অচেনা চীনে

রহীম মোয়াল্লেম 
প্রকাশ : ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৭: ২৭

প্রতিটি দেশ কিংবা অঞ্চলের নিজস্ব ঘ্রাণ আছে। সে ঘ্রাণ ছড়িয়ে যাচ্ছে বাতাসে। চীনেরও নিজস্ব ঘ্রাণ আছে। চীন-জাপান প্রথম ও দ্বিতীয় যুদ্ধ, নিজেদের গৃহযুদ্ধ, পশ্চিমি রাজনীতি ও প্রপাগান্ডা—সবকিছুকে সরিয়ে চীনে সমাজতান্ত্রিক সংগ্রাম জয়ী হয়। মার্ক্স-লেনিন-মাওবাদের আঙুল ধরে শুরু হয় নয়াচীনের যাত্রা। অনুর্বর জাতির উর্বর হয়ে যাওয়ার জাদুবাস্তবতা। মাও সে তুংয়ের মৃত্যুর পর বিস্ময়কর এক জাদুকরের আবির্ভাব হয়, তিনি তেং শিয়াও পিং—সমাজতান্ত্রিক চীনের দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট। তিনি বদলে দেন চীনের অর্থনীতি।

অনেকে শিয়াও পিংকে চীনের ফাদার অব ইকোনমিকস বলে সম্বোধন করেন। চীনের অর্থনৈতিক পরাশক্তি হয়ে ওঠার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা তাঁর। 

সিচুয়ানের গুয়ানিনে শিয়াও পিংয়ের আদি বাড়িতে গিয়েছিলাম। সেখানে আলাপ হয় ব্রুসের সঙ্গে। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষক তিনি। কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। বিস্তারিত জানিয়েছিলেন শিয়াও পিং সম্পর্কে। 

ব্রুস আমেরিকায় প্রায় ১০ বছর কাজ করেছেন। তাঁকে যখন বলেছিলাম, চীনের অর্থনীতি আর ১০ বছর পর বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী হয়ে উঠবে। তিনি শুধু বলেছিলেন, আমেরিকার কাছাকাছি যেতে দীর্ঘ সময় সাধনা করতে হবে। মার্কিন রণশক্তি অনেক ওপরে।

চীনের অলিগলিতে হাঁটলে আন্দাজ করা যায় সে দেশের সংস্কৃতি, পোশাক, স্থাপত্যশিল্পের কী দারুণ নিজস্বতা! পেইকিং অপেরার মন্ত্রমুগ্ধকর মঞ্চায়ন। আধুনিক চীনের শহরগুলোর অবকাঠামো মনে হয় পশ্চিমাদের ক্লোন। তরুণদের মধ্যে পশ্চিমি প্রভাব লক্ষণীয়। তবে ঐতিহ্যগতভাবে তাঁদের পুরোনো বাড়িঘর যেন সম্পূর্ণ ভিন্ন এক জগতে নিয়ে যায়। 

চীনের সবচেয়ে বড় বিপ্লব হলো যোগাযোগব্যবস্থার অকল্পনীয় উন্নতি। হাজার হাজার কিলোমিটার পাহাড়ের শরীর চিরে চলে গেছে ট্রেনের লাইন। গুয়াংশি থেকে সিচুয়ান ১ হাজার ২৪৩ কিলোমিটার যেতে দুর্গম পাহাড়ি রেলপথ দেখে বিস্মিত হয়েছি। এত দুর্গম যে মনে হয়, এখানেও কি মানুষের উপস্থিতি সম্ভব! পাহাড়ঘেরা শহরগুলো দেখলে অবাক না হয়ে পারা যায় না। প্রকৃতি ও মানুষের সন্ধি, পাখিদের অভয়ারণ্য নিশ্চিত করেই চীনের নগরায়ণের অগ্রযাত্রা। পাহাড় ও বৃক্ষের কোনো ক্ষতি না করে যতটুকু সমভূমি আছে, তাকেই মানুষের জন্য উপযোগী করে নিয়েছে তারা। দুর্গম গ্রামের রাস্তা, ফুটপাত, সাবওয়ের সুযোগ-সুবিধা এখনই দেখা যায়। চীনের মানুষেরা বলেন, তেং শিয়াও পিংয়ের সময় পরিকল্পনা করে রাখা হয়েছিল, রাষ্ট্রের অবকাঠামো কীভাবে এগোবে। 

এ দেশে শিক্ষিত মানুষের চেয়ে বেশি আন্তরিক ফল বিক্রেতা, কৃষক কিংবা স্ট্রিট ফুড বিক্রেতারা। তাঁদের সঙ্গে সামান্য নমনীয় সুরে কথা বললে যেন কেমন মেলোডির সুরে আপন করে নেন। শিক্ষিত শ্রেণির লোকজনকে মনে হবে রোবট। তাঁদের কোনো অনুভূতি নেই। যেন নিজেকে মানুষ হিসেবে বহুদিন অনুভব করেন না তাঁরা। অন্যদিকে আশ্চর্য হতে হয়, একজন কৃষক ফসলের খেতে কাজ শেষ করে নিজের বিএমডব্লিউ গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফিরছেন দেখে। শ্রমিকেরা বিকেল ৫টার মধ্যে কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরছেন অথবা নদীর পাড়ে মাছ ধরছেন, কিংবা বারবিকিউ পার্টি করছেন। হোয়াংহো ও ইয়াংসিকিয়াং নদীর অববাহিকায় সবুজ পাহাড়ে ঘেরা নৈসর্গিক মায়াবী ও আশ্চর্য দেশ চীন।

চীন সম্পূর্ণ সেক্যুলার রাষ্ট্র হলেও এখানকার বাসিন্দাদের যথেষ্ট এথিস্ট বলা যায় কি? ঐশ্বরিক আশ্রয় তাঁরাও খোঁজেন। আমার যত দূর গহিনে যাওয়ার সামর্থ্য হয়েছে, গিয়ে দেখেছি। পাহাড়ি গ্রামের গাছপালার আড়ালে তেং পোর  মন্দির। তাকে গড অব মানি বলে আরাধনা করেন চীনের কিছু মানুষ, আগরবাতি আর মোম, মদ দিয়ে। গুয়াংশির পাহাড়ি কৃষি গ্রামে গিয়ে খুঁজে পাই সুনসান বিশাল এক উপাসনালয়, যেখানে মোম, আগরবাতি ও ফুল দিয়ে মানুষজন পূজা দিচ্ছেন। পাশে ছোট্ট করে গৌতম বুদ্ধের মূর্তি। হান রাজবংশের তৃতীয় সম্রাট ছিলেন হ্যানের সম্রাট ওয়েন। তাঁর প্রকৃত নাম ছিল লিউ হেং। তিনি ছিলেন সম্রাট লিউ ব্যাংয়ের তৃতীয় পুত্র। লিউ হেং দানশীল ও ধার্মিক হিসেবে বিখ্যাত ছিলেন। এখনো তাঁর পূজা-অর্চনা করেন গ্রামের লোকজন। মূর্তির ওপর লেখা রয়েছে, আং সুই ইং হুই। এর বাংলা অর্থ, সূর্য উজ্জ্বলভাবে জ্বলছে। 

বাংলাদেশের মতো অলিগলিতে মসজিদ-মন্দির নেই চীনে। তবে পুরো শহরে একটি মসজিদ আছে। শুক্রবার হুই মুসলিম নারী-পুরুষেরা নামাজ পড়তে আসেন সেখানে। সেদিন উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করে। উইঘুর মুসলিমদের প্রতি হুই মুসলিমরা কিছুটা বিরক্ত, লক্ষ করা যায়। হুই মুসলিমরা মনে করেন, উইঘুরদের জন্য তাঁরাও কিছুটা কোণঠাসা। হুই কিংবা উইঘুর মুসলিমরা সবাই স্বাধীনভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য করে জীবনযাপন করছেন চীনে। তবে এত বিশাল দেশের একটা প্রদেশে থেকে পুরো দেশ সম্পর্কে কথা বলা মুশকিল। 

চীনের মানুষের সঙ্গে যত মিশেছি ততই দেখেছি, বিদেশিদের প্রতি তাঁদের আন্তরিকতা ভীষণ নির্মোহ। ধর্মকর্মে রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো বাধা নেই চীনে। মানুষের ব্যক্তিগত বিশ্বাস নিয়ে চায়নিজদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, রাষ্ট্র কোনো হস্তক্ষেপ করে না। ধর্মীয় উৎসবগুলোতে রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্মপ্রাণ মানুষকে নিরাপত্তা দেওয়া হয়।

সাবওয়েতে বসে এক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকার সঙ্গে কথা হয়েছিল ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে। নাম না জানা সেই নারী অনেকটা উদ্‌ভ্রান্তের মতো কথা বলছিলেন। অর্থবৈভব আর পেশাগত জীবনে পিষ্ট হয়েছেন, এত কিছু থাকার পরও তিনি শূন্য অনুভব করেন। জিজ্ঞেস করেন, সুখ কোথায়? সারা জীবন মেশিনের মতো শ্রম দিয়ে গেছি, হৃদয়ের বেদনা বলার জন্য তো আমাদের কোনো ঈশ্বর নেই! টাকাকে ঈশ্বর ভেবেছিলাম, তা এখন মূল্যহীন আবর্জনা। নির্বাক থেকে গন্তব্যে ফিরেছি।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত