উজবেকের সবুজ হ্রদ শুভ্র পাহাড়

এলিজা বিনতে এলাহী
আপডেট : ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৮: ২৯
Thumbnail image

আন্দিজান শহর থেকে ফিরছি ফারগানা শহর ছুঁয়ে। কিন্তু তখনো আন্দিজান শহরের ঘোর কাটেনি। সেখানে যাওয়ার পথে নামানগান ভ্যালি আর মোগল সম্রাট বাবরের জন্মস্থানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ফারগানা শহরে উজবেক ইকাত ও সিরামিক। সবকিছু আচ্ছন্ন করে রেখেছে। সড়কপথে ফিরতে গিয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেল। সন্ধ্যায় দেখছিলাম উজবেকিস্তানের রাজপথ, গাছপালা, পথের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তুষারঢাকা একেবারে শ্বেতশুভ্র মোটর গাড়ি। তখন তুষারপাত বন্ধ হয়েছে, কিন্তু সফেদ হয়ে আছে চারপাশ।

রেশম পথের ভ্রমণ এই ফুরাল বলে। তাই মন কিছুটা ভারাক্রান্ত। কাল যদি তাসখন্দে আবারও তুষারপাত হয়, তবে ভ্রমণে ছেদ পড়বে। পুরো দিনের পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে। যদিও গুগলে ওয়েদার রিপোর্ট চেক করেছি। তারপরও কোনো এক অজানা আশঙ্কা মাথায় ভিড় করছে। ভাবতে ভাবতে হোটেলরুমের বিছানায় কখন চোখ বুজে গেছে, একদম টেরই পাইনি।

বেশ সকালে উঠে জানালার পর্দা সরিয়ে ঝলমলে রোদ দেখে মন খুশি হয়ে গেল। যদিও তাপমাত্রা মাত্র ১ ডিগ্রি। আজকের গন্তব্য চারবাগ লেক। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় আড়াই হাজার ফুট উঁচুতে।

উজবেকিস্তানের চারবাগ একটি কৃত্রিম হ্রদ, এটি তৈরি হয় ১৯৬৬ সালেশহরের পথের তুষার তখনো দৃশ্যমান। শহরতলির দিকে এগোচ্ছে আমাদের মিনি ভ্যান। একটু পরপর গাইড মির্জা বেগ মোবাইল ফোন দেখে আমাদের জানান দিচ্ছেন, কত ওপরে রয়েছি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে।

তুষারঢাকা পথ শুরু হলো। এমন নয় যে তুষারপাত আমি দেখিনি। হিমাঙ্কের নিচে মাইনাস ২৫ ডিগ্রি তাপমাত্রায়ও আমি হেঁটেছি ১৭ হাজার ফুট উঁচুতে। দেশ-বিদেশের পাহাড়, টিলা, পর্বতেও হেঁটেছি। কেন জানি না এই তুষারমাখা পথ ভ্রমণে একটি ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে।

এলিজা বিনতে এলাহীচারবাগ হ্রদ আমাদের ভ্রমণতালিকায় ছিল না। সময়-সুযোগ পেয়ে কিছু বাড়তি অর্থ ব্যয়ে নতুন করে সংযোজন করা হয়েছে। তুষারঘেরা পথ পেরিয়ে প্রথম গন্তব্য আমিরসই নামের একটি রিসোর্ট। সেখানে কেব্‌ল কার রয়েছে পর্বতের চূড়ায় যাওয়ার জন্য। পর্বতের নাম চিমগান। এর অর্থ সবুজ ঘাসের পাহাড়। গ্রীষ্মের সময় হয়তো চিমগান পাহাড় সবুজ ঘাসে ঢেকে যায়, তাই এমন নাম রাখা হয়েছে। আমিরসইয়ের মতো আরও অনেক রিসোর্ট আছে, কিন্তু কোনো এক কারণে গাইড মির্জা আমাদের জন্য এটিই নির্ধারণ করেছেন। ভ্যান থেকে আমিরসইয়ে নেমে দেখলাম, কোনো দিকে পথ দেখা যাচ্ছে না। খুব সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে। মির্জা আমাদের জন্য টিকিট কেটে, সেগুলো হাতে দিয়ে ঘোষণা করলেন, ‘টিকিট সাবধানে রাখুন। ফেরার সময় প্রয়োজন পড়বে।’ এরপর শুরু হলো কেব্‌ল কার যাত্রা।

ছবি: লেখকশব্দে যে এত মাধুর্য থাকতে পারে, কী করে বয়ান করব! আমার শব্দভান্ডার ভীষণ সীমিত। ভালো লাগার জায়গাগুলোতে যা হয়, সেই একই অবস্থা—দেখব না ছবি তুলব, নাকি স্থির হয়ে মৌনব্রত পালন করব! ওপর থেকে সবকিছু আরও সাদা, আরও বেশি সুন্দর লাগছে। কেব্‌ল কারের পাট চুকিয়ে এবারের গন্তব্য চারবাগ লেক। আমিরসই থেকে মিনিট চল্লিশের মতো সময় লাগল। পথ একই রকম মায়াভরা। মির্জা বলছিলেন, এখন নাকি হ্রদ কিছুটা শুকিয়ে গেছে। এই পথকে উজবেকিস্তানের সুইজারল্যান্ড বলা হয়। যদিও এ রকম তুলনা আমার ভালো লাগে না। পথে যেতে যেতে মির্জা চারবাগ হ্রদ সম্পর্কে তথ্য দিচ্ছিলেন।

ছবি: লেখকচারবাগ আসলে একটি কৃত্রিম হ্রদ, এটি তৈরি হয় ১৯৬৬ সালে। সোভিয়েত আমলে ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত উজবেকিস্তানে কম মূল্যে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য এই লেক বা রিজার্ভার গড়ে তোলা হয়েছিল। এর নীলাভ সবুজ রঙের পানি দেখে কোনোভাবেই কৃত্রিম ভাবতে চাইছিল না মন। দমকা হাওয়ায় মোবাইল দুই হাতে ধরে রাখা মুশকিল হচ্ছে। ঠান্ডায় হাত জড়ো হয়ে আসছে। বাতাসে নিজেকে সামলে নেওয়া মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। অল্প কিছু ছবি তুলে গাড়িতে গিয়ে বসলাম তাসখন্দমুখো হওয়ার উদ্দেশে। চারবাগ হ্রদের অবস্থান পশ্চিম তিয়ানশান পর্বতমালার মাঝখানে। এ জন্য স্থানীয়রা চারবাগ লেককে তিয়ানশান পর্বতমালার মুক্তো বলে ডাকে।

এই বিশাল কৃত্রিম হ্রদ ও জলাধার পাহাড়ের সবুজ ঢালে ঘেরা। হ্রদটি উগাম, চাটকাল ও পস্কেম নামের তিনটি পার্বত্য নদীর পানি দিয়ে সংযুক্ত। এখানকার চিমগান পর্বত ও চারবাগ হ্রদ উগাম-চাটকাল জাতীয় উদ্যানের অন্তর্গত। এটি উজবেকিস্তানের বড় জাতীয় উদ্যানগুলোর মধ্যে অন্যতম। পাহাড়ি ছাগল, ভালুক, নেকড়ে, শিয়াল, বন্য শূকর, শজারু এবং ২০টির বেশি প্রজাতির পাখির বাড়ি এখানে। যেতে যেতে পথে চোখে পড়েছে ঘোড়া আর মিউল।

ছবি: লেখকদুপুর হয়ে এল। পথে গজলকেন্ট গ্রামের ফারোভান রেস্টুরেন্টে গেলাম দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য। সুন্দর পরিচ্ছন্ন রেস্তোরাঁ, সাজসজ্জাও দারুণ। খাওয়া শেষ করার পর গেলাম প্রায় ৮০০ বছরের পুরোনো সিনার গাছ দেখতে। এর পাশেই একটি গুহা চোখে পড়ল। গাইড জানালেন, এই গুহায় একসময় মানুষ বসবাস করত।

দিন প্রায় ফুরিয়ে এসেছে, সঙ্গে উজবেক ভ্রমণের সময়। তাসখন্দ অভিমুখে রওনা হব এবং আজ রাতেই দেশের উদ্দেশে।

ছবি: লেখক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত