এই পথে একা একা হাঁটতেন

প্রকাশ : ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৮: ২৮
আপডেট : ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৩: ৩০

অরণ্য জঙ্গলের মহাকাব্য যিনি লিখেছেন, বাঙালিকে যিনি অরণ্যপ্রেমী হতে শিখিয়েছেন, তিনি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। ১২ সেপ্টেম্বর ছিল তাঁর জন্মদিন। আরণ্যক বিভূতিভূষণকে নিয়ে লিখেছেন শিবাংশু দে

সবুজ কাগজেসবুজেরা লেখে কবিতা
পৃথিবী এখন তাদের হাতের মুঠোয়...
– বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

যাঁরা ‘মহাভারত’ লিখেছিলেন, তাঁদের কাছে বাংলাদেশ ছিল অরণ্যভূমি ‘পাণ্ডব-বর্জিত’। এখানকার লোকজন ছিলেন ‘অসভ্য’, অচ্ছুত। কিন্তু নাগরিক বাঙালি জঙ্গলকে চিনেছে বহু দেরিতে। রাজা রামমোহন বেশ কিছুদিন চাতরার জঙ্গলমহলে আমিন ও মুন্সির কাজ করেছিলেন প্রায় ২০০ বছর আগে। যে চাতরা আজকের দিনেও প্রায় দুর্গম এক অরণ্যপ্রদেশ। অগম্য, সন্ত্রাস-অধ্যুষিত সবুজের স্বর্গ। কিন্তু তাঁর কোনো লেখায় চাতরার ভূপ্রকৃতি নিয়ে কোনো উল্লেখ নেই। স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র দীর্ঘকাল মেদিনীপুরের দক্ষিণে গভীর জঙ্গল পেরিয়ে ভদ্রকে গিয়ে ডেপুটিগিরি করতেন। ‘কপালকুণ্ডলা’য় সামান্য উল্লেখ ছাড়া আর কোথাও কিছু লেখেননি। রবীন্দ্রনাথ পল্লিগ্রাম নিয়ে অনেক লেখালেখি করেছেন। কিন্তু অরণ্য নিয়ে নয়। সঞ্জীবচন্দ্রের ‘পালামৌ’ ইউরোপীয়দের ভারতদর্শন, তবে বাংলায়। বড় লেখকদের মধ্যে তো আর কারও নাম মনে আসছে না, যিনি সমুচিত আগ্রহ ও ভালোবাসা দিয়ে অরণ্যবৃক্ষের মর্যাদা দিতে চেয়েছিলেন। প্রকৃতির এ বিস্ময়টি নিয়ে প্রথম যিনি প্রকৃত শিল্প সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন, তিনি বন্দ্যকুলোদ্ভব কবি বিভূতিভূষণ।

একটা গল্প শুনেছি। বিভূতিভূষণ ঘাসমাটিতে আক্ষরিকভাবে কান পেতে কিছু শুনতে পেতেন। কী শুনতেন, তা আমরা হয়তো বুঝতে পারব না। কিন্তু তাঁর ভালোবাসার মাত্রাটি সামান্য হলেও অনুভব করতে পারি। মাত্র ১০টি বই নিয়ে যদি নির্বাসনে যেতে হয়, তবে তার একটি তো অবশ্যই ‘আরণ্যক’। অরণ্যকে কেন্দ্রীয় চরিত্র করে তার আগে তো কেউই কিছু লেখার চিন্তা করতে পারেননি। পরে লেখা হয়েছে, কিন্তু তা আরণ্যকের ধারেকাছে যেতে পারেনি। তাই বাঙালির অরণ্যচর্চার মুখ ও প্রধান প্রতিনিধি বিভূতিভূষণ। যেহেতু তিনি জীবনের অর্ধেকের বেশি সময় বিহারের বনজঙ্গলের মায়ায় বুঁদ হয়ে ছিলেন, তাই ‘বিহারি’ হিসেবে আমিও তাঁর চলাচলের পথে ধুলা ঘেঁটে বেড়াব, তাই তো স্বাভাবিক।

বিভূতিভূষণের আরণ্যকের জঙ্গল দিয়ে শুরু হয় আমাদের চৈতন্যের প্রথম সংলাপ। খেলাত ঘোষের চাকরি নিয়ে যখন তিনি ভাগলপুর যান, তখনো ওই প্রান্তটি মহাভারতের কর্ণের পড়ে পাওয়া অঙ্গরাজ্যের থেকে বিশেষ নগরায়িত ছিল না। এখন তিনটে জেলা হয়েছে– বাঁকা, গোড্ডা, দুমকা। এই সব এলাকায় জঙ্গল ছড়িয়ে ছিল সেকালে। বিভূতিবাবুর (বিহারে এভাবেই বলা হয়) লবটুলিয়া বইহারের কল্পনা আসলে পূর্ণিয়ার উত্তরে আরারিয়া থেকে ফর্বেসগঞ্জ, তরাইয়ের বনজঙ্গল। সতীনাথ ভাদুড়ি আর ফণীশ্বরনাথ রেণুর রাজপাট। আপাতত ভাগলপুর থেকে পূর্ব দিকে জগদীশপুর পেরিয়ে বাঁকার পথে বইসির কাছে দক্ষিণের বনভূমি যেতে হবে। ছোট পাহাড়ের রেঞ্জ একটা। শাল-সেগুন-গামারের বনভূমি। যেখানে পূর্ণিমা রাতে পরিরা খেলা করতে আসে। এখানেই তাঁর মহালিখারুপ অরণ্যানী। ‘মহালিখারুপ’ নামটি তিনি নিয়েছিলেন সিংভূমের মহালিমরুপ পাহাড়ের নাম অনুকরণে। সিংভূমে তাঁর চলার পথ খুঁজতে গেলে আসতে হবে জামশেদপুর থেকে দক্ষিণ-পূর্বে রাখামাইন্স, গালুডি, চাপড়ি পেরিয়ে সুর্দা মাইন্সের দিকে রুয়ামের জঙ্গল। জামশেদপুরের প্রত্যন্ত শহরতলি সুন্দরনগর পেরোলেই একটু একটু করে সবুজের রাজত্ব শুরু হয়ে যায়। করিমসাহেবের পুকুর পেরিয়ে সুন্দরনগরের দিকে বাঁদিকে বাঁক নিলেই নরোয়া পাহাড়, ভাটিন মাইনসের রাস্তা।

রাস্তাটি পৌঁছাবে জাদুগোড়া মোড়ে। যখন জাদুগোড়া থাকতুম, তখন এই রাস্তা ছিল না। ভাটিনের পর থেকে দুটো পাহাড়ের মাঝখান থেকে সরু পায়ে চলার পথ ছিল। ট্রেকিং করার জন্য আদর্শ। মুর্গাঘুটু, হরতোপা থেকে রাজদোহার দীঘি। নরওয়াপাহাড়ে মাইনিং শুরু হওয়ার পর ইউরেনিয়াম করপোরেশনের কলোনি হলো, অ্যাটমিক অ্যানার্জি কমিশনের কমপ্লেক্স বসল। জঙ্গলের মধ্যে গ্রামগুলো জুড়ে চওড়া রাস্তা। আধঘণ্টা বা পৌনে ঘণ্টার মধ্যে জাদুগোড়া কলোনি। তবে পুরোনো রাস্তাটি সত্যিই পুরোনো। জামশেদপুরের দক্ষিণে রেলস্টেশন পেরিয়ে সেই সুন্দরনগর হয়েই সোজা হাতা মোড়। ওই মোড়টির নকটার্নটির সঙ্গে অনেক চেনা নাম জড়িয়ে আছে। বাঁ দিকে গেলে সঁকরদা, কালিকাপুর পেরোলেই সিংভূমের আদি জঙ্গল। পাহাড়ের গায়ে রংকিনীদেবী মন্দির। এই লোকজ দেবী নিয়ে নানান রোমাঞ্চকর গপ্পোগাছা রয়েছে। বিভূতিভূষণের লেখায় এই দেবী বহুবার এসেছেন। এই রাস্তাটিও গিয়ে পড়ছে জাদুগোড়া মোড়ে। পাহাড়ের দক্ষিণ দিক দিয়ে। এটাই ছিল জামশেদপুর থেকে ঘাটশিলা যাওয়ার আদি রাস্তা। কলকাতা যাওয়ার জন্যও। এই পথেই পঞ্চাশ সালের এক হেমন্তের বিকেলে জরুরি তলব পেয়ে জামশেদপুরের বিধান রায়, ড. ব্রহ্মপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় অনিঃশেষ পাহাড় আর ঘন জঙ্গল পার করে ঊর্ধ্বশ্বাসে তাঁর কালো অস্টিন গাড়িটি ছুটিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন ঘাটশিলার ডাহিগোড়ায়। কিন্তু ততক্ষণে বিভূতিভূষণ দেবযানে সওয়ার হয়ে গেছেন। হাতের কালো ব্যাগটি আর খুলতে হয়নি তাঁকে। প্রণাম করে বেরিয়ে চলে এসেছিলেন।

হাতা মোড় থেকে ডান দিকে ঘুরলেই চাইবাসা হয়ে পশ্চিম সিংভূমের অন্দরমহলের আঁকাবাঁকা পথ। গোবিন্দপুর, রাজনগর, কুজুনদী। চাইবাসা পেরিয়ে ঝিকপানি, হাটগামারিয়া, নোয়ামুন্ডি, বড়াজামদা, বড়বিল, বোলানি, মহিষানি, কিরিবুরু, বরাইবুরু, মেঘাতুবুরু। আবার হাতা মোড় থেকে নাক বরাবর গেলে হলুদপুকুর পেরোলেই ওডিশার সীমান্ত। তিরিং আর বাহালদার পাশে পাশে রয়েছে বাঁকার জঙ্গল। সোজা রাইরংপুর, বিসোই, বাংরিপোসি হয়ে বারিপদা। গোটা এলাকা ছিল বিভূতিভূষণের নখদর্পণে। তিরিশ-চল্লিশের দশকে এসব জায়গা ছিল মানচিত্রের বাইরে গভীর অরণ্যানী। অগম্য, বিপজ্জনক। কিন্তু তাঁর কাছে জঙ্গলের কিছুই নেতিবাচক নয়। বাংলা সংস্কৃতিতে জঙ্গলকে অনন্ত রোমান্টিক ভাবমূর্তি দেওয়ার একটা সচেতন প্রয়াস তো তাঁর চিরকালই ছিল। জানি না তা ভালো না মন্দ। তিনি তো জন্মেছিলেন রাজা মিডার স্পর্শশক্তি নিয়ে। কিন্তু তাঁকে অনুসরণ করে যাঁরা জঙ্গলকে রোমান্সের স্টুডিও ফ্লোর করে তুলেছেন পরবর্তীকালে, তাঁদের জন্য থাক দুচারটে দীর্ঘশ্বাস।

আমাদের চিরন্তন শিকড় জুড়ে দেয় একটি ত্রিভুজ। ধলভূম-সিংভূম-মানভূম। একে আমি বলি ‘বিভূতি-দেশ’। ইংরেজিতে বিভূতি ল্যান্ড। এর পথে পথে একা একা ঘুরে বেড়িয়েছেন বিভূতিভূষণ। আমাদের ধর্মরাজ। আমরা তাঁর পিছু পিছু এগিয়ে যাই। আমাদের মহাপ্রস্থানের পাকদণ্ডী। নীল সবুজ জোড় লাগা নাগিনির মতো বনপথ ধরে। বিভূতি উস্তাদ আগে আগে নিঃশব্দে গেয়ে যান, ‘ন্যয়ন মোরে তরসে রহে, আজা বালম পরদেশি...’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত