তানিয়া ফেরদৌস
কোনো এক রম্য নাটকে প্রেয়সীকে ফুলের বদলে ফুলকপি দেওয়ায় নায়ককে যারপরনাই ট্র্যাজেডির কবলে পড়তে হয়েছিল—এমনটাই দেখা গেছে। তবে শীতের আগমনধ্বনি টের পেতে না পেতেই সবার মন-প্রাণ-রসনা সবকিছুই যে সদ্য ওঠা ফুলকপির নানা পদের জন্য আকুলি-বিকুলি করে ওঠে, সে কথা স্বীকার না করে কোনো উপায়ই নেই। শীতের দুপুরে কই মাছ দিয়ে রাঁধা ধোঁয়া ওঠা ফুলকপির তরকারি হোক, আর হিম হিম সন্ধ্যায় চায়ের সঙ্গে গরমাগরম ফুলকপির বড়া, এ দেশে শীতের আমেজ ফুলকপির সংগত না পেলে যে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে না। আবার এদিকে ফুলকপির অবাক করা সব স্বাস্থ্যগুণের কারণেও খাদ্যতালিকায় এর গুরুত্ব বেড়ে যায় বহুগুণে।
ফুলকপি দেখতে ফুলের মতো বলে লাতিন ভাষায় ‘কপির ফুল’ কথাটিই মুখে মুখে কলি ফ্লাওয়ার নামে একে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে বিশ্বব্যাপী। ক্রুসিফেরাস গোত্রীয় এই সবজির দলে আরও আছে ব্রকলি, বাঁধাকপি, মুলা আর ব্রাসেলস স্প্রাউট। ফুলকপির ডাঁটা খাওয়া গেলেও মূলত মস্তকাকৃতি হালকা হলুদ বড় ফুলেল অংশটিই খাওয়া হয়ে থাকে দুনিয়াজুড়ে।
পুষ্টি উপাদান
শুধু সুস্বাদু নয়, ফুলকপির মতো পুষ্টিগুণ খুব কম সবজিতে আছে। আবার এদিকে তুলনামূলকভাবে অত্যন্ত কম ক্যালরিযুক্ত এই সবজিতে মানবদেহের জন্য অত্যাবশ্যকীয় সব ধরনের ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ আছে। এক কাপ ফুলকপিতে মাত্র ২৫ ক্যালরি আছে, অথচ খাদ্য আঁশ মিলবে প্রায় তিন গ্রামের মতো। দৈনন্দিন প্রয়োজনের ২০ শতাংশ ভিটামিন কে, আর ভিটামিন বি৬ আছে ১১ শতাংশ, ভিটামিন বি ৯ বা ফোলেট আছে ১৪ শতাংশ। এদিকে, দৈনিক প্রয়োজনের প্রায় ৭৭ শতাংশ ভিটামিন সি শুধু এক কাপ ফুলকপিতে থাকলেও এর সুফল পেতে তাপ প্রয়োগ থেকে বিরত থাকতে হবে। খনিজ পদার্থ, যেগুলো আমাদের শারীরবৃত্তীয় সামগ্রিক প্রক্রিয়াগুলোর জন্য অত্যাবশ্যকীয়—সেগুলোও কিন্তু পর্যাপ্ত পরিমাণে আছে ফুলকপিতে। এক কাপ ফুলকপিতে দৈনিক চাহিদার প্রায় ৯ শতাংশ পটাশিয়াম, ৮ শতাংশ ম্যাংগানিজ, ৪ শতাংশ ম্যাগনেশিয়াম এবং ৪ শতাংশ ফসফরাস মজুত আছে। তাই দেখতে সাদামাটা হলেও ফুলকপিকে পুষ্টিগুণের আধার বললে ভুল হবে না।
সুস্বাস্থ্যের জন্য ফুলকপি
ফুলকপিতে রয়েছে অনেক স্বাস্থ্যকর উপাদান। নানা ধরনের রোগ থেকে সুরক্ষা পেতে ফুলকপি তাই দারুণ কার্যকর। দেখা যাক কী আছে ফুলকপিতে—
কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে
উচ্চ পরিমাণে খাদ্য আঁশ থাকায় ফুলকপি হজমে সহায়ক। কোষ্ঠ পরিষ্কার রেখে ও উপকারী ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি-বৃদ্ধি নিশ্চিত করে এই খাদ্য আঁশ।
ডায়াবেটিস ও হৃদ্রোগ প্রতিরোধে
বেশি আঁশযুক্ত খাবার বলে ফুলকপি ডায়বেটিস, হৃদরোগের মতো প্রাণঘাতী রোগ প্রতিরোধ করতে পারে। ফুলকপি ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য আদর্শ খাবার হিসেবে বিবেচিত। এতে প্রোটিন, ম্যাগনেশিয়াম, ফসফরাস, পটাশিয়াম এবং ম্যাংগানিজ রয়েছে। ফুলকপির জিআই ৫-১৫ এর মধ্যে গণনা করা হয়। ফুলকপিতে ফাইবার রয়েছে, যা রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখে।
ওজন নিয়ন্ত্রণে ফুলকপি
জলীয় অংশ আর অধিক খাদ্য আঁশের জন্য ফুলকপি ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। এ ক্ষেত্রে ফুলকপির ভাত সহায়তা করতে পারে। এক কাপ ফুলকপির ভাতে চালের ভাতের তুলনায় প্রায় ৮০ ভাগ কম ক্যালরি থাকে। এতে নেট শর্করার পরিমাণও চালের ভাতের তুলনায় প্রায় ১৮ ভাগের ১ ভাগ। ফলে এটি শর্করার বিকল্প হিসেবে কাজ করে ওজন কমাতে সহায়তা করতে পারে।
দাঁতের সুরক্ষায় ফুলকপি
দাঁতের সুরক্ষায় সহায়তা করে ফুলকপি। বিশেষ করে দাঁত লালচে হওয়া এবং দাঁতের মাড়ি দুর্বল হয়ে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে পারে এ সবজি। ফুলকপিতে রয়েছে দাঁতের মাড়ির জন্য উপকারী ক্যালসিয়াম ও ফ্লোরাইড নামের দুটি উপাদান। এগুলো দাঁতের উজ্জ্বলতা বাড়ায় এবং বাড়ন্ত শিশুদের দাঁতের পূর্ণ বিকাশে সহায়তা করে।
ক্যানসার প্রতিরোধে ফুলকপি
শরীরকে ফ্রি র্যাডিকেল মুক্ত রাখতে ও সুস্থতা নিশ্চিত করতে যেসব অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের কথা বলা হয়, তার অনেকগুলোই ফুলকপিতে পাওয়া যায়। বিশেষত, অন্যান্য ক্রুসিফেরাস জাতীয় সবজির মতোই ফুলকপিতে গ্লুকোসিনোলেটস আর আইসথায়োসায়ানেটস নামক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বেশ ভালো পরিমাণে থাকে। ক্যানসার গবেষণায় এ দুই ধরনের অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের ব্যাপারে বেশ ইতিবাচক ফল পাচ্ছেন গবেষকেরা। ল্যাবরেটরি টেস্টে ফুলকপিতে থাকা এই খাদ্য উপাদানগুলোর কোলন, ফুসফুস, স্তন ও প্রোস্টেট বা অন্ডকোষের ক্যানসার প্রতিরোধে ভালো ভূমিকা থাকতে পারে, এমনটাই উঠে এসেছে ফলাফলে।
ফুলকপিতে ক্যারোটিনয়েড আর ফ্ল্যাভনয়েড নামক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপস্থিতি রয়েছে। এ দুটি উপাদানের ক্যানসার প্রতিরোধী ভূমিকাসহ শরীরে আরও অন্যান্য রোগ প্রতিরোধ শক্তি গড়ে তোলার ক্ষমতা আছে বলে গবেষণায় দেখা যাচ্ছে।
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে ফুলকপি
ফুলকপির উচ্চ পরিমাণের খাদ্য আঁশ সার্বিকভাবে রক্তে ক্ষতিকর এইচডিএল কোলেস্টেরল কমিয়ে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে বেশ সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। কিছু নির্ভরযোগ্য ল্যাবরেটরিকেন্দ্রিক গবেষণায় দেখা গেছে, ফুলকপির সালফোরাফেন নামক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে ভালো ভূমিকা আছে। এতে পটাশিয়াম আর ম্যাগনেশিয়ামের পরিমাণ বেশি থাকায় তা হৃদ্যন্ত্রের কার্যকারিতা স্বাভাবিক রাখতে ভূমিকা রাখে ফুলকপি। ফলে উচ্চ রক্তচাপ থাকে নিয়ন্ত্রণে।
যদি কাঁচা বা নামমাত্র তাপে নেড়েচেড়ে খাওয়া যায়, তাহলে ফুলকপিতে থাকা অধিক পরিমাণে ভিটামিন সি-ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ভূমিকা পালন করতে পারে।
প্রদাহ ও ব্যথা দূর করে ফুলকপি
ফুলকপির আছে প্রদাহরোধী ভূমিকা। এতে শরীরের সামগ্রিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বেড়ে যায়।
মস্তিষ্কের বিকাশ ও অন্যান্য উপকারে
ফুলকপিতে আছে কলিন। এটি সাম্প্রতিক গবেষণায় উঠে আসা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শারীরবৃত্তীয় রাসায়নিক উপাদান বলে সাড়া জাগাচ্ছে বিশ্বব্যাপী। বলা হচ্ছে, বিশ্বের প্রচুর মানুষের দেহে এই উপাদানের অভাব রয়েছে। এক কাপ ফুলকপিতে থাকে ৪৫ মিলিগ্রাম কলিন, যা পরিমাণে যথেষ্ট। এই কলিনের রয়েছে দেহে কোষ আবরণী অক্ষুণ্ন রাখা, ডিএনএ সংশ্লেষণ, হজম প্রক্রিয়া ঠিক রাখার মতো বহু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। মস্তিষ্কের সঠিক বৃদ্ধি ও বিকাশের ক্ষেত্রেও এর জোরালো ইতিবাচক ভূমিকা থাকার কথা জানা যায়। আর সেই সঙ্গে লিভারে চর্বি জমতে দেয় না বলে কলিন আজকাল গবেষকদের আগ্রহের শীর্ষে আছে। পর্যাপ্ত পরিমাণে কলিন গ্রহণ না করলে লিভার ও হার্টে রোগ হতে পারে, স্নায়বিক বৈকল্য ও দুর্বলতাও দেখা দিতে পারে। আর ফুলকপির মতো ক্রুসিফেরাস সবজি ছাড়া এই অত্যাবশ্যকীয় উপাদানটি তেমন পাওয়াই যায় না।
ত্বকের যত্নে ফুলকপি
ফুলকপির ভিটামিন সি, লেনোলেয়িক অ্যাসিড নামের দরকারি ফ্যাটি অ্যাসিড, ওমেগা থ্রি ও ভিটামিন কে থাকায় নিয়মিত সঠিক গুণাগুণ অক্ষুণ্ন রেখে রেঁধে ফুলকপির নানা পদ খেলে ত্বকের সমস্যাও এড়ানো যায়।
কিডনির যত্নে ফুলকপি
ফুলকপিতে ক্ষারীয় ভাব। এ জন্য কিডনিতে চাপ কম পড়ে।
ফুলকপির রেসিপি
ফুলকপির মতো সর্বজনীন সবজি আর নেই। সেই মার্কিন মুলুকের কলি ফ্লাওয়ার ম্যাশ, আর আমাদের দেশের ফুলকপির বড়া—সব ভাবেই অনন্য এই ফুলকপি। যারা ভাতের বিকল্প হিসেবে স্বল্প শর্করাযুক্ত খাদ্য খেতে চান, তাঁদের জন্য রয়েছে কলি ফ্লাওয়ার রাইস। এতে আস্ত ফুলকপি কুরিয়ে নিয়ে ভাতের মতো রান্না করে সে দানাদার কুরানো কলি ফ্লাওয়ার রাইসকে ভাতের বদলে খাওয়া হয়। আস্ত তন্দুরি ফুলকপি, আলু কপির সবজি, ফুলকপির ডালনা, মাঞ্চুরিয়ান-এর পদের যেন শেষ নেই। বিকেলে চায়ের সঙ্গে ফুলকপির বড়ার কিংবা শিঙাড়া জনপ্রিয় খাবার আমাদের দেশে। কিমার পুর ভরা আস্ত ফুলকপির মুসাম্মানের মতো বিশেষ পদ তো বটেই, আমিষের মিশেলে ফুলকপিতে নিত্যদিনের মাছ মাংসের ঝোল ব্যাঞ্জনেও শীতকাল হয়ে ওঠে উৎসবমুখর। শীতের দুপুরে কই মাছ দিয়ে রাঁধা ধোঁয়া ওঠা ফুলকপির তরকারি হোক, আর হিম হিম সন্ধ্যায় চায়ের সঙ্গে গরমাগরম ফুলকপির বড়া, এ দেশে শীতের আমেজ ফুলকপির সংগত না পেলে যে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে না।
এ ছাড়া রুই-কাতলার মতো বড় আঁশযুক্ত মাছ ও ছোট দেশীয় মাছের সঙ্গে, আলুর সঙ্গে, মুরগি, গরু বা খাসির মাংসের সঙ্গে, বিভিন্ন সবজির সঙ্গে ঘন্ট বা লাবড়া হিসেবে ফুলকপির বহুল ব্যবহার রয়েছে আমাদের দেশে।
কোন ঋতুতে ফুলকপি হয়
ফুলকপি আমাদের দেশে সাধারণত শীতকালেই চাষ করা হয়। এ দেশে পঞ্চাশটিরও বেশি জাত আছে এই সবজির। তবে গ্রীষ্মকালীন জাতের চেয়ে শীতের মৌসুমের ফুলকপির স্বাদ বহুগুণে উত্তম। আমাদের দেশে তো বটেই, বিশ্বের বেশির ভাগ দেশেই ফুলকপি খুবই জনপ্রিয় সবজি। চীনে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি উৎপন্ন হলেও ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রও এদিক থেকে একটুও পিছিয়ে নেই।
চাষের মাটি
পানি দাঁড়ালে ফুলকপির গাছ ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে দোআঁশ মাটির উঁচু জমি এর জন্য বেশি উপযোগী। একটি গাছ থেকে একটি ফুলকপি পাওয়া যায়। ফলে এর সঠিক বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে ফাঁকা ফাঁকাভাবে রোপণ করতে হয় ফুলকপির চারা। আমাদের দেশে গাজীপুর, সাভার, নরসিংদী, রাজশাহী, রংপুরসহ বিভিন্ন জায়গায় ফুলকপির চাষ হয়।
আরও পড়ুন:
কোনো এক রম্য নাটকে প্রেয়সীকে ফুলের বদলে ফুলকপি দেওয়ায় নায়ককে যারপরনাই ট্র্যাজেডির কবলে পড়তে হয়েছিল—এমনটাই দেখা গেছে। তবে শীতের আগমনধ্বনি টের পেতে না পেতেই সবার মন-প্রাণ-রসনা সবকিছুই যে সদ্য ওঠা ফুলকপির নানা পদের জন্য আকুলি-বিকুলি করে ওঠে, সে কথা স্বীকার না করে কোনো উপায়ই নেই। শীতের দুপুরে কই মাছ দিয়ে রাঁধা ধোঁয়া ওঠা ফুলকপির তরকারি হোক, আর হিম হিম সন্ধ্যায় চায়ের সঙ্গে গরমাগরম ফুলকপির বড়া, এ দেশে শীতের আমেজ ফুলকপির সংগত না পেলে যে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে না। আবার এদিকে ফুলকপির অবাক করা সব স্বাস্থ্যগুণের কারণেও খাদ্যতালিকায় এর গুরুত্ব বেড়ে যায় বহুগুণে।
ফুলকপি দেখতে ফুলের মতো বলে লাতিন ভাষায় ‘কপির ফুল’ কথাটিই মুখে মুখে কলি ফ্লাওয়ার নামে একে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে বিশ্বব্যাপী। ক্রুসিফেরাস গোত্রীয় এই সবজির দলে আরও আছে ব্রকলি, বাঁধাকপি, মুলা আর ব্রাসেলস স্প্রাউট। ফুলকপির ডাঁটা খাওয়া গেলেও মূলত মস্তকাকৃতি হালকা হলুদ বড় ফুলেল অংশটিই খাওয়া হয়ে থাকে দুনিয়াজুড়ে।
পুষ্টি উপাদান
শুধু সুস্বাদু নয়, ফুলকপির মতো পুষ্টিগুণ খুব কম সবজিতে আছে। আবার এদিকে তুলনামূলকভাবে অত্যন্ত কম ক্যালরিযুক্ত এই সবজিতে মানবদেহের জন্য অত্যাবশ্যকীয় সব ধরনের ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ আছে। এক কাপ ফুলকপিতে মাত্র ২৫ ক্যালরি আছে, অথচ খাদ্য আঁশ মিলবে প্রায় তিন গ্রামের মতো। দৈনন্দিন প্রয়োজনের ২০ শতাংশ ভিটামিন কে, আর ভিটামিন বি৬ আছে ১১ শতাংশ, ভিটামিন বি ৯ বা ফোলেট আছে ১৪ শতাংশ। এদিকে, দৈনিক প্রয়োজনের প্রায় ৭৭ শতাংশ ভিটামিন সি শুধু এক কাপ ফুলকপিতে থাকলেও এর সুফল পেতে তাপ প্রয়োগ থেকে বিরত থাকতে হবে। খনিজ পদার্থ, যেগুলো আমাদের শারীরবৃত্তীয় সামগ্রিক প্রক্রিয়াগুলোর জন্য অত্যাবশ্যকীয়—সেগুলোও কিন্তু পর্যাপ্ত পরিমাণে আছে ফুলকপিতে। এক কাপ ফুলকপিতে দৈনিক চাহিদার প্রায় ৯ শতাংশ পটাশিয়াম, ৮ শতাংশ ম্যাংগানিজ, ৪ শতাংশ ম্যাগনেশিয়াম এবং ৪ শতাংশ ফসফরাস মজুত আছে। তাই দেখতে সাদামাটা হলেও ফুলকপিকে পুষ্টিগুণের আধার বললে ভুল হবে না।
সুস্বাস্থ্যের জন্য ফুলকপি
ফুলকপিতে রয়েছে অনেক স্বাস্থ্যকর উপাদান। নানা ধরনের রোগ থেকে সুরক্ষা পেতে ফুলকপি তাই দারুণ কার্যকর। দেখা যাক কী আছে ফুলকপিতে—
কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে
উচ্চ পরিমাণে খাদ্য আঁশ থাকায় ফুলকপি হজমে সহায়ক। কোষ্ঠ পরিষ্কার রেখে ও উপকারী ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি-বৃদ্ধি নিশ্চিত করে এই খাদ্য আঁশ।
ডায়াবেটিস ও হৃদ্রোগ প্রতিরোধে
বেশি আঁশযুক্ত খাবার বলে ফুলকপি ডায়বেটিস, হৃদরোগের মতো প্রাণঘাতী রোগ প্রতিরোধ করতে পারে। ফুলকপি ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য আদর্শ খাবার হিসেবে বিবেচিত। এতে প্রোটিন, ম্যাগনেশিয়াম, ফসফরাস, পটাশিয়াম এবং ম্যাংগানিজ রয়েছে। ফুলকপির জিআই ৫-১৫ এর মধ্যে গণনা করা হয়। ফুলকপিতে ফাইবার রয়েছে, যা রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখে।
ওজন নিয়ন্ত্রণে ফুলকপি
জলীয় অংশ আর অধিক খাদ্য আঁশের জন্য ফুলকপি ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। এ ক্ষেত্রে ফুলকপির ভাত সহায়তা করতে পারে। এক কাপ ফুলকপির ভাতে চালের ভাতের তুলনায় প্রায় ৮০ ভাগ কম ক্যালরি থাকে। এতে নেট শর্করার পরিমাণও চালের ভাতের তুলনায় প্রায় ১৮ ভাগের ১ ভাগ। ফলে এটি শর্করার বিকল্প হিসেবে কাজ করে ওজন কমাতে সহায়তা করতে পারে।
দাঁতের সুরক্ষায় ফুলকপি
দাঁতের সুরক্ষায় সহায়তা করে ফুলকপি। বিশেষ করে দাঁত লালচে হওয়া এবং দাঁতের মাড়ি দুর্বল হয়ে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে পারে এ সবজি। ফুলকপিতে রয়েছে দাঁতের মাড়ির জন্য উপকারী ক্যালসিয়াম ও ফ্লোরাইড নামের দুটি উপাদান। এগুলো দাঁতের উজ্জ্বলতা বাড়ায় এবং বাড়ন্ত শিশুদের দাঁতের পূর্ণ বিকাশে সহায়তা করে।
ক্যানসার প্রতিরোধে ফুলকপি
শরীরকে ফ্রি র্যাডিকেল মুক্ত রাখতে ও সুস্থতা নিশ্চিত করতে যেসব অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের কথা বলা হয়, তার অনেকগুলোই ফুলকপিতে পাওয়া যায়। বিশেষত, অন্যান্য ক্রুসিফেরাস জাতীয় সবজির মতোই ফুলকপিতে গ্লুকোসিনোলেটস আর আইসথায়োসায়ানেটস নামক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বেশ ভালো পরিমাণে থাকে। ক্যানসার গবেষণায় এ দুই ধরনের অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের ব্যাপারে বেশ ইতিবাচক ফল পাচ্ছেন গবেষকেরা। ল্যাবরেটরি টেস্টে ফুলকপিতে থাকা এই খাদ্য উপাদানগুলোর কোলন, ফুসফুস, স্তন ও প্রোস্টেট বা অন্ডকোষের ক্যানসার প্রতিরোধে ভালো ভূমিকা থাকতে পারে, এমনটাই উঠে এসেছে ফলাফলে।
ফুলকপিতে ক্যারোটিনয়েড আর ফ্ল্যাভনয়েড নামক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপস্থিতি রয়েছে। এ দুটি উপাদানের ক্যানসার প্রতিরোধী ভূমিকাসহ শরীরে আরও অন্যান্য রোগ প্রতিরোধ শক্তি গড়ে তোলার ক্ষমতা আছে বলে গবেষণায় দেখা যাচ্ছে।
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে ফুলকপি
ফুলকপির উচ্চ পরিমাণের খাদ্য আঁশ সার্বিকভাবে রক্তে ক্ষতিকর এইচডিএল কোলেস্টেরল কমিয়ে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে বেশ সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। কিছু নির্ভরযোগ্য ল্যাবরেটরিকেন্দ্রিক গবেষণায় দেখা গেছে, ফুলকপির সালফোরাফেন নামক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে ভালো ভূমিকা আছে। এতে পটাশিয়াম আর ম্যাগনেশিয়ামের পরিমাণ বেশি থাকায় তা হৃদ্যন্ত্রের কার্যকারিতা স্বাভাবিক রাখতে ভূমিকা রাখে ফুলকপি। ফলে উচ্চ রক্তচাপ থাকে নিয়ন্ত্রণে।
যদি কাঁচা বা নামমাত্র তাপে নেড়েচেড়ে খাওয়া যায়, তাহলে ফুলকপিতে থাকা অধিক পরিমাণে ভিটামিন সি-ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ভূমিকা পালন করতে পারে।
প্রদাহ ও ব্যথা দূর করে ফুলকপি
ফুলকপির আছে প্রদাহরোধী ভূমিকা। এতে শরীরের সামগ্রিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বেড়ে যায়।
মস্তিষ্কের বিকাশ ও অন্যান্য উপকারে
ফুলকপিতে আছে কলিন। এটি সাম্প্রতিক গবেষণায় উঠে আসা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শারীরবৃত্তীয় রাসায়নিক উপাদান বলে সাড়া জাগাচ্ছে বিশ্বব্যাপী। বলা হচ্ছে, বিশ্বের প্রচুর মানুষের দেহে এই উপাদানের অভাব রয়েছে। এক কাপ ফুলকপিতে থাকে ৪৫ মিলিগ্রাম কলিন, যা পরিমাণে যথেষ্ট। এই কলিনের রয়েছে দেহে কোষ আবরণী অক্ষুণ্ন রাখা, ডিএনএ সংশ্লেষণ, হজম প্রক্রিয়া ঠিক রাখার মতো বহু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। মস্তিষ্কের সঠিক বৃদ্ধি ও বিকাশের ক্ষেত্রেও এর জোরালো ইতিবাচক ভূমিকা থাকার কথা জানা যায়। আর সেই সঙ্গে লিভারে চর্বি জমতে দেয় না বলে কলিন আজকাল গবেষকদের আগ্রহের শীর্ষে আছে। পর্যাপ্ত পরিমাণে কলিন গ্রহণ না করলে লিভার ও হার্টে রোগ হতে পারে, স্নায়বিক বৈকল্য ও দুর্বলতাও দেখা দিতে পারে। আর ফুলকপির মতো ক্রুসিফেরাস সবজি ছাড়া এই অত্যাবশ্যকীয় উপাদানটি তেমন পাওয়াই যায় না।
ত্বকের যত্নে ফুলকপি
ফুলকপির ভিটামিন সি, লেনোলেয়িক অ্যাসিড নামের দরকারি ফ্যাটি অ্যাসিড, ওমেগা থ্রি ও ভিটামিন কে থাকায় নিয়মিত সঠিক গুণাগুণ অক্ষুণ্ন রেখে রেঁধে ফুলকপির নানা পদ খেলে ত্বকের সমস্যাও এড়ানো যায়।
কিডনির যত্নে ফুলকপি
ফুলকপিতে ক্ষারীয় ভাব। এ জন্য কিডনিতে চাপ কম পড়ে।
ফুলকপির রেসিপি
ফুলকপির মতো সর্বজনীন সবজি আর নেই। সেই মার্কিন মুলুকের কলি ফ্লাওয়ার ম্যাশ, আর আমাদের দেশের ফুলকপির বড়া—সব ভাবেই অনন্য এই ফুলকপি। যারা ভাতের বিকল্প হিসেবে স্বল্প শর্করাযুক্ত খাদ্য খেতে চান, তাঁদের জন্য রয়েছে কলি ফ্লাওয়ার রাইস। এতে আস্ত ফুলকপি কুরিয়ে নিয়ে ভাতের মতো রান্না করে সে দানাদার কুরানো কলি ফ্লাওয়ার রাইসকে ভাতের বদলে খাওয়া হয়। আস্ত তন্দুরি ফুলকপি, আলু কপির সবজি, ফুলকপির ডালনা, মাঞ্চুরিয়ান-এর পদের যেন শেষ নেই। বিকেলে চায়ের সঙ্গে ফুলকপির বড়ার কিংবা শিঙাড়া জনপ্রিয় খাবার আমাদের দেশে। কিমার পুর ভরা আস্ত ফুলকপির মুসাম্মানের মতো বিশেষ পদ তো বটেই, আমিষের মিশেলে ফুলকপিতে নিত্যদিনের মাছ মাংসের ঝোল ব্যাঞ্জনেও শীতকাল হয়ে ওঠে উৎসবমুখর। শীতের দুপুরে কই মাছ দিয়ে রাঁধা ধোঁয়া ওঠা ফুলকপির তরকারি হোক, আর হিম হিম সন্ধ্যায় চায়ের সঙ্গে গরমাগরম ফুলকপির বড়া, এ দেশে শীতের আমেজ ফুলকপির সংগত না পেলে যে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে না।
এ ছাড়া রুই-কাতলার মতো বড় আঁশযুক্ত মাছ ও ছোট দেশীয় মাছের সঙ্গে, আলুর সঙ্গে, মুরগি, গরু বা খাসির মাংসের সঙ্গে, বিভিন্ন সবজির সঙ্গে ঘন্ট বা লাবড়া হিসেবে ফুলকপির বহুল ব্যবহার রয়েছে আমাদের দেশে।
কোন ঋতুতে ফুলকপি হয়
ফুলকপি আমাদের দেশে সাধারণত শীতকালেই চাষ করা হয়। এ দেশে পঞ্চাশটিরও বেশি জাত আছে এই সবজির। তবে গ্রীষ্মকালীন জাতের চেয়ে শীতের মৌসুমের ফুলকপির স্বাদ বহুগুণে উত্তম। আমাদের দেশে তো বটেই, বিশ্বের বেশির ভাগ দেশেই ফুলকপি খুবই জনপ্রিয় সবজি। চীনে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি উৎপন্ন হলেও ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রও এদিক থেকে একটুও পিছিয়ে নেই।
চাষের মাটি
পানি দাঁড়ালে ফুলকপির গাছ ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে দোআঁশ মাটির উঁচু জমি এর জন্য বেশি উপযোগী। একটি গাছ থেকে একটি ফুলকপি পাওয়া যায়। ফলে এর সঠিক বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে ফাঁকা ফাঁকাভাবে রোপণ করতে হয় ফুলকপির চারা। আমাদের দেশে গাজীপুর, সাভার, নরসিংদী, রাজশাহী, রংপুরসহ বিভিন্ন জায়গায় ফুলকপির চাষ হয়।
আরও পড়ুন:
১৯৫১ সাল। ইরানের রাজা রেজা শাহ পাহলভি এলেন পৃথিমপাশা জমিদারবাড়িতে। সে এক হুলুস্থুল ব্যাপার! এ বাড়ির পূর্বপুরুষেরা ইরান থেকে এসেছিলেন বলে জানা যায়।
১ দিন আগেশীতে কাপড় ভালো রাখতে সেগুলোকে যেমন রোদে মেলে দিতে হয়, সম্পর্ক উন্নয়নে মাঝেমধ্যে তেমনি ভ্রমণেও যেতে হয়। শীত চলে এসেছে। ভ্রমণপ্রেমীরা হয়ে উঠেছেন সরব।
১ দিন আগেপর্যটন বন্ধে কারফিউ! হ্যাঁ, তেমনটিই ঘটেছে দক্ষিণ কোরিয়ায়। গ্রামের নাম বুকচন হ্যানোক। দক্ষিণ কোরিয়ার জংনো জেলায় এর অবস্থান। বুকচন হ্যানোক দেশটির ‘মাস্ট ভিজিট’ পর্যটন গন্তব্য।
১ দিন আগেভ্রমণের স্বাদ একবার রক্তে ঢুকলে, তা থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন। এক অদৃশ্য তাড়না কাজ করতে থাকে ভেতরে-ভেতরে।
১ দিন আগে