জাতীয় লজিস্টিক পলিসি ও বেসরকারি খাতের প্রত্যাশা

জাহাঙ্গীর আলম শোভন
প্রকাশ : ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ২০: ৫৬
আপডেট : ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ২০: ৫৯

লজিস্টিক শব্দটির যথাযথ ও প্রচলিত বাংলা না থাকার কারণে আমরা ‘জাতীয় লজিস্টিক নীতিমালা’ কিংবা ‘জাতীয় লজিস্টিক পলিসি’ উভয়ক্ষেত্রে ‘লজিস্টিক’ শব্দটি রাখছি। এর মানে এই নয় যে, বাংলাভাষা খুব দীন আর এর যথার্থ বাংলা শব্দ নেই। মূলত লজিস্টিক, রসদ, রসদপনা বা রসদ ব্যবস্থাপনা— বাংলাতে যা–ই বলি না কেন— এটি ছাড়া আমাদের জীবনের কোনো কাজই চলছে না। সব কাজই রসদ সম্পর্কিত এবং রসদ ব্যবস্থাপনার মধ্যে পড়ে। 

কিন্তু যখন এটিকে আমরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও প্রাতিষ্ঠানিক কর্মপন্থা হিসেবে পরিকল্পনায় আনতে চাই, তখন আমরা অগ্রসরদের কাছ থেকে জ্ঞান নিই। আর এ কারণে সেখান থেকে আমরা শব্দ গ্রহণ করি এবং ক্ষেত্রে বিশেষে সেখানে যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে তার অনুরুপ শব্দ খুঁজতে চেষ্টা করি। কিন্তু একটি শব্দের অর্থের পরিধি হয়তো অতো বেশি থাকে না, বিধায় কখনো সেটিকে আইন ও বিধি দ্বারা নতুন সংজ্ঞা দিয়ে সমৃদ্ধ করা হয়, কখনো সেটিকে সহায়ক শব্দ জুড়ে দিয়ে অর্থপূর্ণ করা হয়। 

তাই লজিস্টিক পলিসি হয়তো রসদ নীতিমালা হতে পারে আবার নাও হতে পারে। নামের ক্ষেত্রে কোনো নতুনত্ব না এলেও এর নীতিগুলোর মধ্যে এমন কিছু থাকা প্রয়োজন যাতে এ সংক্রান্ত নিয়মতান্ত্রিক সমস্যা এবং ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত সমস্যা দূর হয়ে যায়। এতে করে একদিকে অভ্যন্তরীণ সাপ্লাইচেইন আরও গতিশীল ও উন্নত হবে এবং বৈদেশিক বাণিজ্য সহজ ও প্রবৃদ্ধিমুখী হবে। বর্তমানে নীতিমালা প্রণয়নে তোড়জোড় চলতে থাকা এই বিষয়ে থেকে এমনটাই প্রত্যাশা করছে বেসরকারি খাতের অংশীজনেরা। 

লজিস্টিক পলিসি বা রসদ নীতিমালা তৈরি ডাক বিভাগ কাজ শুরু করে। দেখা যায়, এখানে সরকারের অর্ধশতাধিক এজেন্সি কোনো কোনোভাবে এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত। এমনকি বেসরকারি সব খাতই এর সঙ্গে সম্পৃক্ত। অন্তত সরাসরি সম্পৃক্ত রয়েছে শতাধিক খাত। তাই সবার সমন্বয়ে একটি কার্যকর ও সময় উপযোগী রসদ নীতিমালা প্রণয়ন সময়ের চাহিদা হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

এরই আলোকে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের নেতৃত্বাধীন একটি কমিটি কয়েকটি উপকমিটি নিয়ে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করছে। এতে প্রায় ২১টি উপখাত চিহ্নিত করে প্রতিটি উপখাতের সমস্যা, সমাধান ও উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের অধীনে পরামর্শ কর্মশালার মাধ্যমে বিষয়গুলোকে একীভূত করা হচ্ছে। বলা বাহুল্য ই–কমার্স লজিস্টিকও এই খাতের একটি উপখাত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। তবে ক্রস বর্ডার ই–কমার্স সাপ্লাইচেইনও এর আলাদা একটি অংশ হওয়া উচিত। 

প্রথমবারের মতো অভ্যন্তরীণ ও আন্তজাতিক ইস্যু মিলিয়ে একটি সমন্বিত স্মার্ট রসদ নীতিমালা বা ইন্ট্রিগেটেড স্মার্ট লজিস্টিক পলিসি তৈরির প্রথম চ্যালেঞ্জ হলো— সব উপখাতের সমস্যাগুলোর সমন্বিত সমাধানের পথ নির্দেশ করা। 

