চিররঞ্জন সরকার
পুরস্কার, পদক, খেতাব, সম্মাননা ইত্যাদিতে মানুষের এক চিরন্তন ভালো লাগার অনুভূতি আছে। আছে তৃপ্তি ও ভালোবাসা। কারণ, এতে স্বীকৃতি ও সম্মান আছে। কেউ তাঁর অবদানের স্বীকৃতি ও সম্মান পেলে অবশ্যই ভালো লাগবে। কারণ, মানুষ শেষ পর্যন্ত কাজের, অবদানের ও অর্জনের স্বীকৃতি পেতে চায়। এ স্বীকৃতি দেয় সম্প্রদায়, সমাজ ও দেশ। কখনো কখনো সে স্বীকৃতি একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যের একটি কাজের পুরস্কার, যেমন পুলিৎজার পুরস্কার বা বুকার পুরস্কার। আবার কখনো কখনো কোনো কোনো পুরস্কার কোনো একটি বিষয়ে সারা জীবনের অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে দেওয়া হয়। যেমন নোবেল পুরস্কার।
দেশের অন্যতম মর্যাদাবান পুরস্কার হচ্ছে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার। ‘জাতির মননের প্রতীক’ স্বায়ত্তশাসিত এই প্রতিষ্ঠানটি ২৩ জানুয়ারি ২০২৪ সালের বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-লেখকদের নামের তালিকা প্রকাশ করে। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, একাডেমির নির্বাহী পরিষদের অনুমোদনে এই পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে।
এবারের বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ঘোষণার পর থেকেই কবি-লেখকদের একাংশ প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে। এরই মধ্যে ‘বিতর্কিত বাংলা একাডেমি পুরস্কার-২০২৪ বাতিল ও ফ্যাসিবাদ পুনর্বাসনের প্রতিবাদে’ একাডেমি ঘেরাও কর্মসূচি গ্রহণ করে। সমালোচনা ও প্রতিবাদের মুখে শেষ পর্যন্ত পুরস্কারের জন্য ঘোষিত নামের তালিকা স্থগিত করেছে বাংলা একাডেমি। এ ব্যাপারে অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ফেসবুকে লেখেন, ‘বাংলা একাডেমি পুরস্কারের জন্য ঘোষিত নামের তালিকা স্থগিত করা হয়েছে। পাশাপাশি এটাও বলা প্রয়োজন, যে আজব নীতিমালা এই ধরনের উদ্ভট এবং কোটারি পুরস্কারের সুযোগ করে দেয়, সেগুলা দ্রুত রিভিউ করা আমাদের প্রথম কাজ। পাশাপাশি বাংলা একাডেমি কীভাবে পরিচালিত হবে, কোন সব নীতিতে চলবে—এই সবকিছুই দেখতে হবে। একাডেমির আমূল সংস্কারের দিকে আমরা যাব এখন। দেশের সংস্কার হবে, বাংলা একাডেমির সংস্কার কেন নয়?’
বাংলা একাডেমির সংস্কার হবে, তা খুব ভালো কথা। কিন্তু তালিকা প্রকাশের পর হঠাৎ কেন এটা স্থগিত করা হলো? ধরে নেওয়া যাক, যে তালিকাটি প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে দু-একজন বিতর্কিত মানুষ স্থান পেয়েছেন। কিন্তু ‘ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না’—বাংলা একাডেমির মতো একটা সাবালক প্রতিষ্ঠানের কি জানা ছিল না? যাঁদের নাম ঘোষণা করা হয়েছিল, এখন যদি তাঁদের কারও কারও নাম বাদ দেওয়া হয়, তাহলে ওই ব্যক্তিদের সম্মানহানির মাশুল কে দেবে? বাংলা একাডেমি কি তাঁদের সম্মান ফিরিয়ে দিতে পারবে? কারও সম্মান-মর্যাদা নিয়ে ছিনিমিনি খেলার অধিকার একাডেমিকে কে দিয়েছে?
দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের কেউ দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ করতেই পারেন, কিন্তু বিনা জবাবদিহিতে কেউ ছাড় পেতে পারেন না। রাষ্ট্রের কোষাগারের টাকা, যা জনগণের করের টাকা, তা খুশিমতো বিলিবণ্টন করা যায় না। পুরস্কারের তালিকা প্রণয়ন কমিটিতে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের জিজ্ঞাসা করা উচিত, কোন বিবেচনায় তাঁরা পুরস্কারের জন্য মনোনীত ব্যক্তিদের তালিকা করেছেন। তা যদি না-ও করা হয়, অন্তত সরকারের উচিত তাঁদের নাম গণমাধ্যমে প্রকাশ করা। গণমাধ্যমকর্মীরা যেন অন্তত তাঁদের বিবেচনাটা জানতে পারেন।
সারা পৃথিবীর যেকোনো পুরস্কার নিয়েই বিতর্ক আছে। আমাদের দেশেও তা হয়ে থাকে। আর পুরস্কার সব সময় যে যোগ্যদের হাতে যায়, তা-ও নয়। তবে যে কারণ দেখিয়ে পুরস্কার বাতিল করা হয়েছে, তা খুবই আপত্তিকর। পুরস্কারের জন্য ঘোষিত ব্যক্তিদের কারও কারও ‘রাজনৈতিক অবস্থান’ নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। যদিও এটা খুবই স্থূল একটি বিষয়। যাঁরা পুরস্কার পেয়েছেন তাঁরা তাঁদের কর্ম ও লেখক সত্তা হিসেবেই পুরস্কার পেয়েছেন, এই পুরস্কারের সঙ্গে রাজনৈতিক সমর্থন বা সংস্রবের কোনো সম্পর্ক নেই, থাকা উচিতও নয়। পুরস্কারের জন্য বিবেচ্য হওয়া উচিত তিনি ভালো বা যোগ্য লেখক কি না। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তাঁর অবদান, গবেষণা ও সৃজনশীলতা আছে কি না। কিন্তু বিপ্লবী চেতনার তোড়ে এই আসল আলোচনাটাই হারিয়ে গেছে।
বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার প্রদানের ক্ষেত্রে একটা প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়। প্রক্রিয়াটা খুব সহজ। বাংলা একাডেমির ফেলোদের মধ্য থেকেই একেক বছর ২০-৩০ জনকে নিয়ে একটা নির্বাচক কমিটি বানানো হয়। এই নির্বাচকমণ্ডলীর কাজ হচ্ছে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে অন্তত একজন করে লেখক-কবি-গবেষকসহ অন্যান্য ক্যাটাগরির লেখকদের নাম প্রস্তাব করা। প্রস্তাবিত নামগুলো আরেকটি কমিটির মাধ্যমে বাছাই করে চূড়ান্ত তালিকা তৈরি করা হয়।
প্রশ্ন হলো, যাঁরা এই তালিকাটি প্রস্তুত করেছেন, যাঁরা অনুমোদন করেছেন, তাঁরা কি তবে ঘাস খাওয়া পাবলিক? তাঁদের সিদ্ধান্তের কোনো মূল্য নেই? আসলে সরকার কোনো সিদ্ধান্তেই অটল থাকতে পারছে না। মহলবিশেষের কথায় তারা বারবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করছে। এটা অস্থিরতাকেই বাড়িয়ে তুলছে।
আমাদের দেশে সরকারি পদক-পুরস্কারের মধ্যে মর্যাদাসম্পন্ন হলো স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পদক ও বাংলা একাডেমি পুরস্কার। কিন্তু এ পুরস্কারগুলোর মনোনয়ন নিয়ে বিতর্ক চলছেই। এসব পুরস্কার প্রদানের যে নীতিমালা আছে, তা থাকা না-থাকা সমান। স্বচ্ছতারও কোনো প্রমাণ নেই। স্বাধীনতা পুরস্কার ও একুশে পদক যাঁরা পান, তাঁরা যেন অলৌকিকভাবে পান, কঠিন বিচার-বিবেচনার মাধ্যমে নয়।
প্রতিটি সরকারি কাজের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা দরকার। কিন্তু আমাদের দেশে তা নেই। কেবল বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার নয়, আমাদের দেশে কোনো রাষ্ট্রীয় পদক ও পুরস্কার প্রদানের সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা নেই। থাকলেও তা মেনে চলা হয় না। আমাদের রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পুরস্কার কজন পাবেন, কারা পাবেন এবং কী অবদানের জন্য পাবেন, তা নির্দিষ্ট করে কোথাও বলা নেই। সরকারের কাগুজে একটি নীতিমালা থাকলেও তা সচরাচর মানা হয় না। নিয়মে বলা আছে, যেকোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও প্রতিষ্ঠানকে গৌরবোজ্জ্বল ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য সরকার স্বাধীনতা পুরস্কার বা একুশে পদক দিতে পারে। এসব পুরস্কারের সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা হলো পুরস্কারের জন্য প্রার্থীকে বা তাঁর পক্ষে মনোনয়ন দানকারীকে আবেদনের ৩০টি অনুলিপি জমা দিতে হয়। কৃতী ব্যক্তিরা নিজের উদ্যোগে এসব করতে স্বস্তি বোধ করেন না। আত্মসম্মান বোধসম্পন্ন কোনো ব্যক্তি এই কাজটি করেন না। জুরিবোর্ডে, মন্ত্রণালয়ে বা সরকারের কমিটিতে যাঁরা থাকেন, রাষ্ট্রীয় পুরস্কারের জন্য বিশিষ্ট নাগরিককে খুঁজে বের করার দায়িত্ব আসলে তাঁদের ওপরই বর্তায়। কিন্তু তাঁরা এই কাজটি যথাযথভাবে করেন না। তাঁদের সেই গরজও নেই। এই পুরস্কারের জন্য তাঁরাই সবচেয়ে বেশি আবেদন করেন বা তাঁদেরই মনোনয়ন দান করা হয়, যাঁদের পুরস্কার-লিপ্সার সঙ্গে সঙ্গে উচ্চপর্যায়ে যোগাযোগ প্রবল। ফলে রাষ্ট্রীয় অর্থের গচ্চা গেলেও প্রায় ক্ষেত্রেই যথাযথ ব্যক্তিরা পুরস্কৃত হন না। অযোগ্যদের হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়ায় যোগ্যদেরও প্রকারান্তরে অপমান করা হয়।
আমাদের দেশে পুরস্কার প্রদানের ক্ষেত্রে নানা ধরনের অসংগতি লক্ষ করা যায়। অনেক যোগ্য ব্যক্তি পুরস্কার পেয়েছেন, অযোগ্যদের সঙ্গে, একই মঞ্চে। আবার অনেক ক্ষেত্রে যোগ্য ব্যক্তিটি আগে বিবেচিত হননি। অযোগ্য কোনো ব্যক্তিকে হয়তো আগেরবার পুরস্কৃত করা হয়েছে, পরেরবার যোগ্য ব্যক্তিটিকে। এর মাধ্যমেও আসলে যোগ্য ব্যক্তিটিকে অসম্মান করা হয়। অনেক সময় যোগ্যদের পুরস্কৃত করা হয় অযোগ্যদের জায়েজ করার অংশ হিসেবে। এটাকেও কেউ কেউ ‘পুরস্কার-ইঞ্জিনিয়ারিং’ হিসেবে অভিহিত করছেন। এই প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন শাখায় যদি দশজনকে পুরস্কার দেওয়া হয়, তাহলে সেখানে আটজনকে নির্বাচিত করা হয় অযোগ্যতার মাপকাঠিতে আর বাকি দুজনকে যোগ্যতার মাপকাঠিতে। কিন্তু যে দুজনকে যোগ্যতার মাপকাঠিতে নির্বাচন করা হয়, তাঁরা বলি হন অন্য আটজনের। এই দুজনকে দিয়ে তাঁরা অন্য আটজনকে বৈধ করে নেন। আর অযোগ্যতাকেই যখন যোগ্যতা হিসেবে দেখা হয়, তখন তা যোগ্যদের জন্য লজ্জার কারণ হয়ে ওঠে।
পুরস্কার প্রদানের ক্ষেত্রে মরণোত্তর শব্দটিও বাংলাদেশে বহুল পরিচিত। সরকারি পদক-পুরস্কার প্রদানের ক্ষেত্রে সম্ভবত মৃত ব্যক্তিরা অগ্রাধিকার পান। এসব ক্ষেত্রে পদক-পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের পাশে ব্র্যাকেটে লেখা থাকে ‘মরণোত্তর’। এটা নিয়েও অনেক সমালোচনা হয়েছে। পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তি যদি বিপত্নীক হন এবং তাঁর ভাই-বোন ভাতিজি-ভাগনি কিছুই না থাকে, তাঁর শ্বশুর-শাশুড়ি বা শ্যালক-শ্যালিকা মেডেল নিতে আসেন, তাতে প্রাপকের কী প্রাপ্তি? তারপরও ‘মরণোত্তর’ পুরস্কার প্রদানের প্রথা চলছেই।
স্বাধীনতার পদক, একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পদক-পুরস্কার তো বটেই, যেকোনো পদক-পুরস্কার
প্রদানে নাম বাছাইয়ের ব্যাপারে সর্বোচ্চ সততা ও সুবিবেচনা থাকা উচিত। দলপ্রীতি, গোষ্ঠীপ্রীতি, স্বজনপ্রীতি থেকে এই সম্মানজনক পুরস্কার ও পদকগুলোকে ঊর্ধ্বে রাখা দরকার। নইলে এগুলো তার সম্মান ও মর্যাদা হারাবে। রাজনৈতিক অনুগ্রহ হিসেবে যেন এই পদক ও পুরস্কারগুলোকে ব্যবহার করা না হয়।
পুরস্কার, পদক, খেতাব, সম্মাননা ইত্যাদিতে মানুষের এক চিরন্তন ভালো লাগার অনুভূতি আছে। আছে তৃপ্তি ও ভালোবাসা। কারণ, এতে স্বীকৃতি ও সম্মান আছে। কেউ তাঁর অবদানের স্বীকৃতি ও সম্মান পেলে অবশ্যই ভালো লাগবে। কারণ, মানুষ শেষ পর্যন্ত কাজের, অবদানের ও অর্জনের স্বীকৃতি পেতে চায়। এ স্বীকৃতি দেয় সম্প্রদায়, সমাজ ও দেশ। কখনো কখনো সে স্বীকৃতি একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যের একটি কাজের পুরস্কার, যেমন পুলিৎজার পুরস্কার বা বুকার পুরস্কার। আবার কখনো কখনো কোনো কোনো পুরস্কার কোনো একটি বিষয়ে সারা জীবনের অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে দেওয়া হয়। যেমন নোবেল পুরস্কার।
দেশের অন্যতম মর্যাদাবান পুরস্কার হচ্ছে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার। ‘জাতির মননের প্রতীক’ স্বায়ত্তশাসিত এই প্রতিষ্ঠানটি ২৩ জানুয়ারি ২০২৪ সালের বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-লেখকদের নামের তালিকা প্রকাশ করে। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, একাডেমির নির্বাহী পরিষদের অনুমোদনে এই পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে।
এবারের বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ঘোষণার পর থেকেই কবি-লেখকদের একাংশ প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে। এরই মধ্যে ‘বিতর্কিত বাংলা একাডেমি পুরস্কার-২০২৪ বাতিল ও ফ্যাসিবাদ পুনর্বাসনের প্রতিবাদে’ একাডেমি ঘেরাও কর্মসূচি গ্রহণ করে। সমালোচনা ও প্রতিবাদের মুখে শেষ পর্যন্ত পুরস্কারের জন্য ঘোষিত নামের তালিকা স্থগিত করেছে বাংলা একাডেমি। এ ব্যাপারে অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ফেসবুকে লেখেন, ‘বাংলা একাডেমি পুরস্কারের জন্য ঘোষিত নামের তালিকা স্থগিত করা হয়েছে। পাশাপাশি এটাও বলা প্রয়োজন, যে আজব নীতিমালা এই ধরনের উদ্ভট এবং কোটারি পুরস্কারের সুযোগ করে দেয়, সেগুলা দ্রুত রিভিউ করা আমাদের প্রথম কাজ। পাশাপাশি বাংলা একাডেমি কীভাবে পরিচালিত হবে, কোন সব নীতিতে চলবে—এই সবকিছুই দেখতে হবে। একাডেমির আমূল সংস্কারের দিকে আমরা যাব এখন। দেশের সংস্কার হবে, বাংলা একাডেমির সংস্কার কেন নয়?’
বাংলা একাডেমির সংস্কার হবে, তা খুব ভালো কথা। কিন্তু তালিকা প্রকাশের পর হঠাৎ কেন এটা স্থগিত করা হলো? ধরে নেওয়া যাক, যে তালিকাটি প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে দু-একজন বিতর্কিত মানুষ স্থান পেয়েছেন। কিন্তু ‘ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না’—বাংলা একাডেমির মতো একটা সাবালক প্রতিষ্ঠানের কি জানা ছিল না? যাঁদের নাম ঘোষণা করা হয়েছিল, এখন যদি তাঁদের কারও কারও নাম বাদ দেওয়া হয়, তাহলে ওই ব্যক্তিদের সম্মানহানির মাশুল কে দেবে? বাংলা একাডেমি কি তাঁদের সম্মান ফিরিয়ে দিতে পারবে? কারও সম্মান-মর্যাদা নিয়ে ছিনিমিনি খেলার অধিকার একাডেমিকে কে দিয়েছে?
দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের কেউ দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ করতেই পারেন, কিন্তু বিনা জবাবদিহিতে কেউ ছাড় পেতে পারেন না। রাষ্ট্রের কোষাগারের টাকা, যা জনগণের করের টাকা, তা খুশিমতো বিলিবণ্টন করা যায় না। পুরস্কারের তালিকা প্রণয়ন কমিটিতে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের জিজ্ঞাসা করা উচিত, কোন বিবেচনায় তাঁরা পুরস্কারের জন্য মনোনীত ব্যক্তিদের তালিকা করেছেন। তা যদি না-ও করা হয়, অন্তত সরকারের উচিত তাঁদের নাম গণমাধ্যমে প্রকাশ করা। গণমাধ্যমকর্মীরা যেন অন্তত তাঁদের বিবেচনাটা জানতে পারেন।
সারা পৃথিবীর যেকোনো পুরস্কার নিয়েই বিতর্ক আছে। আমাদের দেশেও তা হয়ে থাকে। আর পুরস্কার সব সময় যে যোগ্যদের হাতে যায়, তা-ও নয়। তবে যে কারণ দেখিয়ে পুরস্কার বাতিল করা হয়েছে, তা খুবই আপত্তিকর। পুরস্কারের জন্য ঘোষিত ব্যক্তিদের কারও কারও ‘রাজনৈতিক অবস্থান’ নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। যদিও এটা খুবই স্থূল একটি বিষয়। যাঁরা পুরস্কার পেয়েছেন তাঁরা তাঁদের কর্ম ও লেখক সত্তা হিসেবেই পুরস্কার পেয়েছেন, এই পুরস্কারের সঙ্গে রাজনৈতিক সমর্থন বা সংস্রবের কোনো সম্পর্ক নেই, থাকা উচিতও নয়। পুরস্কারের জন্য বিবেচ্য হওয়া উচিত তিনি ভালো বা যোগ্য লেখক কি না। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তাঁর অবদান, গবেষণা ও সৃজনশীলতা আছে কি না। কিন্তু বিপ্লবী চেতনার তোড়ে এই আসল আলোচনাটাই হারিয়ে গেছে।
বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার প্রদানের ক্ষেত্রে একটা প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়। প্রক্রিয়াটা খুব সহজ। বাংলা একাডেমির ফেলোদের মধ্য থেকেই একেক বছর ২০-৩০ জনকে নিয়ে একটা নির্বাচক কমিটি বানানো হয়। এই নির্বাচকমণ্ডলীর কাজ হচ্ছে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে অন্তত একজন করে লেখক-কবি-গবেষকসহ অন্যান্য ক্যাটাগরির লেখকদের নাম প্রস্তাব করা। প্রস্তাবিত নামগুলো আরেকটি কমিটির মাধ্যমে বাছাই করে চূড়ান্ত তালিকা তৈরি করা হয়।
প্রশ্ন হলো, যাঁরা এই তালিকাটি প্রস্তুত করেছেন, যাঁরা অনুমোদন করেছেন, তাঁরা কি তবে ঘাস খাওয়া পাবলিক? তাঁদের সিদ্ধান্তের কোনো মূল্য নেই? আসলে সরকার কোনো সিদ্ধান্তেই অটল থাকতে পারছে না। মহলবিশেষের কথায় তারা বারবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করছে। এটা অস্থিরতাকেই বাড়িয়ে তুলছে।
আমাদের দেশে সরকারি পদক-পুরস্কারের মধ্যে মর্যাদাসম্পন্ন হলো স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পদক ও বাংলা একাডেমি পুরস্কার। কিন্তু এ পুরস্কারগুলোর মনোনয়ন নিয়ে বিতর্ক চলছেই। এসব পুরস্কার প্রদানের যে নীতিমালা আছে, তা থাকা না-থাকা সমান। স্বচ্ছতারও কোনো প্রমাণ নেই। স্বাধীনতা পুরস্কার ও একুশে পদক যাঁরা পান, তাঁরা যেন অলৌকিকভাবে পান, কঠিন বিচার-বিবেচনার মাধ্যমে নয়।
প্রতিটি সরকারি কাজের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা দরকার। কিন্তু আমাদের দেশে তা নেই। কেবল বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার নয়, আমাদের দেশে কোনো রাষ্ট্রীয় পদক ও পুরস্কার প্রদানের সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা নেই। থাকলেও তা মেনে চলা হয় না। আমাদের রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পুরস্কার কজন পাবেন, কারা পাবেন এবং কী অবদানের জন্য পাবেন, তা নির্দিষ্ট করে কোথাও বলা নেই। সরকারের কাগুজে একটি নীতিমালা থাকলেও তা সচরাচর মানা হয় না। নিয়মে বলা আছে, যেকোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও প্রতিষ্ঠানকে গৌরবোজ্জ্বল ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য সরকার স্বাধীনতা পুরস্কার বা একুশে পদক দিতে পারে। এসব পুরস্কারের সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা হলো পুরস্কারের জন্য প্রার্থীকে বা তাঁর পক্ষে মনোনয়ন দানকারীকে আবেদনের ৩০টি অনুলিপি জমা দিতে হয়। কৃতী ব্যক্তিরা নিজের উদ্যোগে এসব করতে স্বস্তি বোধ করেন না। আত্মসম্মান বোধসম্পন্ন কোনো ব্যক্তি এই কাজটি করেন না। জুরিবোর্ডে, মন্ত্রণালয়ে বা সরকারের কমিটিতে যাঁরা থাকেন, রাষ্ট্রীয় পুরস্কারের জন্য বিশিষ্ট নাগরিককে খুঁজে বের করার দায়িত্ব আসলে তাঁদের ওপরই বর্তায়। কিন্তু তাঁরা এই কাজটি যথাযথভাবে করেন না। তাঁদের সেই গরজও নেই। এই পুরস্কারের জন্য তাঁরাই সবচেয়ে বেশি আবেদন করেন বা তাঁদেরই মনোনয়ন দান করা হয়, যাঁদের পুরস্কার-লিপ্সার সঙ্গে সঙ্গে উচ্চপর্যায়ে যোগাযোগ প্রবল। ফলে রাষ্ট্রীয় অর্থের গচ্চা গেলেও প্রায় ক্ষেত্রেই যথাযথ ব্যক্তিরা পুরস্কৃত হন না। অযোগ্যদের হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়ায় যোগ্যদেরও প্রকারান্তরে অপমান করা হয়।
আমাদের দেশে পুরস্কার প্রদানের ক্ষেত্রে নানা ধরনের অসংগতি লক্ষ করা যায়। অনেক যোগ্য ব্যক্তি পুরস্কার পেয়েছেন, অযোগ্যদের সঙ্গে, একই মঞ্চে। আবার অনেক ক্ষেত্রে যোগ্য ব্যক্তিটি আগে বিবেচিত হননি। অযোগ্য কোনো ব্যক্তিকে হয়তো আগেরবার পুরস্কৃত করা হয়েছে, পরেরবার যোগ্য ব্যক্তিটিকে। এর মাধ্যমেও আসলে যোগ্য ব্যক্তিটিকে অসম্মান করা হয়। অনেক সময় যোগ্যদের পুরস্কৃত করা হয় অযোগ্যদের জায়েজ করার অংশ হিসেবে। এটাকেও কেউ কেউ ‘পুরস্কার-ইঞ্জিনিয়ারিং’ হিসেবে অভিহিত করছেন। এই প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন শাখায় যদি দশজনকে পুরস্কার দেওয়া হয়, তাহলে সেখানে আটজনকে নির্বাচিত করা হয় অযোগ্যতার মাপকাঠিতে আর বাকি দুজনকে যোগ্যতার মাপকাঠিতে। কিন্তু যে দুজনকে যোগ্যতার মাপকাঠিতে নির্বাচন করা হয়, তাঁরা বলি হন অন্য আটজনের। এই দুজনকে দিয়ে তাঁরা অন্য আটজনকে বৈধ করে নেন। আর অযোগ্যতাকেই যখন যোগ্যতা হিসেবে দেখা হয়, তখন তা যোগ্যদের জন্য লজ্জার কারণ হয়ে ওঠে।
পুরস্কার প্রদানের ক্ষেত্রে মরণোত্তর শব্দটিও বাংলাদেশে বহুল পরিচিত। সরকারি পদক-পুরস্কার প্রদানের ক্ষেত্রে সম্ভবত মৃত ব্যক্তিরা অগ্রাধিকার পান। এসব ক্ষেত্রে পদক-পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের পাশে ব্র্যাকেটে লেখা থাকে ‘মরণোত্তর’। এটা নিয়েও অনেক সমালোচনা হয়েছে। পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তি যদি বিপত্নীক হন এবং তাঁর ভাই-বোন ভাতিজি-ভাগনি কিছুই না থাকে, তাঁর শ্বশুর-শাশুড়ি বা শ্যালক-শ্যালিকা মেডেল নিতে আসেন, তাতে প্রাপকের কী প্রাপ্তি? তারপরও ‘মরণোত্তর’ পুরস্কার প্রদানের প্রথা চলছেই।
স্বাধীনতার পদক, একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পদক-পুরস্কার তো বটেই, যেকোনো পদক-পুরস্কার
প্রদানে নাম বাছাইয়ের ব্যাপারে সর্বোচ্চ সততা ও সুবিবেচনা থাকা উচিত। দলপ্রীতি, গোষ্ঠীপ্রীতি, স্বজনপ্রীতি থেকে এই সম্মানজনক পুরস্কার ও পদকগুলোকে ঊর্ধ্বে রাখা দরকার। নইলে এগুলো তার সম্মান ও মর্যাদা হারাবে। রাজনৈতিক অনুগ্রহ হিসেবে যেন এই পদক ও পুরস্কারগুলোকে ব্যবহার করা না হয়।
বাংলাদেশ যখন সম্পর্ক উন্নয়নে আগ্রহী তখন যুক্তরাষ্ট্র যদি বাংলাদেশে তার ভূমিকা কার্যত পরিত্যাগ করে সে ক্ষেত্রে ঢাকা চীনের গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অংশীদার হয়ে উঠতে পারে এবং তাহলে বেইজিং নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশকে আরও বেশি অর্থায়ন ও ঋণ দেবে।
৮ ঘণ্টা আগেবাংলাদেশের জাতীয় জনসংখ্যা দিবস প্রতিবছর ২ ফেব্রুয়ারি পালিত হয়। এই দিবসটি জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রভাব, পরিবার পরিকল্পনা, স্বাস্থ্যসেবা এবং টেকসই উন্নয়ন সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে পালন করা হয়। ২০২৫ সালে এই দিবসটি আমাদের জন্য বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। কারণ, দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত
১২ ঘণ্টা আগেযোদ্ধা ও ভিক্ষুকের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব এবং চরিত্র নিয়ে শ্রদ্ধেয় শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর একটি অসাধারণ লেখা ছাপা হয়েছে। লেখাটি নানা কারণেই একটা বড় চিন্তার বিষয় হয়ে পড়েছে। যদিও এসব কথা আমরা সবাই জানি। কিন্তু এমন তুলনামূলক বিশ্লেষণ কখনোই সেভাবে আসেনি।
১ দিন আগেঅভূতপূর্ব এক গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সামনে প্রকৃত অর্থেই এক নবযাত্রার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। মনে হয়েছিল এক নতুন ভোরের সূর্যোদয়। কিন্তু ছয় মাস না পেরোতেই আশা ফিকে হয়ে আসছে। ঈষান কোণের কালো মেঘ তার বিস্তার ঘটাচ্ছে।
১ দিন আগে