পণ্য পরিবহন: নৌপথে ‘পথের কাঁটা’ চাঁদাবাজি-অনিরাপত্তা

  • মোংলা থেকে পাবনায় এক বছরে ৩০টির বেশি ডাকাতি
  • চাঁদা না দিলে শ্রমিকদের ওপর হামলা
  • জাহাজমালিকেরা বলছেন, প্রতিকার চেয়েও লাভ হয় না
আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
প্রকাশ : ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১: ২৯
ছবি: সংগৃহীত

দেশের অভ্যন্তরে দূরদূরান্তে সড়ক পথের চেয়ে নৌপথে পণ্য পরিবহনে খরচ কম। এ জন্য অনেক ব্যবসায়ী নৌপথে পণ্য পরিবহন করে থাকেন। তবে এ পথে ‘পথের কাঁটা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে চাঁদাবাজি, অনিরাপত্তা। ঠিকঠাক চাঁদা না পেলে নৌশ্রমিকদের ওপর হামলার ঘটনাও ঘটে। এমন ঘটনার মধ্য দিয়ে সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম-মোংলা, নৌবন্দর বরিশাল থেকে করা হয় পণ্য পরিবহন। আর এসব রুটে অনিরাপত্তার তথ্য নেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে।

চাঁদপুরের হাইমচর উপজেলার মেঘনা নদীর ইশানবালা খালের মুখে এমভি আল-বাখেরা জাহাজে সাত খুনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে নৌপথের নিরাপত্তার বিষয়টি সামনে এসেছে। এরপর খোঁজ নিয়ে জানা যাচ্ছে, দেশের দ্বিতীয় সমুদ্র বন্দর মোংলা থেকে পাবনার বাঘাবাড়ী পর্যন্ত নৌপথে জলদস্যুদের উৎপাত, বিভিন্ন ঘাটে চাঁদাবাজি ও ডাকাতি বেড়েছে।

এক বছরে ৩০ ডাকাতি

মোংলার লাইটারেজ শ্রমিক ইউনিয়ন সূত্রে জানা যায়, মোংলা বন্দর থেকে পাবনার বাঘাবাড়ী পর্যন্ত নৌপথের দূরত্ব প্রায় ৪০০ নটিক্যাল মাইল। এ পথে মল্লিকপুর, মাঝের চর, কাচিকাটার মুখ, হরিণা ফেরিঘাটের নিচ, শুরের সর ও মাওয়া এলাকায় জাহাজ পড়ে চাঁদাবাজ ও ডাকাতের কবলে। এই দুর্বৃত্তরা লাইটার জাহাজে চাঁদা দাবি করে। চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে নৌশ্রমিকদের ওপর অস্ত্রসহ আক্রমণ করে। বন্দর সূত্র বলছে, গত এক বছরে এ নৌপথে ৩০টির বেশি ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। এই নৌপথে কোস্ট গার্ডের টহল নেই। বেশ কয়েকটি নৌ পুলিশ ফাঁড়ি থাকলেও তাঁদের তৎপরতা একেবারে নেই বললেই চলে।

লাইটারেজ শ্রমিক ইউনিয়নের মোংলা শাখার সহসভাপতি মাইনুল হোসেন মিন্টু ও যুগ্ম সম্পাদক বাবু হাওলাদার বলেন, এসব ঘটনায় নৌ পুলিশ, কোস্ট গার্ডসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানানোর পরও কোনো প্রতিকার যাওয়া যায় না।

তবে মোংলা কোস্ট গার্ড পশ্চিম জোনের মিডিয়া কর্মকর্তা লে. মুশফিক আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা সুনির্দিষ্টভাবে কোনো অপরাধের সংবাদ পেলেই সেখানে অভিযান চালাই। তারপরও আমাদের কাছে কোনো অভিযোগ এলে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’

চাঁদপুরে সাত খুনের ঘটনার পর শ্রমিকেরা যেসব দাবি উত্থাপন করেছেন, সেগুলোর মধ্যে জোর দেওয়া হচ্ছে নৌপথে নিরাপত্তায়। নৌপথে সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি-ডাকাতি বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন তাঁরা। চট্টগ্রাম বন্দর, জাহাজমালিকসহ সংশ্লিষ্টদের দেওয়া তথ্যমতে, নদী ও সাগরের উপকূলবর্তী এলাকায় নিরাপত্তার মূল দায়িত্ব পালন করে নৌ থানা-পুলিশ। সাগরে নিরাপত্তা ও সীমান্ত সুরক্ষিত রাখার কাজটি করে থাকেন কোস্ট গার্ড ও নৌবাহিনীর সদস্য। তবে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালনকালে সবগুলো বাহিনীর মধ্যে পারস্পরিক সংযোগ থাকে। বাংলাদেশে নৌপথের অধিকাংশ নদীপথ হওয়ায় মূল দায়িত্ব পালনের বিষয়টি নৌ থানা-পুলিশের ওপর বর্তায় বেশি। তবে এই নৌ থানা-পুলিশের পর্যাপ্ত সক্ষমতা নেই।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম নগরীর সদরঘাট নৌ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. একরামউল্লাহ জানান, ‘কর্ণফুলী ও হালদা নদী এবং কাপ্তাই পর্যন্ত আমাদের দায়িত্ব পালনের অধিক্ষেত্র। এ সীমানার মধ্যে তেমন কোনো ঘটনা নেই। জাহাজের মালিক-শ্রমিকের মধ্যে কোনো ধরনের দ্বন্দ্ব দেখা দিলে আমরা আইনগতভাবে দ্রুত হস্তক্ষেপ করি, যাতে ঘটনা বড় হয়ে না যায়।’

তথ্য নেই নৌ পুলিশের কাছে

বরিশাল-ঢাকা নৌপথের বিভিন্ন স্পটে পণ্যবাহী জাহাজে চাঁদাবাজি, দুর্বৃত্তায়ন হলেও পুলিশের কাছে এ ধরনের কোনো তথ্য নেই। যদিও পণ্যবাহী মালিক-শ্রমিকেরা এ রুটে জেলে বেশে চাঁদাবাজির অভিযোগ করে আসছেন। তাঁরা জানিয়েছেন, ঢাকা-বরিশাল রুটের অন্তত ৫টি স্পট উত্তাল মেঘনাঘেরা হওয়ায় দুর্বৃত্তদের হানার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।

বাংলাদেশ কার্গো ট্রলার বলগেট শ্রমিক ইউনিয়নের বরিশাল বিভাগের সভাপতি দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘বরিশালের উলানিয়া, ধূলিয়া, চরমোনাইর চারেরগাছ, পাতারহাটের এপারে, ভোলার হাকিম উদ্দিন এলাকা ডাকাতির ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ। এ সব এলাকা ডাকাতপ্রবণ এবং চাঁদাবাজি চলছে। এ বিষয়ে নৌ পুলিশকে লিখিত অভিযোগও দিয়েছি।’

যদিও হিজলা এবং মেহেন্দীগঞ্জ-সংলগ্ন কালীগঞ্জ নৌ পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এনামুল হক বলেন, তাঁদের কাছে ডাকাতি কিংবা চাঁদাবাজির কোনো অভিযোগ আসেনি।

আর বরিশাল নৌ পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সনাতন চন্দ্র সরকার বলেন, তাঁরা শুনেছেন জেলে বেশে একশ্রেণির দুর্বৃত্ত নদীতে টাকাপয়সা চায়। কিন্তু সেসব ঘটনাকে চাঁদাবাজি কিংবা ডাকাতি বলে মনে হয় না। গত ৩ মাসে সদর থানায় এ ধরনের কোনো অভিযোগ দেয়নি।

চাঁদাবাজির এমন খবর পাওয়া গেল পাবনার নগরবাড়ী নৌবন্দরে। গতকাল দুপুরে নগরবাড়ী ঘাটে গিয়ে কয়েকজন শ্রমিক ও ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মালবাহী ট্রলার বা কার্গো থেকে শ্যালো নৌকার মাধ্যমে চাঁদা নেওয়া হয়। চাঁদা না দিলে হয়রানির শিকার হতে হয়। তাঁরা জানান, ভুক্তভোগীরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে অভিযোগ করেন না। কারণ অভিযোগ করলে ঝামেলা আরও বাড়ে।

[প্রতিবেদনে তথ্য দিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম ও বরিশাল; মোংলা (বাগেরহাট) প্রতিনিধি, পাবনা ও সাঁথিয়া প্রতিনিধি]

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত