জাহীদ রেজা নূর
একুশে আগস্ট এলেই হিম হয়ে আসে সব ভাবনা। একুশে আগস্ট ছিল পনেরো আগস্টের ধারাবাহিকতা—এ কথা ভাবলেই বোঝা যায়, কতটা সংগঠিত আকারে পরিচালিত হয়েছিল এই হামলা। ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তৎকালীন বিএনপি সরকারের কতিপয় সদস্য।
ষড়যন্ত্রকারীদের ভাষ্যমতেই এই নৃশংসতার মাস্টারমাইন্ড হিসেবে পরিচিত হয়েছিলেন তারেক রহমান। ঘাতকদের গ্রেনেড ও গুলিতে সেদিনের ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের ২৪ জন নেতা-কর্মী, আহত হয়েছিলেন অসংখ্য মানুষ। সেই বর্বরতার স্মৃতি এখনো শরীরে বহন করে চলেছেন সেই আহত মানুষদের অনেকে।
২০০৪ সালের একুশে আগস্টের সঙ্গে ১৯৭৫ সালের পনেরো আগস্টের মিল-অমিল দুই-ই আছে। তবে দুই নৃশংসতার টার্গেট হলো মুজিব পরিবার, এ ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই। ঘাতকেরা ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে নির্বংশ করতে পারেনি শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা দেশে ছিলেন না বলে। নির্বাসনের দুঃসহ সময় পার করে শেখ হাসিনা দেশে ফিরে জাতীয় রাজনীতিতে যুক্ত হলেন এবং অসংগঠিত আওয়ামী লীগের হাল ধরলেন। তিনি দেশে ফিরেছিলেন ১৯৮১ সালের ১৭ মে।
এর আগে একই বছরের ১৪ থেকে ১৬ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের যে জাতীয় সম্মেলন হয়েছিল, সেই সম্মেলনেই শেখ হাসিনাকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়েছিল।
১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত সময়টি নানা কারণেই তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর নভেম্বর মাসে বাংলাদেশের প্রথম সরকারের তিন মন্ত্রী ও উপরাষ্ট্রপতিকে হত্যা করেছিলেন ওই সরকারেরই আরেক সদস্য খন্দকার মোশতাক আহমদ। খুনি মেজররা যখন বঙ্গবন্ধুকে সরিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্রের কথা সেনাবাহিনীর কোনো কোনো বড় কর্মকর্তাকে জানিয়েছিলেন, তখন তাঁরা এই বিপথগামী সৈনিকদের কোর্ট মার্শালের সম্মুখীন করেননি, ষড়যন্ত্রের কথা জায়গামতো জানাননি; বরং তাঁদেরই কেউ কেউ বলেছিলেন, এই ষড়যন্ত্রে যুক্ত থাকবেন না বটে, কিন্তু বাধাও দেবেন না।
এই তালিকায় সবচেয়ে বড় নামটিই হলো জিয়াউর রহমানের। এরপর মোশতাকের সরকার, জিয়ার সামরিক শাসন, হাস্যকর গণভোট, উগ্র ডান-উগ্র বাম, পাকিস্তানি দালালদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের ককটেল করে দল তৈরি করাসহ কত ঘটনাই না আছে। প্রশাসনে তখন পাকিস্তানপন্থীরা বীরদর্পে অবস্থান করছেন।
আওয়ামী লীগ তখনো অসংগঠিত এবং অস্বীকার করা যাবে না, ১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনের পর দেশ যখন পাকিস্তানমুখী উল্টো যাত্রা শুরু করেছিল, তখনো আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের একটি অংশ যোগ দিয়েছিল মোশতাক-সরকারে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সংগঠিতভাবে প্রতিবাদ না হয়ে বিচ্ছিন্নভাবে খুব অল্প প্রতিবাদ হওয়ার এটাও ছিল একটা বড় কারণ। বঙ্গবন্ধু নেই, কিন্তু মন্ত্রিসভায় বঙ্গবন্ধুর বিশ্বাসভাজনেরাই তো যোগ দিয়েছেন—এতে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয়েছে।
জিয়াউর রহমানের শাসনামলে যে বিশের অধিক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছিল, তাতেই বোঝা যায় কেমন অস্থিরতা চলছিল সেনানিবাসে। অভ্যুত্থান সংঘটিত করার অপরাধে মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের ক্যাঙারু কোর্টে বিচার করা হয়েছে এবং হত্যা করা হয়েছে।
এ রকমই এক রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে শেখ হাসিনা স্বদেশে ফিরেছিলেন। সে মাসেই রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান হত্যার শিকার হয়েছিলেন চট্টগ্রামে। নাটকীয়ভাবে জেনারেল মঞ্জুরকে হত্যা করা হয়েছিল জিয়ার খুনি হিসেবে, কিন্তু দেখা গেল কোনো এক জাদুর স্পর্শে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের হাতে এসে গেল ক্ষমতা।
রাজনীতিতে ক্রমেই শেখ হাসিনা হয়ে উঠছিলেন শক্তিশালী। সম্মিলিত আন্দোলনে এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে বিএনপি এসেছিল ক্ষমতায়। এরপর ১৯৯৬ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে এক মেয়াদে সরকার পরিচালনা করার পর যখন শেখ হাসিনা বিরোধীদলীয় প্রধান, তখনই ঘটেছিল একুশে আগস্টের বোমা হামলা।
পাঠক খেয়াল করে দেখবেন, পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ডের সময় একদল বিপথগামী সৈনিকের অভ্যুত্থানের কথা বলে বড় বড় সামরিক কর্তাব্যক্তিরা কিন্তু তাঁদের দায়ের কথা বেমালুম এড়িয়ে গিয়েছিলেন। রাজনীতিকদের মধ্যে যাঁরা ছিলেন বিভিন্ন বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত, তাঁরাও বঙ্গবন্ধুকে বাঁচাতে কোনো পদক্ষেপ নেননি। বঙ্গবন্ধুকে হটানোর পরিকল্পনা করা হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু এরপর কী করতে হবে, কারা
দেশ চালাবে, এত কিছু মনে হয় পরিকল্পনায় ছিল না।
তাই মোশতাক সরকারের গঠন-প্রক্রিয়াতেই দেখা গিয়েছিল অস্থিরতা। কাউকে অস্ত্রের মুখে টেনে আনা হয়েছে, কেউ স্বেচ্ছায় এসেছেন মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে। সেনাবাহিনীতে অস্থিরতা চলছিল।
একুশে আগস্টে এসে দেখা গেল, পনোরো আগস্টের চেয়ে অনেক বেশি সংগঠিত এ ষড়যন্ত্র। এ হামলা শুধু পূর্বপরিকল্পিতই নয়, কোন প্রশ্নের কোন উত্তর দেওয়া হবে, তাও যেন আগে থেকে ঠিক করা ছিল। সরকারিভাবে কত রকম বয়ান যে এনে হাজির করা হয়েছিল, তার শেষ নেই; অর্থাৎ যারা এই ঘটনার মাস্টারমাইন্ড, তারা যেন লোকচক্ষুর আড়ালে থাকে, তার সব ব্যবস্থাই করে রেখেছিল ষড়যন্ত্রকারীরা।
এখানে বলে রাখা দরকার, গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশক থেকেই আমাদের দেশে জঙ্গি হামলা শুরু হয়েছিল। ১৯৯৯ সালে যশোরে উদীচীর সম্মেলনে হামলার মাধ্যমে এই নৃশংসতার সূচনা, এর আগে-পরে আরও বহু হামলার মধ্য থেকে শুধু দুটো হামলার কথা উল্লেখ করব আমার পরবর্তী ভাষ্যকে প্রমাণ করার জন্য। ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল ঢাকায় ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলা হয়। ২০০৫ সালের ৮ ডিসেম্বর নেত্রকোনার উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর জেলা সংসদ কার্যালয়ে বোমা হামলা হয়। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, এই হামলাগুলোর উদ্দেশ্য ছিল কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে আঘাত করা, জঙ্গিরা কাদের শত্রু বলে মনে করে, তা প্রকাশ করা; অর্থাৎ যারা বাঙালি সংস্কৃতিকে লালন করে, তাদের নিশ্চিহ্ন করাই ছিল হামলার লক্ষ্য।
কিন্তু একুশে আগস্ট বোমা হামলা কোনোভাবেই সে রকম একটা ঘটনা ছিল না। এই হামলার স্পষ্ট উদ্দেশ্য ছিল আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করা।
আওয়ামী লীগের জনসভায় বোমা হামলার সময় বিএনপি রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল বলেই এই হামলার সঙ্গে বিএনপি যুক্ত ছিল, ঢালাওভাবে এ রকম কথা বলছি না। অন্য হামলাগুলোর সঙ্গে কেউ বিএনপির নাম জড়ায়নি। সেগুলো যে ভ্রষ্ট উগ্র ধর্ম-ব্যবসায়ীদের কাজ (যদিও তাদের ব্যাপারে সরকারের শিথিলতার অভিযোগ আছে, ‘বাংলা ভাই বলে কেউ নেই, এসব মিডিয়ার সৃষ্টি’ এ রকম কথা শোনা গেছে সরকারের মন্ত্রীদের মুখ থেকে।), সেটা সবাই জানে।
তাতে বিএনপির দিকে সন্দেহের তির যায়নি। কিন্তু আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলার ব্যাপারটির প্যাটার্ন অন্য সব জঙ্গি হামলার সঙ্গে এক নয়। ধুরন্ধর ষড়যন্ত্রকারীরা সে রকম একটি বাতাবরণের সৃষ্টি করেছিল বটে, কিন্তু তাতে শেষ রক্ষা হয়নি। পনেরো আগস্ট আর একুশে আগস্টের মধ্যে অমিলের এটাও একটা প্রমাণ। পনেরো আগস্টের খুনিরা সগর্বে নিজেদের খুনি ঘোষণা করে বক্তব্য দিয়েছিল, একুশে আগস্টের খুনিরা অপরাধ তো স্বীকার করেইনি; বরং নিজেরাই ঠিক করে দিয়েছিল, কাদের সন্দেহ করতে হবে।
পনেরো আগস্টের খুনিরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর তাদের বাড়িতে লুটপাট চালিয়েছিল। তার চিহ্ন রেখে গিয়েছিল সর্বত্র। একুশে আগস্টের খুনিরা কোনো রকম আলামত যেন না থাকে, তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছিল। একুশে আগস্ট যখন আহতরা কাতরাচ্ছিল, তখন পুলিশ নির্বিকার দাঁড়িয়ে ছিল। এরপর পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়েছিল।
কেন ছুড়েছিল? হামলাকারীদের পালানোর পথ তৈরি করে দেওয়া ছাড়া এর আর কোনো ব্যাখ্যা থাকতে পারে না। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ থেকে গ্রেনেড হামলার আলামতও সরিয়ে ফেলা হয়েছিল।
সে সময় বিএনপির পক্ষ থেকে কী বলা হয়েছিল, সেটাও মনে রাখা দরকার। বিএনপি বলেছিল, এটা আওয়ামী লীগের কাজ। জনগণের সহানুভূতি লাভের জন্য নাকি আওয়ামী লীগ নিজেই নিজের ওপর হামলা চালিয়েছে।
কতটা পাষণ্ড হলে এ রকম মন্তব্য করা যায়! হ্যাঁ, মুফতি হান্নান এই হামলার মূল পরিকল্পনাকারী যদি হয়েও থাকেন, তবুও প্রশ্ন আসে, তিনি মদদ পেয়েছিলেন কোথা থেকে? সে সময় বিএনপির নেতা আবদুল্লাহ আল নোমান বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ বোমা মেরে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চায়।’ মির্জা আব্বাস বলেছিলেন, ‘শেখ হাসিনা তাঁর দলের কর্মীদের হত্যা করে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন।’
বিএনপির নেতাদের এই হলো সততার নমুনা। নামকাওয়াস্তে বিচারপতি জয়নুল আবেদিনের নেতৃত্বে যে বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠন করা হয়েছিল, সেই কমিশন বেমালুম বলে দিয়েছিল এই হামলার পেছনে জঙ্গিগোষ্ঠী নেই। সীমান্তের ওপারের শক্তিশালী দেশটিই নাকি এ হত্যাযজ্ঞের হোতা।
সবচেয়ে বড় ম্যাসাকারের জন্ম দেওয়া হলো জজ মিয়া নাটকটি তৈরি করে। তাকে গ্রেনেড হামলার রাজসাক্ষী করার কথাও ভাবা হলো। কিন্তু এই সবকিছুর পেছনে জজ মিয়ার পরিবারকে মাসিক অর্থ দেওয়ার কথা যখন ফাঁস হয়ে গেল, তখন আর এই গল্প নিয়ে তারা বেশি দূর এগিয়ে যেতে পারেনি।
এ পর্যন্ত জঙ্গি হামলাকারীদের কথাই বলা হলো। তারাই কি সব সিদ্ধান্ত নিয়েছিল? না। পরবর্তীকালে তদন্তে উঠে এল বিএনপি সরকারের প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রীরাও এই তৎপরতার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন এই ষড়যন্ত্রের রূপকারদের একজন। আর তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর কী করেছিলেন? তিনি অপরাধীদের বিদেশে পার করে দিয়েছিলেন।
এরপর হাওয়া ভবনের সংশ্লিষ্টতার কথা যখন জানা গেল, তখন বোঝা গেল এই ষড়যন্ত্র পরিচালিত হয়েছিল বঙ্গবন্ধু পরিবারকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার লক্ষ্যে এবং তা ‘কতিপয় বিপথগামী’দের কাজ ছিল না। সরকারের ঘুঁটি যারা চালায়, ষড়যন্ত্রে তাদেরও ছিল অংশগ্রহণ।
একুশে আগস্ট তাই নিছক একটা গ্রেনেড হামলার ব্যাপার নয়। এটা নৃশংসতা, বর্বরতা এবং ভাবলেশহীন নিষ্ঠুরতার একটি দলিলবিশেষ। যখন এই ষড়যন্ত্রকারীদের কেউ কেউ গণতন্ত্রের বুলি আওড়ায়, তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না, আমরা এখনো সভ্য রাজনীতি থেকে কত দূরে অবস্থান করছি।
লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
একুশে আগস্ট এলেই হিম হয়ে আসে সব ভাবনা। একুশে আগস্ট ছিল পনেরো আগস্টের ধারাবাহিকতা—এ কথা ভাবলেই বোঝা যায়, কতটা সংগঠিত আকারে পরিচালিত হয়েছিল এই হামলা। ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তৎকালীন বিএনপি সরকারের কতিপয় সদস্য।
ষড়যন্ত্রকারীদের ভাষ্যমতেই এই নৃশংসতার মাস্টারমাইন্ড হিসেবে পরিচিত হয়েছিলেন তারেক রহমান। ঘাতকদের গ্রেনেড ও গুলিতে সেদিনের ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের ২৪ জন নেতা-কর্মী, আহত হয়েছিলেন অসংখ্য মানুষ। সেই বর্বরতার স্মৃতি এখনো শরীরে বহন করে চলেছেন সেই আহত মানুষদের অনেকে।
২০০৪ সালের একুশে আগস্টের সঙ্গে ১৯৭৫ সালের পনেরো আগস্টের মিল-অমিল দুই-ই আছে। তবে দুই নৃশংসতার টার্গেট হলো মুজিব পরিবার, এ ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই। ঘাতকেরা ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে নির্বংশ করতে পারেনি শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা দেশে ছিলেন না বলে। নির্বাসনের দুঃসহ সময় পার করে শেখ হাসিনা দেশে ফিরে জাতীয় রাজনীতিতে যুক্ত হলেন এবং অসংগঠিত আওয়ামী লীগের হাল ধরলেন। তিনি দেশে ফিরেছিলেন ১৯৮১ সালের ১৭ মে।
এর আগে একই বছরের ১৪ থেকে ১৬ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের যে জাতীয় সম্মেলন হয়েছিল, সেই সম্মেলনেই শেখ হাসিনাকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়েছিল।
১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত সময়টি নানা কারণেই তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর নভেম্বর মাসে বাংলাদেশের প্রথম সরকারের তিন মন্ত্রী ও উপরাষ্ট্রপতিকে হত্যা করেছিলেন ওই সরকারেরই আরেক সদস্য খন্দকার মোশতাক আহমদ। খুনি মেজররা যখন বঙ্গবন্ধুকে সরিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্রের কথা সেনাবাহিনীর কোনো কোনো বড় কর্মকর্তাকে জানিয়েছিলেন, তখন তাঁরা এই বিপথগামী সৈনিকদের কোর্ট মার্শালের সম্মুখীন করেননি, ষড়যন্ত্রের কথা জায়গামতো জানাননি; বরং তাঁদেরই কেউ কেউ বলেছিলেন, এই ষড়যন্ত্রে যুক্ত থাকবেন না বটে, কিন্তু বাধাও দেবেন না।
এই তালিকায় সবচেয়ে বড় নামটিই হলো জিয়াউর রহমানের। এরপর মোশতাকের সরকার, জিয়ার সামরিক শাসন, হাস্যকর গণভোট, উগ্র ডান-উগ্র বাম, পাকিস্তানি দালালদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের ককটেল করে দল তৈরি করাসহ কত ঘটনাই না আছে। প্রশাসনে তখন পাকিস্তানপন্থীরা বীরদর্পে অবস্থান করছেন।
আওয়ামী লীগ তখনো অসংগঠিত এবং অস্বীকার করা যাবে না, ১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনের পর দেশ যখন পাকিস্তানমুখী উল্টো যাত্রা শুরু করেছিল, তখনো আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের একটি অংশ যোগ দিয়েছিল মোশতাক-সরকারে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সংগঠিতভাবে প্রতিবাদ না হয়ে বিচ্ছিন্নভাবে খুব অল্প প্রতিবাদ হওয়ার এটাও ছিল একটা বড় কারণ। বঙ্গবন্ধু নেই, কিন্তু মন্ত্রিসভায় বঙ্গবন্ধুর বিশ্বাসভাজনেরাই তো যোগ দিয়েছেন—এতে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয়েছে।
জিয়াউর রহমানের শাসনামলে যে বিশের অধিক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছিল, তাতেই বোঝা যায় কেমন অস্থিরতা চলছিল সেনানিবাসে। অভ্যুত্থান সংঘটিত করার অপরাধে মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের ক্যাঙারু কোর্টে বিচার করা হয়েছে এবং হত্যা করা হয়েছে।
এ রকমই এক রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে শেখ হাসিনা স্বদেশে ফিরেছিলেন। সে মাসেই রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান হত্যার শিকার হয়েছিলেন চট্টগ্রামে। নাটকীয়ভাবে জেনারেল মঞ্জুরকে হত্যা করা হয়েছিল জিয়ার খুনি হিসেবে, কিন্তু দেখা গেল কোনো এক জাদুর স্পর্শে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের হাতে এসে গেল ক্ষমতা।
রাজনীতিতে ক্রমেই শেখ হাসিনা হয়ে উঠছিলেন শক্তিশালী। সম্মিলিত আন্দোলনে এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে বিএনপি এসেছিল ক্ষমতায়। এরপর ১৯৯৬ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে এক মেয়াদে সরকার পরিচালনা করার পর যখন শেখ হাসিনা বিরোধীদলীয় প্রধান, তখনই ঘটেছিল একুশে আগস্টের বোমা হামলা।
পাঠক খেয়াল করে দেখবেন, পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ডের সময় একদল বিপথগামী সৈনিকের অভ্যুত্থানের কথা বলে বড় বড় সামরিক কর্তাব্যক্তিরা কিন্তু তাঁদের দায়ের কথা বেমালুম এড়িয়ে গিয়েছিলেন। রাজনীতিকদের মধ্যে যাঁরা ছিলেন বিভিন্ন বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত, তাঁরাও বঙ্গবন্ধুকে বাঁচাতে কোনো পদক্ষেপ নেননি। বঙ্গবন্ধুকে হটানোর পরিকল্পনা করা হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু এরপর কী করতে হবে, কারা
দেশ চালাবে, এত কিছু মনে হয় পরিকল্পনায় ছিল না।
তাই মোশতাক সরকারের গঠন-প্রক্রিয়াতেই দেখা গিয়েছিল অস্থিরতা। কাউকে অস্ত্রের মুখে টেনে আনা হয়েছে, কেউ স্বেচ্ছায় এসেছেন মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে। সেনাবাহিনীতে অস্থিরতা চলছিল।
একুশে আগস্টে এসে দেখা গেল, পনোরো আগস্টের চেয়ে অনেক বেশি সংগঠিত এ ষড়যন্ত্র। এ হামলা শুধু পূর্বপরিকল্পিতই নয়, কোন প্রশ্নের কোন উত্তর দেওয়া হবে, তাও যেন আগে থেকে ঠিক করা ছিল। সরকারিভাবে কত রকম বয়ান যে এনে হাজির করা হয়েছিল, তার শেষ নেই; অর্থাৎ যারা এই ঘটনার মাস্টারমাইন্ড, তারা যেন লোকচক্ষুর আড়ালে থাকে, তার সব ব্যবস্থাই করে রেখেছিল ষড়যন্ত্রকারীরা।
এখানে বলে রাখা দরকার, গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশক থেকেই আমাদের দেশে জঙ্গি হামলা শুরু হয়েছিল। ১৯৯৯ সালে যশোরে উদীচীর সম্মেলনে হামলার মাধ্যমে এই নৃশংসতার সূচনা, এর আগে-পরে আরও বহু হামলার মধ্য থেকে শুধু দুটো হামলার কথা উল্লেখ করব আমার পরবর্তী ভাষ্যকে প্রমাণ করার জন্য। ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল ঢাকায় ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলা হয়। ২০০৫ সালের ৮ ডিসেম্বর নেত্রকোনার উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর জেলা সংসদ কার্যালয়ে বোমা হামলা হয়। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, এই হামলাগুলোর উদ্দেশ্য ছিল কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে আঘাত করা, জঙ্গিরা কাদের শত্রু বলে মনে করে, তা প্রকাশ করা; অর্থাৎ যারা বাঙালি সংস্কৃতিকে লালন করে, তাদের নিশ্চিহ্ন করাই ছিল হামলার লক্ষ্য।
কিন্তু একুশে আগস্ট বোমা হামলা কোনোভাবেই সে রকম একটা ঘটনা ছিল না। এই হামলার স্পষ্ট উদ্দেশ্য ছিল আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করা।
আওয়ামী লীগের জনসভায় বোমা হামলার সময় বিএনপি রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল বলেই এই হামলার সঙ্গে বিএনপি যুক্ত ছিল, ঢালাওভাবে এ রকম কথা বলছি না। অন্য হামলাগুলোর সঙ্গে কেউ বিএনপির নাম জড়ায়নি। সেগুলো যে ভ্রষ্ট উগ্র ধর্ম-ব্যবসায়ীদের কাজ (যদিও তাদের ব্যাপারে সরকারের শিথিলতার অভিযোগ আছে, ‘বাংলা ভাই বলে কেউ নেই, এসব মিডিয়ার সৃষ্টি’ এ রকম কথা শোনা গেছে সরকারের মন্ত্রীদের মুখ থেকে।), সেটা সবাই জানে।
তাতে বিএনপির দিকে সন্দেহের তির যায়নি। কিন্তু আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলার ব্যাপারটির প্যাটার্ন অন্য সব জঙ্গি হামলার সঙ্গে এক নয়। ধুরন্ধর ষড়যন্ত্রকারীরা সে রকম একটি বাতাবরণের সৃষ্টি করেছিল বটে, কিন্তু তাতে শেষ রক্ষা হয়নি। পনেরো আগস্ট আর একুশে আগস্টের মধ্যে অমিলের এটাও একটা প্রমাণ। পনেরো আগস্টের খুনিরা সগর্বে নিজেদের খুনি ঘোষণা করে বক্তব্য দিয়েছিল, একুশে আগস্টের খুনিরা অপরাধ তো স্বীকার করেইনি; বরং নিজেরাই ঠিক করে দিয়েছিল, কাদের সন্দেহ করতে হবে।
পনেরো আগস্টের খুনিরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর তাদের বাড়িতে লুটপাট চালিয়েছিল। তার চিহ্ন রেখে গিয়েছিল সর্বত্র। একুশে আগস্টের খুনিরা কোনো রকম আলামত যেন না থাকে, তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছিল। একুশে আগস্ট যখন আহতরা কাতরাচ্ছিল, তখন পুলিশ নির্বিকার দাঁড়িয়ে ছিল। এরপর পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়েছিল।
কেন ছুড়েছিল? হামলাকারীদের পালানোর পথ তৈরি করে দেওয়া ছাড়া এর আর কোনো ব্যাখ্যা থাকতে পারে না। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ থেকে গ্রেনেড হামলার আলামতও সরিয়ে ফেলা হয়েছিল।
সে সময় বিএনপির পক্ষ থেকে কী বলা হয়েছিল, সেটাও মনে রাখা দরকার। বিএনপি বলেছিল, এটা আওয়ামী লীগের কাজ। জনগণের সহানুভূতি লাভের জন্য নাকি আওয়ামী লীগ নিজেই নিজের ওপর হামলা চালিয়েছে।
কতটা পাষণ্ড হলে এ রকম মন্তব্য করা যায়! হ্যাঁ, মুফতি হান্নান এই হামলার মূল পরিকল্পনাকারী যদি হয়েও থাকেন, তবুও প্রশ্ন আসে, তিনি মদদ পেয়েছিলেন কোথা থেকে? সে সময় বিএনপির নেতা আবদুল্লাহ আল নোমান বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ বোমা মেরে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চায়।’ মির্জা আব্বাস বলেছিলেন, ‘শেখ হাসিনা তাঁর দলের কর্মীদের হত্যা করে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন।’
বিএনপির নেতাদের এই হলো সততার নমুনা। নামকাওয়াস্তে বিচারপতি জয়নুল আবেদিনের নেতৃত্বে যে বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠন করা হয়েছিল, সেই কমিশন বেমালুম বলে দিয়েছিল এই হামলার পেছনে জঙ্গিগোষ্ঠী নেই। সীমান্তের ওপারের শক্তিশালী দেশটিই নাকি এ হত্যাযজ্ঞের হোতা।
সবচেয়ে বড় ম্যাসাকারের জন্ম দেওয়া হলো জজ মিয়া নাটকটি তৈরি করে। তাকে গ্রেনেড হামলার রাজসাক্ষী করার কথাও ভাবা হলো। কিন্তু এই সবকিছুর পেছনে জজ মিয়ার পরিবারকে মাসিক অর্থ দেওয়ার কথা যখন ফাঁস হয়ে গেল, তখন আর এই গল্প নিয়ে তারা বেশি দূর এগিয়ে যেতে পারেনি।
এ পর্যন্ত জঙ্গি হামলাকারীদের কথাই বলা হলো। তারাই কি সব সিদ্ধান্ত নিয়েছিল? না। পরবর্তীকালে তদন্তে উঠে এল বিএনপি সরকারের প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রীরাও এই তৎপরতার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন এই ষড়যন্ত্রের রূপকারদের একজন। আর তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর কী করেছিলেন? তিনি অপরাধীদের বিদেশে পার করে দিয়েছিলেন।
এরপর হাওয়া ভবনের সংশ্লিষ্টতার কথা যখন জানা গেল, তখন বোঝা গেল এই ষড়যন্ত্র পরিচালিত হয়েছিল বঙ্গবন্ধু পরিবারকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার লক্ষ্যে এবং তা ‘কতিপয় বিপথগামী’দের কাজ ছিল না। সরকারের ঘুঁটি যারা চালায়, ষড়যন্ত্রে তাদেরও ছিল অংশগ্রহণ।
একুশে আগস্ট তাই নিছক একটা গ্রেনেড হামলার ব্যাপার নয়। এটা নৃশংসতা, বর্বরতা এবং ভাবলেশহীন নিষ্ঠুরতার একটি দলিলবিশেষ। যখন এই ষড়যন্ত্রকারীদের কেউ কেউ গণতন্ত্রের বুলি আওড়ায়, তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না, আমরা এখনো সভ্য রাজনীতি থেকে কত দূরে অবস্থান করছি।
লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
সম্প্রতি হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী তিন দিনের মধ্যে অটোরিকশা বন্ধের প্রস্তাবে চালকদের রাস্তায় নেমে আসা এবং শহর কার্যত অচল হয়ে পড়ার ঘটনা ঘটেছে। এ অবরোধে সড়ক ও রেলপথে যোগাযোগ ব্যাহত হওয়ায় মানুষের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছায়।
৭ ঘণ্টা আগেআগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নিতে পারবে কী পারবে না, তাদেরকে নির্বাচনে অংশ নিতে দেওয়া হবে কী হবে না—এ নিয়ে গরম এখন রাজনীতির মাঠ। জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের নায়ক হিসেবে দাবিদার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দাবি তো আরও একধাপ বেশি। আওয়ামী লীগকে কেবল নির্বাচনের বাইরে রাখাই নয়, দাবি তাদের দেশের প্রাচী
১৫ ঘণ্টা আগেহুমায়ূন আহমেদ ও মেহের আফরোজ শাওনের ছেলে নিষাদ হুমায়ূনের একটা ভাইরাল ভিডিও ক্লিপ দেখলাম। বেশ মজা পেলাম। সত্যি বললে মজার চেয়েও ছোট্ট বাচ্চার কথায় ভাবনার উদ্রেক হলো। চিন্তার দুয়ার উন্মুক্ত হলো।
১৫ ঘণ্টা আগেপরিবেশকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে সার্কুলার অর্থনীতি বা বৃত্তাকার অর্থনীতি এক নবদিগন্ত উন্মোচন করতে পারে। বাংলাদেশে স্বল্প সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে সার্কুলার অর্থনীতির বিকল্প নেই।
১৫ ঘণ্টা আগে