হতাশা কাটিয়ে চীনে ফিরেছেন শিক্ষার্থীরা

জীবন কুমার সরকার
প্রকাশ : ০২ এপ্রিল ২০২৩, ০৯: ৫৭

বাড়ি থেকে পাঁচ হাজার কিলোমিটার দূরের শহরে শিক্ষাজীবন কাটছে এখন। আছি চীনের হুনান প্রদেশে। চাংশা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে দারুণ কাটছে মুহূর্তগুলো। উচ্চশিক্ষা শেষ করার স্বপ্নই এখন চোখে-মুখে।

আমরা যারা চীনে পড়াশোনা করছি এবং করোনা-পরবর্তী সময়ে চীনে চলে আসতে পেরেছি, তাদের জন্য সময়টা সত্যি স্বপ্নের মতো। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে অনেক আশা নিয়ে যন্ত্র প্রকৌশল বিভাগে ভর্তি হয়েছিলাম চাংশা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু তারপরই করোনার ভয়াল প্রকোপে পড়তে হয় আমাদের। 

একে একে তিনটি সেমিস্টার অনলাইনে শেষ হয়ে গেল। একসময় ভয় চেপে বসেছিল, বাকি সেমিস্টারগুলো অনলাইনেই না শেষ করতে হয়! তীব্র হতাশা নিয়ে চীনে পড়া ছয় হাজারের বেশি বাংলাদেশি শিক্ষার্থী অপেক্ষা করে ছিলাম সবকিছু স্বাভাবিক হওয়ার জন্য। অবশেষে সবকিছু স্বাভাবিক হলো। চীনে ফিরতে শুরু করেছি আমরা। আমি নিজের ক্যাম্পাসে এসেছি গত বছরের ডিসেম্বরে। 

চীনের অভিজ্ঞতা
চীনে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের একটি বড় সমস্যা ভাষা। চীনের সাধারণ মানুষ সাধারণ ইংরেজি ভাষাও জানে না। তবে এটা ঠিক যে চীনের মানুষ অনেক আন্তরিক। আমরা এখানে সাধারণত দোভাষী সফটওয়্যার ব্যবহার করি ভাষা বোঝানোর জন্য। একবার প্রয়োজনের কথা বোঝাতে পারলে তারা বেশ আন্তরিকতার সঙ্গে সহায়তা করে। আমি একদম আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভ্যাকেশনের শুরুর সময়টাতে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেছি। ক্লাস বন্ধ, হাতে তাই যথেষ্ট সময়। এই সময়টাকে কাজে লাগানোর জন্য প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয়ের আনাচকানাচ হেঁটেই চেনার চেষ্টা করি। বিকেল হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের টাইমস টাওয়ার কিংবা সেন্ট্রাল লাইব্রেরির সামনের লেকের পাড়ে বসে গিটার বাজিয়ে গান গাওয়ার চেষ্টা করতাম। বেশ কিছু চায়নিজ বন্ধুও জুটে যায় এই সুবাদে। তাদের সঙ্গে আড্ডা দিতে দিতে শেখার চেষ্টা করলাম তাদের সংস্কৃতি ও ভাষা।

বসন্ত উৎসব ও প্রদর্শনী
চীনের বসন্ত উৎসব বেশ বড় ও রঙিন। এত দিন কেবল শুনেই এসেছি এ গল্প। এবার দেখার পালা। ক্যাম্পাস জীবনে আমার প্রথম অনুষ্ঠানই ছিল বসন্ত উৎসব। এরপর হুনান আর্ট মিউজিয়ামের প্রদর্শনী। বসন্ত উৎসবের যখন নোটিশ দেওয়া হলো, তখন খুব উৎফুল্ল ছিলাম। অংশগ্রহণ করলাম চীনা সংগীত, হানফু শো এবং কবিতা আবৃত্তিতে। বাংলা গান মাঝেমধ্যে গাওয়া হলেও প্রথমবার সেই উৎসবে পরিবেশন করলাম একটি চীনা গান। খুব প্রশংসাও কুড়ালাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং উপস্থিত সবার কাছ থেকে। তার কিছুদিন পরেই চায়নিজ আর্ট, পেইন্টিং এবং চীনা বিখ্যাত পেইন্টার চি বাইসি সম্পর্কে জানার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই গিয়েছিলাম হুনান আর্ট মিউজিয়ামে।

আবিষ্কারের নেশা
শহর চাংশা আবিষ্কারের নেশা পেয়ে বসল ইতিমধ্যে। তীব্র শীত ছিল ভ্যাকেশনের সময়। যখনই বাইরের আবহাওয়া একটু অনুকূলে আসত, বন্ধুদের সঙ্গে অথবা ক্যাম্পাসের বড় ভাইদের সঙ্গে চলে যেতাম ঘুরতে। ইতিমধ্যে ঘুরেছি কমলা দ্বীপ, ইয়েলো মাউন্টেন, কাইফু মন্দির, সেন্ট্রাল সাউথ ইউনিভার্সিটি, হুনান ইউনিভার্সিটিসহ বেশ কিছু জায়গা। চেনার চেষ্টা করেছি চাংশা শহরটাকে।

চাংশা ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের ক্রিকেট টিমক্রিকেট টুর্নামেন্ট
মাশরাফি-সাকিবের দেশের মানুষ আমরা। ক্রিকেট না খেললে চলে! আর যদি সহশিক্ষার্থী ও বন্ধুদের উসকানি থাকে, তাহলে তো কথাই নেই। আমাদের ক্যাম্পাসে দেড় হাজারের বেশি আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর মধ্যে বাঙালি শিক্ষার্থী শতাধিক। যে কারণে চলতে-ফিরতে মনে হয় নিজের দেশেই আছি। প্রতিদিন বিকেল হলেই আমাদের ক্রিকেট খেলা চলে। এর মাঝেই অনুষ্ঠিত হয়েছে বাঙালি শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্রিকেট টুর্নামেন্ট। মাঝে দুই দিন পার্শ্ববর্তী সেন্ট্রাল সাউথ ইউনিভার্সিটির বাঙালি শিক্ষার্থীদের সঙ্গেও অনুষ্ঠিত হয়েছে প্রীতি ক্রিকেট টুর্নামেন্ট।

আন্তরিক শিক্ষকেরা
চীনে ভর্তির আগে একটা সমীক্ষায় দেখেছিলাম, এখানে প্রতি সতেরোজন শিক্ষার্থীর জন্য একজন শিক্ষক পরিশ্রম করেন। আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের শিক্ষা এবং শিক্ষাবিষয়ক বিভিন্ন সহযোগিতার জন্যও অসংখ্য শিক্ষক রয়েছেন। যেকোনো সমস্যা শিক্ষকেরা আন্তরিকতার সঙ্গে সমাধান করে দেন। 

চাংশা ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির একাংশক্যাম্পাসে ফিরে যেমন আছি
ভর্তির পর অনলাইনে ক্লাস ছিল আমাদের কাছে নরকের মতো। আমাদের অনেক সিনিয়র রয়েছেন, যাঁরা মাত্র একটি সেমিস্টার সরাসরি ক্লাস করার পরেই দেশে ফিরতে বাধ্য হয়েছিলেন। তাঁদের অনেকে হতাশায় আত্মহত্যার চিন্তাও করেছিলেন! সব হতাশা কাটিয়ে এখন আমরা সবাই চীনে নিজ নিজ ক্যাম্পাসে ফিরতে সক্ষম হয়েছি। এখন সময়টা কাজে লাগিয়ে স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে দৌড়ানোর পালা। 

জীবন কুমার সরকার, শিক্ষার্থী, চাংশা ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, হুনান, চীন

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত