পর্যটনের নেতিবাচক প্রভাব সেন্ট মার্টিনের জীববৈচিত্র্যে

সাবিত আল হাসান, সেন্ট মার্টিন থেকে ফিরে
Thumbnail image

পরিবেশ সংকটাপন্ন সেন্ট মার্টিন দ্বীপে সূর্যাস্তের পর সৈকতে আলো জ্বালানো সম্পূর্ণ নিষেধ। কচ্ছপসহ সামুদ্রিক প্রাণীদের রক্ষার জন্য এই নিয়ম জারি রয়েছে দ্বীপটিতে। কিন্তু এসব নিয়ম মানছে না কেউ। রাতভর সৈকতের পাশে আলো জ্বালিয়ে চলছে ব্যবসা। সৈকতসংলগ্ন কটেজ-রিসোর্টগুলোতে করা হয়েছে বাড়তি আলোকসজ্জা। এলইডি লাইট স্থাপন করে পর্যটন মৌসুমে পুরো দ্বীপকে পরিণত করা হয়েছে উৎসবকেন্দ্রে।

চোখের সামনে দ্বীপের এমন আইন ভঙ্গের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না স্থানীয় চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান। তাঁর দাবি, ‘সেন্ট মার্টিনে বিচের পাশে এক-আধটু আলো জ্বলবেই সিজনের সময়। এটা একটু মেনে নিতেই হবে। আমরা (দ্বীপবাসী) বাঁচলেই সবকিছু বাঁচবে।’
রাতের আঁধারে দ্বীপের সুরক্ষা নিশ্চিতে পরিবেশ অধিদপ্তর বেশ কয়েকটি নির্দেশনা দিয়েছে। এসবের মধ্যে রয়েছে— 

  • সৈকতে কোনো প্রকার আলোকসজ্জা না করা। 
  • আতশবাজি ও ফানুস না ওড়ানো। 
  • কচ্ছপের ডিম পাড়ার জায়গায় চলাফেরা না করা। 
  • রাতে সৈকতে ক্যামেরার ফ্ল্যাশ লাইট ব্যবহার না করা। 
  •  উচ্চ শব্দ না করা বা মাইক না বাজানো। 

কিন্তু এর কোনোটিই মানা হচ্ছে না সেন্ট মার্টিনে। উল্টো পর্যটকদের অবাধ চলাচল, স্থানীয়দের ব্যবসা, মাইক বাজানো, আলোকসজ্জায় উদ্ভাসিত পুরো দ্বীপ।

দ্বীপ ঘুরে দেখা যায়, সৈকতের উত্তর থেকে পশ্চিম প্রান্তের স্যান্ড ক্যাসেল রিসোর্ট পর্যন্ত কিছু দূর পরপরই বসানো হয়েছে অস্থায়ী দোকান। এর কোনোটিতে আছে ডাব, সামুদ্রিক মাছ, চা-সিগারেট কিংবা খাদ্যপণ্যের পসরা। প্রায় সব দোকানেই ব্যবহার করা হচ্ছে সাদা আলো। এ ছাড়া সৈকত লাগোয়া রিসোর্টগুলোতে রয়েছে উজ্জ্বল আলোর ঝলকানি। লাল, নীল, সবুজ এলইডি বাতিতে ছেয়ে ফেলা হয়েছে সৈকতসংলগ্ন এলাকা। অল্প কিছু জায়গা ছাড়া উত্তর থেকে পশ্চিম সৈকত পর্যন্ত আলোকিতই থাকে সারা রাত। 

উত্তর সৈকতে ডাব ও চায়ের ফ্লাক্স নিয়ে দোকান বসানো এক কিশোর জানিয়েছে, সারা রাত তার দোকান খোলা থাকে। রাতে সৈকতে আলো না জ্বালানোর জন্য পোস্টার থাকলেও সে বিষয়ে কেউ কিছু বলে না। 

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের নেতা তারিক বাবু বলেন, ‘উজ্জ্বল আলো শুধু কাছিম নয়, বহু সামুদ্রিক প্রাণী ও দ্বীপের জীববৈচিত্র্যের সমস্যা তৈরি করে। কিন্তু এ নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। বিধিনিষেধ অমান্য করা দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য হলেও ব্যবসায়ীরা প্রশাসনের নাকের ডগায় ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন।’

সচেতন পর্যটক ও স্থানীয় লোকজন জানান, চার মাসব্যাপী পর্যটন মৌসুম চলাকালে দ্বীপের যে পরিমাণ ক্ষতি হয়, তা পূরণ করতে পারে না দ্বীপের প্রকৃতি। জনপ্রতিনিধি, প্রশাসন ও পর্যটকদের উদাসীনতার কারণে দিন দিন ক্ষতির মুখে পড়ছে সেন্ট মার্টিনের পরিবেশ।
কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিদর্শক মুসাইব ইবনে রহমান বলেন, ‘আমরা সাধ্যমতো অভিযান চালাচ্ছি এবং মামলা করছি।

সম্প্রতি ১২টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করেছি। এখন প্রশাসন যদি কঠোর হয়, তাহলে এ ধরনের কার্যক্রম বন্ধ করা সম্ভব। আমরা চাইলেই উচ্ছেদ করতে পারি না। আমরা আইনগত ব্যবস্থা, মামলা বা জরিমানা করতে পারি। যদি প্রশাসন উচ্ছেদ অভিযান চালায়, তাহলে পরিবেশ অধিদপ্তর তাদের পাশে থাকবে। লাইট পলিউশনের বিষয়ে আমাদের কাছে আগেও অভিযোগ আছে। এ ছাড়া সৈকতে দোকান বসানো, প্রবাল তুলে অন্যত্র সরানো—এ বিষয়গুলো আমরা অবগত। এগুলো নিয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনাও দেওয়া আছে।’ 

একই বিষয়ে কক্সবাজার বিভাগীয় বন কর্মকর্তা সারওয়ার আলম বলেন, ‘সেন্ট মার্টিনের পরিবেশের সঙ্গে যা করা হয়েছে তাতে শুধু কচ্ছপ নয়, উদাসীনতার কারণে সেন্ট মার্টিন থেকে বিপুল পরিমাণ প্রাণী হারিয়ে গেছে। অনেক প্রাণী হুমকির মুখে আছে। আগে একসময় প্রবাল, শৈবাল, মোলাস্ট, কাঁকড়া, ডলফিন, বিভিন্ন উভচর প্রাণী, পাখি, সরীসৃপের বসবাস ছিল এখানে। এগুলো দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। এর পরেও এ বিষয়ে অনেকেই উদ্বিগ্ন নন। মানুষ যদি সচেতন না হয়, তাহলে এই সেন্ট মার্টিন ঝুঁকির মধ্যে পড়বে এটাই স্বাভাবিক।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত