছে, তা আমি একান্ত আপনার জন্য স্বাধীন করার মানত করলাম। সুতরাং আমার পক্ষ থেকে তা গ্রহণ করুন। নিশ্চয়ই আপনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞানী।’ এরপর যখন সে সন্তান প্রসব করল, তখন সে বলল, ‘হে আমার প্রতিপালক, আমি কন্যা প্রসব করেছি।’ সে যা প্রসব করেছে সে ব্যাপারে আল্লাহ সম্যক অবগত আর (তার কাঙ্ক্ষিত) পুত্র তো (এই) কন্যার মতো (মহান) নয়। ‘আমি তার নাম মারইয়াম রেখেছি এবং অভিশপ্ত শয়তান থেকে তার ও তার বংশধরদের জন্য আপনার পানাহ চাচ্ছি।’
এরপর তার প্রতিপালক তাকে উত্তমরূপেই গ্রহণ করলেন এবং উত্তমরূপেই তার প্রতিপালন করলেন। আর তিনি তাকে জাকারিয়ার তত্ত্বাবধানে রাখলেন। যখনই জাকারিয়া মেহরাবে তার সঙ্গে দেখা করতে যেত, তখনই তার কাছে খাদ্য–সামগ্রী দেখতে পেত। সে বলত, ‘হে মারইয়াম, এসব তুমি কোথা থেকে পেলে?’ সে বলত, ‘তা আল্লাহর কাছ থেকে। নিশ্চয়ই আল্লাহ যাকে ইচ্ছা অফুরান জীবিকা দান করে থাকেন।’ সেখানেই জাকারিয়া তার প্রতিপালকের কাছে প্রার্থনা করে বলল, ‘হে আমার প্রতিপালক, আমাকে আপনি আপনার কাছ থেকে সৎ বংশধর দান করুন। নিশ্চয়ই আপনি প্রার্থনা শ্রবণকারী’। (সুরা আলে ইমরান: ৩৫-৩৮)
এই সুরার পরের আয়াতগুলোতে ফেরেশতা কর্তৃক মারইয়াম (আ.)–কে সুসংবাদ দেওয়ার গল্পটি এসেছে। ফেরেশতা আল্লাহর বাণী পৌঁছে দিলেন যে, পৃথিবীর সব নারীর মধ্যে তাঁকে সেরা হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছে। আল্লাহকে ভয় করা, পবিত্রতার সঙ্গে জীবন পরিচালনা করা এবং ইবাদতে মগ্ন হওয়া তাঁর জন্য আবশ্যক। এবং এও সুসংবাদ দিলেন, আল্লাহ তাঁকে একটি পুত্রসন্তান দান করবেন, তার নাম হবে ইসা। তিনি আল্লাহর নবী ও রাসুল হবেন। মারইয়াম এসব কথায় অবাক হলে ফেরেশতা বললেন, এসব আল্লাহর আদেশ এবং আল্লাহ যাকে যেভাবে ইচ্ছা সৃষ্টি করেন।
সুরা আলে ইমরানের ৪৪ থেকে ৪৮ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন—
(স্মরণ করো) যখন ফেরেশতারা বলল, ‘হে মারইয়াম, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাকে তাঁর একটি নিদর্শনের সুসংবাদ দিচ্ছেন। তার নাম মারইয়ামের পুত্র ইসা মাসিহ, সে দুনিয়া ও আখেরাতে সম্মানিত ও সান্নিধ্যপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে। সে লোকেদের সঙ্গে দোলনায় থাকা অবস্থায় এবং বয়ঃপ্রাপ্ত অবস্থায় কথা বলবে এবং নেক বান্দাদের অন্তর্গত হবে।’ সে বলল, ‘হে আমার প্রতিপালক, কীভাবে আমার সন্তান হবে? অথচ কোনো পুরুষ আমাকে স্পর্শ করেনি।’ তিনি বললেন, ‘এভাবেই আল্লাহ যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন। তিনি যখন কিছু (সৃষ্টি করবেন বলে) স্থির করেন, তখন বলেন—হও, আর তখনই তা হয়ে যায়। তিনি তাকে শিক্ষা দেবেন লিখন, প্রজ্ঞা, তওরাত ও ইঞ্জিল।’ (সুরা আলে ইমরান: ৪৪-৪৮)
এভাবেই পবিত্র কোরআনে হজরত মারইয়াম (আ.)–এর পবিত্রতা ও মর্যাদার কথা আলোচিত হয়েছে। হাদিসের ভাষ্যেও তাঁকে ইসলামের ইতিহাসের অন্যতম সেরা নারী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তাঁর মর্যাদা ও পবিত্রতায় বিশ্বাসী হওয়া এবং তাঁর পুত্র ইসা (আ.)–কে আল্লাহর নবী ও রাসুল হিসেবে মানা মুসলমানদের আকিদা–বিশ্বাসের অংশ।
ইবাদতের নিয়তে করা সব কাজই নেক আমলের অন্তর্ভুক্ত। আর নেক আমল মানুষের জীবনের প্রকৃত সম্পদ। এর মাধ্যমে পাওয়া যাবে জান্নাত। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘এবং যারা ইমান এনেছে ও সৎকর্ম করেছে, তারাই জান্নাতের অধিকারী, তারা সেখানে চিরকাল থাকবে।’ (সুরা বাকারা: ৮২)
১০ ঘণ্টা আগেভ্রমণের সময় নামাজের ক্ষেত্রে বিশেষ ছাড় দিয়েছে ইসলাম। কোনো ব্যক্তি নিজের আবাসস্থল থেকে ৪৮ মাইল তথা ৭৮ কিলোমিটার দূরের কোনো গন্তব্যে ভ্রমণের নিয়তে বের হয়ে তাঁর এলাকা পেরিয়ে গেলেই শরিয়তের দৃষ্টিতে সে মুসাফির হয়ে যায়। (জাওয়াহিরুল ফিকহ: ১/৪৩৬)
১ দিন আগেজুবাইদা বিনতে জাফর ইবনে মানসুর পঞ্চম আব্বাসি খলিফা হারুনুর রশিদের স্ত্রী ও জাফর ইবনুল মানসুরের কন্যা। তাঁর মা ছিলেন আল-খায়জুরানের বড় বোন সালসাল ইবনে আত্তা। জুবাইদার আসল নাম আমাতুল আজিজ। দাদা আল-মানসুর তাঁকে আদর করে জুবাইদা (ছোট মাখনের টুকরা) নামে ডাকতেন এবং এ নামেই তিনি ইতিহাসে বিখ্যাত।
২ দিন আগে