এসব ক্ষেত্রে অতীতের ভালো অভিজ্ঞতার পাশাপাশি খারাপ অভিজ্ঞতাও রয়েছে। উদারহণস্বরুপ বলা যায়, ডিজিটাল কমার্স পলিসি ২০১৮ প্রণয়নের সময় ক্রস বর্ডার ই–কমার্সের বিষয়টি উপেক্ষিত থেকে যায়। 

সাধারণ ব্যবসার ক্ষেত্রে যেমন দেশীয় ব্যবসা নীতি এবং বৈদেশিক ব্যবসা নীতি আলাদা রয়েছে। ই–কমার্সের ক্ষেত্রেও তা যুক্তিযুক্ত। আজ পর্যন্ত ক্রসবর্ডার ই–কমার্স পলিসি তৈরি হয়নি। তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং ই–ক্যাব (ই–কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ) আন্তসীমান্ত ই–বাণিজ্য নীতিমালা হিসেবে চূড়ান্ত রূপ দেওয়ার পথে রয়েছে। 

আরও উদাহরণ হলো, ‘ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা নির্দেশিকা ২০২১’ নিয়ে। এখানে যেসব নীতি রয়েছে তা অভ্যন্তরীণ ই–কমার্সের জন্য প্রযোজ্য এবং ক্রস বর্ডার ই–কমার্সের জন্য বাস্তবসম্মত নয়। কিন্তু এখানে বিষয়টি পরিষ্কার করা হয়নি বিধায়। এখানকার অগ্রিম গ্রহণের ১০ শতাংশের নীতি ক্রস–বর্ডার এবং ক্রস বর্ডার খাতের উপখাত ‘প্রিন্ট অন ডিমান্ড’–এর ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হচ্ছে। ফলে ক্রস বর্ডার ই–কমার্সের উদ্যোক্তারা তাঁদের ব্যবসার গতি হারাচ্ছে।

নীতি–কৌশল প্রণয়নের জন্য এই বিষয়গুলোর সমন্বয় জরুরি। রসদ বা লজিস্টিক পলিসির দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ হলো, দেশের প্রচলিত সাপ্লাইচেইনকে উন্নত করা, ডিজিটাইজ করা এবং এ সংক্রান্ত পরিবর্তনের জন্য কোনো রূপ ছন্দহীনতা তৈরি না হতে দেওয়া। 

অতীতে এ ধরনের নজির রয়েছে। ই–কমার্স খাতে বাসায় বাসায় পণ্য ডেলিভারি দেওয়ার জন্য করোনা মহামারির সময় থেকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সুযোগ ও সহযোগিতা অবারিত করেছে। কিন্তু দেখা গেল, সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) এখনো মোটর বাইকের পেছনে ডেলিভারি বাক্স যুক্ত করা কিংবা ডেলিভারি বাক্সযুক্ত মোটরসাইকেলের অনুমোদন দেয়নি। ফলে প্রতিনিয়ত মামলার ভয় আর পুলিশের দেওয়া মামলার খরচ—এমন আরও অদৃশ্য খরচ হিসাব করে রাস্তায় চলছে এই গাড়িগুলো। এতে একদিকে আইন অমান্য করছে কেউ, কেউ উপরি কামাইয়ের সুযোগ নিচ্ছে। আর উদ্যোক্তারা ডেলিভারি সেবায় অন্তত ১৫–২০ শতাংশ বাড়তি খরচ গুনছে। 

কখনো কখনো ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে কিছু অগ্রসর কর্মপরিকল্পনা এসব নীতিমালায় যুক্ত থাকে। এটা সার্বিকভাবে ইতিবাচক হলেও, এগুলো যখন অন্য কোনো আইন ও বিধির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয় তখন এর থেকে সুফল পাওয়া যায় না অথবা বেসরকারি খাত নানা সমস্যার মুখে পড়ে। 

২০০৬ সালের শ্রম আইনের  ৫৬ / (২) ধারায় বলা হয়েছে, ‘উপরিউক্ত বিধানের হানি না করিয়া, প্রত্যেক কর্মকক্ষে কর্মরত প্রত্যেক শ্রমিকের জন্য অন্ততঃ ৯.৫ কিউবিক মিটার পরিমাণ জায়গার ব্যবস্থা করিতে হইবে।’ এখানে দেখা যায় বর্তমানে ডিজিটাল ও বিস্তৃত কর্মক্ষেত্রের সঙ্গে এই বিধানটি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। 

প্রথমত ই–কমার্স ও লজিস্টিক সেক্টরে অনেকে বাসায় বসে সেবা দিয়ে থাকেন। বিশেষ করে সিস্টেম উন্নয়ন, কনটেন্ট ম্যানেজমেন্ট ও কলসেন্টার সেবা। এ ক্ষেত্রে শ্রমিকের সংখ্যানুপাতে অফিসে জায়গা রয়েছে কি না তা নিশ্চিত করার বাধ্যবাধকতা থাকা উচিত নয়। আবার ডেলিভারি সেবাদাতা ও কুরিয়ার কোম্পানির কর্মসস্থল মূলত রাস্তায় বা পিকিং সেন্টারে। তাঁরা সকালে পণ্য নিয়ে বের হয়ে যান, বিকেলে পেমেন্ট নিয়ে ফিরে আসেন। কেউ কেউ আবার অফিসেও আসেন না। মার্চেন্ট থেকে পণ্য নিয়ে যান, ডেলিভারির পর ব্যাংকে টাকা জমা দেন।

এ অবস্থায়, যে ডেলিভারি প্রতিষ্ঠানে ৫ হাজার ডেলিভারিম্যান কাজ করেন, সেটিকে যদি শ্রমিকের সংখ্যা অনুসারে অফিসের আকার দিতে হয় তাহলে সেটা বাস্তবসম্মত হবে না। এ ধরনের আইন ও বিধিগুলো ডিজিটাল বা ই–বিজনেসের ক্ষেত্রে শিথিল ও সংশোধন করা জরুরি। বিষয়টি যদি লজিস্টিক পলিসিতে যুক্ত থাকে তাহলে হয়তো সহজে কার্যকর হবে। 

কারণ বেসরকারি খাত থেকে বছরের পর বছর ধরনা দিয়েও একটি আইন সংশোধন করা খুব কঠিন হয়ে যায়। যার জ্বলন্ত উদাহরণ ট্রেড লাইসেন্স অ্যাক্ট ২০১৬। আইনটি পাস হওয়ার পর প্রায় ৩০০টি নতুন ব্যবসার প্রস্তাব এসেছে ২০২০ সাল পর্যন্ত। এর মধ্যে প্রায় ২০০টি নতুন ব্যবসা বা পেশা ট্রেড লাইসেন্স অ্যাক্টের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য একাধিক অংশীজন সভার পরও বিষয়টি ৭ বছরেও কার্যকর হয়নি। ই–কমার্সের মতো এরকম অনেক নতুন বৃত্তি রয়েছে যা অন্য কোনো ব্যবসার নামে চলছে। 

কোনো নীতি প্রণীত হলে সরকার এবং বেসরকারি খাতের সমন্বয়ে সেটি বাস্তবায়ন করা হয়। এ জন্য প্রতিবছর নীতিমালা মূল্যায়নও প্রয়োজন। অনেক ক্ষেত্রে এটা করা হয় না। আবার এটি করতে গেলে জটিলতা রয়েছে। বর্তমানে নীতি কৌশলের সঙ্গে অ্যাকশন প্ল্যান ও লক্ষ্যমাত্রা যুক্ত করে দেওয়া হয় যাতে এটি কার্যকর হয়। এই কৌশলটি বেশ কাজ করছে। এটিও অনেক নীতিমালার ক্ষেত্রে হয়নি। এ সংক্রান্ত প্রস্তাবে বেসরকারি খাত থেকে প্রস্তাব হলো, নীতিমালার সঙ্গে যেমন অ্যাকশন প্ল্যান যুক্ত থাকে এবং লক্ষ্যমাত্রা যেন মূল্যায়নযোগ্য হয়। তাতে প্রতিবছর এটি মূল্যায়নের ক্ষেত্রে কত শতাংশ অর্জিত হয়েছে তা নির্ণয় করা যায়। 

যেমন, যদি এমন একটি লক্ষ্যমাত্রা থাকে যে, ডেলিভারিম্যানদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে অথবা ট্রেড অ্যান্ড ফরোয়ার্ড এজেন্টদের একটি প্ল্যাটফর্মে যুক্ত করা হবে। তাহলে এতে যেন সংখ্যা, পরিমাণ ও পরিসীমা উল্লেখ থাকে। তাহলে বছর শেষে কত শতাংশ অর্জিত হয়েছে তা নির্ণয় করা যাবে। 

এই মুহূর্তে সবপক্ষের সমন্বয়ে একটি কার্যকর রসদ নীতিমালা বা লজিস্টিক পলিসি তৈরিতে সরকারের আন্তরিকতা প্রশ্নাতীত। তাহলে এখন শুধু খেয়াল করা উচিত, তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে যেন গুরুত্বপূর্ণ কোনো কিছু বাদ না পড়ে এবং খাতগুলোর সমন্বয় সাধিত হয়। যদিও পরবর্তীতে সংশোধনের সুযোগ রয়েছে। তথাপি কোনো কাজ প্রথমবারই যতটা সম্ভব ভালোভাবে করা উচিত। 

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই–ক্যাব)

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত