মধ্যযুগীয় বিশ্বের বৃহত্তম ৮ শহরের গল্প

জিনাতুন নুর
প্রকাশ : ২৫ মে ২০২৪, ১৪: ৪৫
আপডেট : ২৬ মে ২০২৪, ০১: ১২

পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ১ হাজার বছর সময়কে মধ্যযুগ ধরা হয়। সেটা ছিল সাংস্কৃতিক বিবর্তন ও ধর্মীয় ক্ষমতা চর্চার সুবর্ণ সময়। বিশ্বজুড়ে তখন জনসংখ্যা বেড়ে চলছে, গড়ে উঠছে নতুন নতুন শহর। ক্রমবর্ধমান এই জনসংখ্যাই সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে শাসকশ্রেণির জন্য উপকারী ক্ষমতার প্রতীক হয়ে ওঠে। সেই সময়ে আটটি উল্লেখযোগ্য শহরের গোড়াপত্তন হয়। আয়তন বা জনসংখ্যার দিক থেকে নেহাত বিশাল না হলেও যুগের হিসাবে শহরগুলো গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই আট শহর নিয়েই আমাদের আজকের গল্প।

১। আঙ্খোর
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ এখনকার কম্বোডিয়ায় মধ্যযুগে খেমার সাম্রাজ্য ছিল প্রভাবশালী। ১১০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে সেই সাম্রাজ্যে আঙ্খোর নামে শহর ছিল। আয়তন ও জনসংখ্যা উভয় দিক থেকেই শহরটি ছিল বিশাল। এটিকে বিশ্বের বৃহত্তম শহর হিসেবে বিবেচনা করা হতো। ১ হাজার বর্গ কিলোমিটারজুড়ে (৩৯০ বর্গমাইল) বিস্তৃত সেই নগরে তখন প্রায় ১০ লাখ মানুষের বসবাস করত। ‘মন্দিরের শহর’ হিসেবে পরিচিত প্রাচীন এই নগরী ১৪০০ খ্রিষ্টাব্দের কাছাকাছি সময় পর্যন্ত পরিত্যক্ত ছিল। কিন্তু এখন বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় পর্যটন এলাকা এবং একই সঙ্গে প্রত্নতাত্ত্বিক নির্দশনস্থলও। তবে দেশটিতে কয়েক শ বছর ধরে চলমাণ সংঘাতের কারণে প্রত্নতাত্ত্বিক উন্নয়নকাজ বাধাগ্রস্ত হয়। এর ফলে এখনো উন্নয়নকাজ চলছে।

বিশাল ওই শহরের অনেক কিছুই কালের আবর্তে হারিয়ে গেছে, কিন্তু আঙ্খোর ওয়াত নামে একটি স্থাপনা টিকে আছে। এটি ছিল খেমার সাম্রাজ্যের রাজধানী। জাতিসংঘ ঘোষিত ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ বা বিশ্বের অন্যতম ঐতিহাসিক স্থান হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ায় এটি সুসংরক্ষিত আছে। 

আঙ্খোর শহর ছিল দেবরাজদের শহর। তাদের হিন্দু দেবতা শিবের পার্থিব অবতার বলে মনে করা হতো। শহরটির জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যালয়, সরকারি হাসপাতালের সংখ্যাও বাড়ে। প্রাচীন এই রাজধানী শহরে ছিল বিমানবন্দরের রানওয়ের মতো প্রশস্ত রাস্তা, খাল ও ধানের খেত; ছিল হাতে কাটা বিশ্বের বৃহত্তম কৃত্রিম জলাশয়; আর ফসলের বাম্পার উৎপাদনের জন্য বর্ষা মৌসুমকে কেন্দ্র করে জটিল সেচব্যবস্থা। 

১৮৮৩ সালে উইলিয়াম মুয়ারের আঁকা ৮ম ও ১০ম শতাব্দীর বাগদাদের মানচিত্র। (Source: Muhammadism.org)২। বাগদাদ
মধ্যযুগের শুরুতে আব্বাসীয় খিলাফত বা সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল আধুনিক ইরাকের বাগদাদ। ৭৬২ খ্রিষ্টাব্দে শহরটির নির্মাণকাজ শুরু হয় এবং অষ্টম শতকের মধ্যে শেষ হয়। সেখানে প্রায় ৫ লাখ মানুষের বাস ছিল। সে সময় শহরটি মধ্যপ্রাচ্যের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ছিল। ৭০০ খ্রিষ্টাব্দ ও ৯০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে প্রায় বাগদাদ বা এর শহরতলিতে ১০ লাখ মানুষ বসবাস করত। ট্রাইগ্রিস নদীর উভয় পাশে দুটি অর্ধবৃত্ত নকশায় বাগদাদের গোড়াপত্তন হয়। আধুনিক অবকাঠমোর সঙ্গে শহরটিতে ছিল কৃত্রিম খাল, পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা, বেশ কিছু নাগরিক চত্বর ও প্রশস্ত রাস্তা। 

শহরটির সোনালি যুগের কয়েক শতাব্দী পর ইয়াকুত নামে এক আরব গবেষক সেখানে বাস করতেন। তাঁর মতে, বাগদাদের রাস্তাগুলো ৪০ হাত বা ৬০ ফুট প্রশস্ত করে তৈরি করা হয়েছিল এবং শহরে প্রাচীরের মধ্যে আবর্জনা ফেলা নিষিদ্ধ ছিল। দশম শতকের পরে আব্বাসীয় শাসনের পতন হয়। কারণ, মধ্যযুগে বাগদাদ শহরে দুটি বড় হামলা হয়। এর মধ্যে ১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দে মোঙ্গলরা এবং ১৪০১ খ্রিষ্টাব্দে তাদেরই উত্তরসূরি তাইমুরের আক্রমণের শিকার হয়। আব্বাসীয়দের পতন হলেও বাগদাদ শহর গুরুত্ব হারায়নি। এটি এখনো আধুনিক ইরাকের রাজধানী এবং আরব বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। 

দশম শতাব্দী শেষে কন্সটান্টিনোপল, এন্তোইন হেলবার্টের আঁকা ছবি। (Source: Vivid Maps)৩। কনস্টান্টিনোপল
বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের বৃহৎ কেন্দ্রভূমি ছিল কনস্টান্টিনোপল। রোমান সম্রাট কনস্টান্টিনের আমলে ৩৩০ খ্রিষ্টাব্দে, অর্থাৎ প্রাচীন যুগে এই শহরের গোড়াপত্তন হয়। কিন্তু মধ্যযুগও কনস্টান্টিনোপল শহরের জন্য স্বর্ণযুগ ছিল বলা যায়। পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর বিশ্বের মনোযোগের কেন্দ্রে চলে আসে পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য। তখনো কনস্টান্টিনোপল থেকেই রোম শাসন করতেন সম্রাট জাস্টিনিয়ান। 

রোমান থেকে বাইজেন্টাইন, বাইজেন্টাইন থেকে অটোমান সাম্রাজ্য এবং রোমান সাম্রাজ্যে প্রত্যাবর্তনের এই বড় সময়ের পালাবদলের জোয়ারের মধ্যেও নিজ অবয়বে বহাল ছিল কনস্টান্টিনোপল। ইতিহাসের নানা সময়ে এই শহরে প্রায় কোটি মানুষের বাস ছিল এবং এটিই ছিল প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র। ইউরোপ ও এশিয়া—দুই মহাদেশজুড়ে থাকা শহর হিসেবে অনন্য অবস্থানের কারণে আন্তর্জাতিক বিষয় ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কনস্টান্টিনোপল মুখ্য ভূমিকা রাখে। 

ভেনিস, মধ্যপ্রাচ্য ও দূরপ্রাচ্যের ব্যবসায়ী ও বণিকেরা এই শহরে আসত। এর ফলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে শহরটি ব্যাপক পরিচিত পায়। কনস্টান্টিনোপল অবিরত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে এবং যুদ্ধ ও অবরোধের কারণে নিশ্চিহ্ন হওয়ার ঝুঁকিতে ছিল। তার পরও মধ্যযুগীয় বড় শহর হিসেবে শহরটি টিকে ছিল। শুধু তাই নয়, ১৪৫৩ খ্রিষ্টাব্দে এটি অটোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী হয়ে ওঠে। পুরো মধ্যযুগে এবং আধুনিক যুগেও কনস্টান্টিনোপলের প্রভাবশালী ভূমিকা অব্যাহত ছিল। কনস্টান্টিনোপলের নাম পাল্টেছে, এটির নাম এখন ইস্তানবুল। তুরস্কের বড় শহর হিসেবে এটি ইউরোপ ও এশিয়া—দুই মহাদেশের আন্তর্জাতিক বিষয়েই জোরালো প্রভাব রাখে। 

১২তম শতাব্দীতে নির্মিত কাহিরা সিটাডেল। (Source: medievalists.net)৪। কায়রো
বাগদাদের বিপরীতে ইসলামি বিশ্বের বৃহত্তম শহর হিসেবে ৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে মিসরে কায়রো শহর নির্মাণ করে ফাতেমীয় রাজবংশ। এই শহর যেমন ফাতেমীয় সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল, তেমনি গোটা মধ্যযুগে ইসলামী শিক্ষা ও ক্ষমতার উৎসও ছিল এটি। কায়রো ‘হাজার মিনারের শহর’ হিসেবে পরিচিত। এটি বাস্তবিকই ইসলামি শহর। শহরজুড়ে হাজারের বেশি মসজিদ আছে বলে কেউ কেউ দাবি করেন এবং সংখ্যাটি অতিরঞ্জিত নয়। মধ্যযুগের কায়রোতে এসব মসজিদ ইবাদতের জায়গার পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও প্রশাসনকেন্দ্র হিসেবেও কাজ করত। আল-হাসান মসজিদ ছিল এই শহরের প্রথম শিক্ষাকেন্দ্র। সেখানে ধনী কিংবা গরিব হাজার হাজার মিসরীয় ও বিদেশি তরুণ শিক্ষা নিত। 

মামলূক রাজবংশ শহরটি দখলে নিলে মসজিদগুলো হাসপাতাল ও কমিউনিটি সেন্টার হিসেবেও ব্যবহৃত হতো। দাসত্ব থেকে লড়াই করে ক্ষমতা অর্জন করায় মামলুক শাসকেরা শহরের প্রান্তিক মানুষের প্রতি যত্নশীল ছিল। তাঁরা শহরটিকে ক্রুসেডের বিরুদ্ধে শক্তিশালী ইসলামি দুর্গ হিসেবে গড়ে তোলে। ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়ার বাণিজ্যপথের সঙ্গমস্থলে থাকায় শহরটি মধ্যযুগের অন্যতম প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল। অবস্থানগত কারণে কায়রো বিশ্বের অন্যতম ধনী মধ্যযুগীয় শহরে পরিণত হয়। 

কায়রো এখনো মিসরের রাজধানী এবং একই সঙ্গে আরব বিশ্বের বৃহত্তম শহর। আধুনিককালের কিছু দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ঘটনার মধ্যেও এটি উত্তর আফ্রিকার ইসলামি শক্তির বড় কেন্দ্র। 

হ্যাংঝুতে নির্মিত দশম শতাব্দীর লেইফেঙ প্যাগোডা। (Source: Hangzhou Tours)৫। হ্যাংঝু
চীনের সাতটি প্রাচীন রাজধানীর মধ্যে হ্যাংঝু উল্লেখযোগ্য। সম্ভবত দ্বাদশ শতাব্দীতে বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম শহরও এটি। গ্র্যান্ড ক্যানালের শেষ প্রান্তে অবস্থিত ১০ লাখ মানুষের শহরটি একাধিক চীনা রাজবংশের রাজধানী ছিল। 

অবস্থানগত কারণে হ্যাংঝু সমৃদ্ধি পায়। কারণ সিল্করোড নামে চীনের সঙ্গে বিশ্ব বাণিজ্য পথের সঙ্গে এর সরাসরি সংযোগ ছিল। এটি বাণিজ্য নগরী হিসেবে বিকাশ লাভ করেছিল। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনে সুদূর ইরানেও মধ্যযুগে চীনা পণ্যের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এটি ইউয়ে রাজ্য এবং দক্ষিণ সং রাজবংশের রাজধানী ছিল। এমনকি যখন এটি রাজধানী শহর ছিল না, তখনো কৌশলগত অবস্থানের কারণে হ্যাংঝু শক্তিশালী শহর ছিল। 

ধনসম্পদের জন্য হ্যাংঝু সুপরিচিত ছিল। চীনা সংস্কৃতির মহান কেন্দ্রও ছিল এটি। প্রাচীন সাহিত্য ও বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত এই শহর। এর সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব মার্কো পলো ও ইবনে বতুতার মতো পর্যটকককে আকৃষ্ট করেছিল। তাদের লেখায় শহরটির চমৎকার বর্ণনা উঠে এসেছে। মার্কো পলোর মতে, এটি নিঃসন্দেহে ‘বিশ্বের সেরা ও সবচেয়ে জমকালো শহর’। এই শহরের পাকা রাস্তা ও বিপুলসংখ্যক সেতু দেখে তিনি বিস্মিত হন। মার্কো পলোর লেখাগুলো ত্রয়োদশ শতাব্দীর হ্যাংঝুর জাঁকজমক অবস্থা তুলে ধরে। তখনো এটি বিশ্বের বৃহত্তম শহর ছিল। হ্যাংঝু এখনো গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক কেন্দ্র। সেখানে প্রচুর পরিমাণে ধান ও রেশম উৎপাদন হয়। এখন রাজধানী না হলেও এটি অন্তত ১ কোটি মানুষের আধুনিক নগর। 

জ্যঁ ফুকের আঁকা দেবতার হাত। (Source: Metropolitan Museum of Art, New York)৬। প্যারিস
ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস। মধ্যযুগের শুরুতে বিশাল বহুজাতিক শহরে বিকশিত হয় এটি। এর আগে এই শহরের তেমন গুরুত্ব ছিল না। দশম শতকের প্যারিসে একটি ক্যাথেড্র্যাল ছাড়া আর কিছু ছিল না। তবু প্রাদেশিক শহরের চেয়ে একটু বেশিই মর্যাদা পেত এই শহর। কিন্তু ক্যাপেশীয় রাজারা ইল দু লা সিতে থেকে ফ্রান্স শাসনের সিদ্ধান্ত নিলে অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। এটাকে যে তারা শুধু রাজপ্রাসাদে পরিণত করেছে, তাই নয়। এখানে নতুন নটর ডেম ক্যাথেড্রালকেও জায়গা দেওয়া হয়। ক্যাপেশীয়দের অধীনে প্যারিস একাধারে ধর্মীয়, শিক্ষা ও বাণিজ্য—তিন দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। শিন নদীর বাম তীর ছিল ফরাসি গির্জা মঠের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ছিল বেশ কিছু কলেজ, যেগুলো ইউরোপের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। ডান তীরে বন্দর, বণিকশ্রেণি ও বাজার প্যারিসকে বাণিজ্যকেন্দ্রে পরিণত করে। ধর্ম ও শিক্ষার সঙ্গে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি প্যারিসকে স্বর্ণ ও রৌপ্যখচিত পান্ডুলিপির গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলে। পাশাপাশি এই শহরে প্রথম গথিক নির্মাণশৈলীর প্রচলন হয়। 

১৩২৮ খ্রিষ্টাব্দের আগে প্যারিসের বাসিন্দা কত ছিল, তা নির্দিষ্ট ছিল না। কিন্তু সে বছরের আদমশুমারিতে শুধু শহরের ভেতরে ৬১ হাজার পরিবার পাওয়া যায়। তা থেকে সে সময় পুরো প্যারিসের জনসংখ্যা ২ লাখ ১০ হাজার থেকে ২ লাখ ৭০ হাজারের মধ্যে ছিল বলে অনুমান করা যায়। শহরটি মহামারি ও বহিঃশক্তির অবরোধের কবলে পড়ে কিছুটা বিপর্যস্ত হলে নিজেকে সামলে নিয়ে মধ্যযুগে পশ্চিমা বিশ্বের অনত্যম জনবহুল শহরে পরিণত হয়। 

১৫২৪ সালে নুরেমবার্গে প্রকাশিত তেনোচতিতলানের মানচিত্র। (Source: Dumbarton Oaks)৭। তেনোচতিতলান
এখনকার মেক্সিকোতে অবস্থিত তেনোচতিতলান প্রাক-কলম্বিয়ান আমেরিকায়, অর্থাৎ ক্রিস্টোফার কলম্বাসের অভিযানের মাধ্যমে ইউরোপের উপনিবেশ হওয়ার আগে পর্যন্ত আমেরিকার বৃহত্তম শহর ছিল। পঞ্চদশ শতক পর্যন্ত এক শতাব্দীজুড়ে এটি ছিল বিস্তৃত আজটেক সাম্রাজ্যের রাজধানী। টেক্সকোকো দ্বীপের মাঝখানে তেনোচতিতলান শহর গড়ে তোলা হয়। সেখানে ছিল রাজকীয় প্রাসাদ, মন্দির, বাজার ও অন্যান্য সরকারি ভবন। এ সবই আজটেক জনগোষ্ঠীর কল্যাণের পাশাপাশি শহর ও সাম্রাজ্যের সমৃদ্ধিতে অবদান রাখে। 

অ্যাজটেক সম্রাজ্যের বিশাল বাণিজ্য নেটওয়ার্ক ছিল, যা তেনোচতিতলান থেকে ম্যাক্সিকো উপসাগর এবং সম্ভবত ইনকা সাম্রাজ্য পযন্ত বিস্তৃত ছিল। এই শহরের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ২ লাখের কাছাকাছি। সেই জনগোষ্ঠী এমন সামাজিক শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল, যা মেসোআমেরিকান বিশ্বে সবচেয়ে জটিল। 
স্পেনীয় বিজেতারা এই রাজধানী শহরে পৌঁছে একে সমৃদ্ধশালী হিসেবেই খুঁজে পায়। জনসংখ্যার দিক থেকে ইউরোপের ভেনিস কিংবা প্যারিসের সমকক্ষ ছিল। সম্রাট দ্বিতীয় মক্তেজুমার রাজপ্রাসাদ ছিল বিস্তৃত ভবন, যেখানে চিড়িয়াখানা, বোটানক্যিল গার্ডেন ও অ্যাকুরিয়াম ছিল। হেরনান কর্তেসের নেতৃত্বে স্পেনীয়রা শহরটিকে দখল করে নয়া স্পেনের রাজপ্রতিনিধির পৌরসভায় পরিণত করে। কয়েক শতাব্দী ধরে শহরটি স্পেনীয় শাসনের অধীনে থাকলেও মেক্সিকোর রাজধানী স্থানান্তরিত হয়নি; মধ্যযুগীয় রাজধানীটির আশপাশেই তা গড়ে ওঠে। আধুনিক ম্যাক্সিকো শহরের ঐতিহাসিক কেন্দ্রে তেনোচতিতলানের অবস্থান। প্রায় ১ কোটি মানুষের শহরটি আমেরিকার মধ্যে অন্যতম জনবহুল। 

১৪৯৪ সালে ভিট্টোরি কার্পাচ্চিওর আঁকা দ্য মিরাকল অব দ্য রেলিক অব দ্য ট্রু ক্রস অন রিয়াল্টো ব্রিজ। (Source: British Library)৮। ভেনিস
মধ্যযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ নৌশক্তিধর হিসেবে বিবেচিত ভেনিস। পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর পালিয়ে আসা শরণার্থীদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে এই শহরের যাত্রা শুরু হয়। চারপাশ ঘিরে থাকা লেগুন বা উপহ্রদ কৌশলগতভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি ভেনিসকে প্রজাতন্ত্রে পরিণত করতে সহায়তা করেছে। এই লেগুন ভূমধ্যসাগরের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ায় ইউরোপের বাকি অংশের সঙ্গে রোমানদের বৃহত্তর বাণিজ্য সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। 

রোমান সাম্রাজ্য ও অপর ইতালীয় শক্তি থেকে উচ্চমাত্রার স্বাধীনতা পেয়েছিল ভেনিস—সেটা ধর্ম ও শাসনব্যবস্থা উভয় দিক থেকেই ছিল। এমন প্রেক্ষাপটে পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল দখল করা শুরু করে এই নগররাষ্ট্র। ভেনিসের শাসক ছিলেন একজন ডিউক। তিনি ভেনিসের গ্রেট কাউন্সিল দ্বারা নির্বাচিত হতেন এবং আজীবন দায়িত্ব পালন করতেন। ভেনিস নামে প্রজাতন্ত্র হলেও এটি শাসন করত বড় ব্যবসায়ীদের গোষ্ঠী। 

ক্রমাগত সমৃদ্ধ হতে হতে মধ্যযুগে শিল্প, স্থাপত্য ও প্রকাশনার বড় কেন্দ্রে পরিণত হয় ভেনিস। ইতালি রেনেসাঁ বা পুনর্জাগরণের আগে ভেনিসে রেনেসাঁ শুরু হয়। অর্থনৈতিক দক্ষতা এবং নৌ প্রজাতন্ত্রের সেবায় শিল্পের উন্নয়নের প্রত্যক্ষ পরণতি ছিল এই রেনেসাঁ। ষোড়শ শতকের আগপর্যন্ত ভেনিস ছিল কিছুটা অপ্রতিদ্বন্দ্বী। এরপর আমেরিকা ও ইস্ট ইন্ডিজে বাণিজ্যপথ চালু হলে তার প্রভাব কমে। কারণ, তখন অন্যান্য ইউরোপীয় শক্তিও বাণিজ্য বাড়িয়ে ভেনিসের সমকক্ষ প্রভাব অর্জন করে। 

উনিশ শতকের শেষের দিকে একক ইতালি রাষ্ট্রে অন্তর্ভুক্ত হয় ভেনিস। এটি এখন ইতালির বড় সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। তবে আগের মতো প্রভাব আর নেই। চারপাশের খালের কারণে ভেনিস ছিল অনন্য এবং সম্পূর্ণরূপে নৌশক্তিনির্ভর। বিশাল নৌবহরের পরিবর্তে সেই খালগুলোতে এখন পর্যটকদের পছন্দের গন্ডোলা রাইড ও ওয়াটার ট্যাক্সি চলে।  

(দ্য কালেক্টর থেকে অনূদিত)

লেখক: ইতিহাসে স্নাতকোত্তর, ইডেন কলেজ

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

টাঙ্গাইলে দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান র‍্যাবের হাতে গ্রেপ্তার

পুলিশ ফাঁড়ি দখল করে অফিস বানিয়েছেন সন্ত্রাসী নুরু

ঢাকার রাস্তায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালকদের বিক্ষোভ, জনদুর্ভোগ চরমে

শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ সুরক্ষায় নতুন উদ্যোগ

জাতিকে ফ্রি, ফেয়ার অ্যান্ড ক্রেডিবল নির্বাচন উপহার দিতে চাই: নতুন সিইসি

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত