জাহীদ রেজা নূর
কিছু কিছু বিতর্ক তৈরি করা হয় সমসাময়িক বিষয় থেকে দৃষ্টি দূরে সরিয়ে রাখার জন্য। পুরো পাকিস্তান আমলেই রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে বিতর্ক জারি রাখা হয়েছিল। আমলাতন্ত্র আর সামরিক আমলাতন্ত্র মিলে পাকিস্তান নামক দেশটায় যে স্বৈরশাসন কায়েম করে রেখেছিল, সেদিকে যেন সচেতন মানুষের চোখ না যায়, সে অভিসন্ধি থেকেই রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে অযথা টানাহেঁচড়া করা হয়েছিল। অযথা ইসলামকে টেনে আনা হয়েছিল। তার ফল যে পাকিস্তানি শাসকদের অনুকূলে যায়নি, সেটা ইতিহাসই প্রমাণ করেছে। সে কথা তোলার আগে আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কথা বলা জরুরি।
বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে পাকিস্তান নিয়ে কিছু কথা বলা জরুরি। ১৯৩০ সালে এলাহাবাদ মুসলিম লীগের অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে আল্লামা ইকবাল বলেছিলেন, ‘আমি দেখতে চাই, পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু ও বেলুচিস্তান সম্মিলিত হয়ে একটি রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে।’ ১৯৩২ সালে চৌধুরী রহমত আলী নামে এক পাঞ্জাবি যুবক পাঞ্জাবের পি, আফগান (উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ)-এর এ, কাশ্মীরের কে, সিন্ধুর এস এবং বেলুচিস্তানের শেষটুকু নিয়ে স্তান—পাকিস্তান নামটি তৈরি করেন। এখানে বাংলা বলে কিছু ছিল না। আবারও বলছি, যে পাকিস্তান রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন আল্লামা ইকবাল, যে নামটি দিয়েছিলেন চৌধুরী রহমত আলী, সে রাষ্ট্রের মধ্যে বাংলা নামক দেশটির কোনো স্থান ছিল না। তারপরও বাংলা এসে পড়ল আলোচনায়।
ভুলে গেলে চলবে না, পাকিস্তান সৃষ্টির আন্দোলনে বাংলার মুসলিমদের ছিল অকুণ্ঠ সমর্থন। জিন্নাহর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা মুসলিম লীগ ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবে কী চেয়েছিল, সেটা না বুঝলে এই সমর্থনের কারণটি বোঝা যাবে না। লাহোর প্রস্তাবে ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম এবং পূর্বে মুসলিম অধ্যুষিত অংশ নিয়ে পৃথক দুটি রাষ্ট্রের কথা বলা হয়েছিল। অর্থাৎ ১৯৭১ সালে যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ নামে যে দেশটির জন্ম হয়েছে, লাহোর প্রস্তাবে স্থির থাকলে সেটি ১৯৪৭ সাল থেকেই অস্তিত্ব বজায় রাখতে পারত (অবশ্য লাহোর প্রস্তাবে এই রাষ্ট্রটি ছিল বাংলা ও আসাম সমন্বয়ে গঠিত)। সেই দেশটি গঠিত হলে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানিদের শোষণের গ্যাঁড়াকলে ২৩ বছর ধরে থাকতে হতো না।
কিন্তু ১৯৪৬ সালের দিল্লি প্রস্তাবে দুটি পৃথক রাষ্ট্রের জায়গায় একটি রাষ্ট্রের কথা যখন তোলা হয়, তখন বাংলার আবুল হাশিমই তার প্রতিবাদ করেছিলেন। ইতিহাসের প্রতি বিশ্বস্ত থাকলে আমাদের বলতে হবে, সে সময় আবুল হাশিমের বলা দুটি মুসলিম রাষ্ট্রের প্রসঙ্গ মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ উড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন এই কথা বলে যে ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের ‘স্টেট’টাই মুদ্রণ প্রমাদের মাধ্যমে ‘স্টেটস’ হয়ে গেছে। অর্থাৎ ভুলে একটা ‘এস’ যোগ হয়েছে। কথাটা যে সত্য নয়, তা-ও প্রমাণ করা হয়েছে সেখানেই। খসড়া প্রস্তাবটি এনে দেখা হয়েছে এবং বোঝা গেছে, পাকিস্তানের ঝান্ডা বরদার জিন্নাহ ঠিক বলেননি। প্রস্তাবে দুটি পৃথক রাষ্ট্রের কথাই বলা হয়েছিল।
গোঁজামিলের সেখানেই শুরু। জিন্নাহ তখন তড়িঘড়ি করে বলেছিলেন, স্বতন্ত্র আবাসভূমির জন্য একটি নিজস্ব সংবিধান প্রণয়নের উপযোগী স্বতন্ত্র গণপরিষদ স্থাপনের প্রস্তুতির জন্যই এই প্রস্তাব। অর্থাৎ এটি লাহোর প্রস্তাবের কোনো সংশোধন নয়। অর্থাৎ লাহোর প্রস্তাবে থাকা দুটি স্বতন্ত্র মুসলিম রাষ্ট্রকে এখানে চ্যালেঞ্জ করা হয়নি। আরও বড় কথা, লাহোর প্রস্তাব পরিবর্তনের কোনো আইনি ক্ষমতাও ছিল না ১৯৪৬ সালের দিল্লি লেজিসলেটার্স কনভেনশনের। কারণ, লাহোর প্রস্তাবটি ছিল ভারত মুসলিম লীগের বিশ্বাসের (ক্রিড) অংশ।
এই কথাটি মনে রেখেই পরবর্তী আলোচনায় প্রবেশ করতে হবে। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের জন্ম হলো। পূর্ব বাংলা হলো পাকিস্তানের একটি অংশ।
দুই অংশের মধ্যে দূরত্ব ছিল ১০০০ কিলোমিটারের বেশি। ধর্ম ছাড়া ইতিহাস, সংস্কৃতি, ভাষা কোনো কিছুতেই এই দূই এলাকার মধ্যে কোনো মিল ছিল না। ভাষা বিতর্ক চলছিল পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার আগে থেকেই। বাঙালির ভাষা আরবি, উর্দু না বাংলা হবে, তা নিয়ে হচ্ছিল বিতর্ক।
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘তোমরা কেবল ছাত্র নও, তোমরা বাঙালি। বাঙালি মুসলমান।’ এই কথার তাৎপর্য বোঝা কি খুব কঠিন?
ভারতভাগ নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পর ভাষার প্রশ্নটি বড় প্রশ্ন হয়ে ওঠে।
১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি করাচিতে গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনের প্রথম দিন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত দুটি সংশোধনী প্রস্তাব আনেন: ১. গণপরিষদের অন্তত একটি অধিবেশন ঢাকায় হোক। অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দু ও ইংরেজির সঙ্গে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকেও গণ্য করা হোক। মুসলিম লীগ এই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করে। খাজা নাজিমুদ্দিন বলেন, পূর্ব বাংলার অধিকাংশ মানুষই উর্দুর পক্ষে।
বাংলায় মুসলিম লীগের পতনের শুরুও হয়েছিল নাজিমুদ্দিনের এই মিথ্যাচারের মাধ্যমে। এর পরের ঘটনাগুলো সে সময়ের পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবরগুলোর দিকে দৃষ্টি দিলেই পাওয়া যাবে। ভাগ্যিস, সেগুলো এখনো পাওয়া যায়, নাহলে এগুলোকে কেউ কেউ মিথ্যে বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে পারত।
ভুলে গেলে চলবে না, রাষ্ট্রভাষা নিয়ে প্রশ্ন যখন উঠল, তখন তৎকালীন পূর্ব বাংলার মানুষ বুঝতে পেরেছিল, একটি জাতির জন্য ভাষা ও সংস্কৃতির প্রশ্নটি কতটা গুরুত্বপূর্ণ। অন্য অনেক বিষয় অমীমাংসিত থাকলে শুধু ধর্ম কোনো বন্ধন সৃষ্টি করতে পারে না।
পাকিস্তান গড়ার উদ্দেশ্য কী ছিল? তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া এ ব্যাপারে কী বলেছেন, তা জেনে আসা যায়। ‘পাকিস্তানি রাজনীতির বিশ বছর’ নামে প্রকাশিত বইয়ে তিনি বলেছেন, ‘বস্তুত লাহোর প্রস্তাবই ছিল উপমহাদেশের মুসলিম আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু বা অ্যাঙ্কর। এই প্রস্তাবভিত্তিক আন্দোলনকালে মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ করার কাজে ধর্মকে টানা হইলেও, সেই আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ছিল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা। আজ যাঁরা পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রশ্নকে সযত্নে পরিহার করিয়া শুধু ধর্মীয় বন্ধনকে সম্মুখে তুলিয়া ধরিতে চান, তারা অখণ্ড ভারতের মুসলিম আন্দোলনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকেই কেবল বিকৃত করিতেছেন না, বরং প্রকৃত সমস্যা এড়াইবার এবং শোষণ ও বৈষম্য অব্যাহত রাখার দুরভিসন্ধি আঁটিতেছেন। ধর্মই যদি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনে একমাত্র বন্ধন হয়, তাহা হইলে আরব জাহানে যেখানে শুধু ধর্মই নয়, ভাষাও অভিন্ন, সেখানে তেরটি পৃথক রাষ্ট্রের অস্তিত্ব থাকিতে পারিত না। আরব জাহানে শুধু তেরটি পৃথক রাষ্ট্রই নয়, তেরটি রাষ্ট্র পরস্পর-বিরোধীও বটে। এক ভাষাভাষী এবং একই ধর্মাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও স্বকীয়তা, জাতীয়তাবাদ এবং সমাজব্যবস্থার হেরফেরের জন্য এতগুলি পৃথক রাষ্ট্রের অস্তিত্ব রহিয়াছে। ...যাঁরা মানুষের মৌলিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রশ্নকে বাদ দিয়া শুধু ধর্মের উপর অনাবশ্যক গুরুত্ব প্রদান করিতে চান, তারা আদতে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৈষম্য-নীতির প্রশ্রয় দিবারই পক্ষপাতী।’
মানিক মিয়ার এই বিশ্লেষণের প্রয়োজনীয়তা ম্লান হয়নি। এই আঙ্গিকে প্রশ্নটি নিয়ে ভাবা দরকার। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অনেকেই আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস নিয়ে মনগড়া কথাবার্তা বলছেন। তাতে যেন নতুন প্রজন্ম বিভ্রান্ত না হয়, সে জন্য সত্যিকারের ইতিহাস তুলে ধরা দরকার। তথ্য-উপাত্ত থাকলে ইতিহাসকে বিভ্রান্ত করা সম্ভব নয়। এভাবেই ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ঘটনাগুলোও নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করতে হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সময়টিতে কীভাবে এই বাংলার জনমানুষের প্রতিনিধি হয়ে উঠলেন, সেটাও তথ্য-উপাত্ত দিয়েই প্রমাণ করা যায়। এ ক্ষেত্রে বামপন্থীদের বিভাজন ও বিভ্রান্তির কথাগুলোও তো প্রকাশ করতে হবে। ইসলামি দলগুলোর রাজনীতিরও বিশ্লেষণ হতে হবে। স্বাধিকার আন্দোলন পরিচালিত হয়েছে গণমানুষকে সঙ্গে করে নিয়ে। মূল ভাবনা ছিল, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা হাতে পেলে এই বাংলার মুক্তি আসবে। কিন্তু আক্ষেপ করতে হয় এই ভেবে যে স্বাধীনতার পর আজ পর্যন্ত সেই আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন হয়নি। কীভাবে তা বাস্তবায়িত হবে, সে পথ খোঁজাই সবচেয়ে জরুরি এখন।
২. শুরুতে যে কথা বলেছিলাম, তাতে ফিরে আসি। রবীন্দ্রনাথ-নজরুলবিষয়ক বিতর্ক আজকের নয়। দেশভাগের পর তা উচ্চকিত হয়ে উঠেছিল। এই দুই মহৎ কবির কেউই পরস্পরকে অশ্রদ্ধা করতেন না। রবীন্দ্রনাথের প্রতি নজরুলের ছিল অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা আর নজরুলের প্রতি রবীন্দ্রনাথের ছিল অবারিত স্নেহ। ইতিহাসের একই সময়ে দুজন বসবাস করলেও তাঁদের মধ্যে কোনো বৈরিতার কথা শোনা যায় না। বরং নজরুলের কারাগারজীবনের সময় রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বসন্ত’ নামের বইটি উৎসর্গ করেছেন নজরুলকে। রবীন্দ্রনাথ-নজরুলকে নিয়ে বিতর্ক করার একটা মূল কারণ হলো ধর্ম। তাই রবীন্দ্রনাথের পূর্ব পুরুষেরা এই বাংলার মানুষ হলেও এবং নজরুলের পূর্ব পুরুষদের বাস পশ্চিম বাংলায় হলেও ধর্মীয় কারণে নজরুলকে নিজের মানুষ আর রবীন্দ্রনাথকে পর ভাবা হয়। এর চেয়েও বড় কথা, সাহিত্যের স্বাদ আস্বাদনের চেয়ে কে ছোট, কে বড় সেই আলোচনায় যুক্ত হয় রাজনীতির জিলাপিতে আটকে যাওয়া ব্যক্তিরা।
রবীন্দ্রনাথকে ছোট করার জন্য যে ধরনের গল্প ফাঁদা হয়, তার অনেকগুলোই হাস্যকর। সেই বিভ্রান্তি নিয়েও আলোচনা হতে হবে। অর্থনীতিবিদ আকবর আলি খান সে রকম কিছু বিভ্রান্তির জবাব দিয়েছেন।
অন্যদিকে নজরুল হামদ-নাতের পাশাপাশি যে শ্যামাসংগীতগুলো লিখেছেন, সেগুলোও কালোত্তীর্ণ হয়েছে। যে তাঁকে যেভাবে নেবে, সেভাবেই নজরুলকে বিশ্লেষণ করা যাবে। তবে তাঁর রাজনৈতিক নিবন্ধগুলো পড়লে বোঝা যায়, ধর্ম নিয়ে বিভাজনের পক্ষপাতী তিনি ছিলেন না।
নতুন প্রজন্ম আমাদের প্রজন্মের চেয়ে অনেক বেশি বিচক্ষণ। তারাই ইতিহাসের শস্যক্ষেত্র থেকে ঠিক ফসল তুলে আনুক, সেটাই কাম্য।
লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
কিছু কিছু বিতর্ক তৈরি করা হয় সমসাময়িক বিষয় থেকে দৃষ্টি দূরে সরিয়ে রাখার জন্য। পুরো পাকিস্তান আমলেই রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে বিতর্ক জারি রাখা হয়েছিল। আমলাতন্ত্র আর সামরিক আমলাতন্ত্র মিলে পাকিস্তান নামক দেশটায় যে স্বৈরশাসন কায়েম করে রেখেছিল, সেদিকে যেন সচেতন মানুষের চোখ না যায়, সে অভিসন্ধি থেকেই রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে অযথা টানাহেঁচড়া করা হয়েছিল। অযথা ইসলামকে টেনে আনা হয়েছিল। তার ফল যে পাকিস্তানি শাসকদের অনুকূলে যায়নি, সেটা ইতিহাসই প্রমাণ করেছে। সে কথা তোলার আগে আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কথা বলা জরুরি।
বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে পাকিস্তান নিয়ে কিছু কথা বলা জরুরি। ১৯৩০ সালে এলাহাবাদ মুসলিম লীগের অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে আল্লামা ইকবাল বলেছিলেন, ‘আমি দেখতে চাই, পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু ও বেলুচিস্তান সম্মিলিত হয়ে একটি রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে।’ ১৯৩২ সালে চৌধুরী রহমত আলী নামে এক পাঞ্জাবি যুবক পাঞ্জাবের পি, আফগান (উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ)-এর এ, কাশ্মীরের কে, সিন্ধুর এস এবং বেলুচিস্তানের শেষটুকু নিয়ে স্তান—পাকিস্তান নামটি তৈরি করেন। এখানে বাংলা বলে কিছু ছিল না। আবারও বলছি, যে পাকিস্তান রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন আল্লামা ইকবাল, যে নামটি দিয়েছিলেন চৌধুরী রহমত আলী, সে রাষ্ট্রের মধ্যে বাংলা নামক দেশটির কোনো স্থান ছিল না। তারপরও বাংলা এসে পড়ল আলোচনায়।
ভুলে গেলে চলবে না, পাকিস্তান সৃষ্টির আন্দোলনে বাংলার মুসলিমদের ছিল অকুণ্ঠ সমর্থন। জিন্নাহর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা মুসলিম লীগ ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবে কী চেয়েছিল, সেটা না বুঝলে এই সমর্থনের কারণটি বোঝা যাবে না। লাহোর প্রস্তাবে ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম এবং পূর্বে মুসলিম অধ্যুষিত অংশ নিয়ে পৃথক দুটি রাষ্ট্রের কথা বলা হয়েছিল। অর্থাৎ ১৯৭১ সালে যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ নামে যে দেশটির জন্ম হয়েছে, লাহোর প্রস্তাবে স্থির থাকলে সেটি ১৯৪৭ সাল থেকেই অস্তিত্ব বজায় রাখতে পারত (অবশ্য লাহোর প্রস্তাবে এই রাষ্ট্রটি ছিল বাংলা ও আসাম সমন্বয়ে গঠিত)। সেই দেশটি গঠিত হলে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানিদের শোষণের গ্যাঁড়াকলে ২৩ বছর ধরে থাকতে হতো না।
কিন্তু ১৯৪৬ সালের দিল্লি প্রস্তাবে দুটি পৃথক রাষ্ট্রের জায়গায় একটি রাষ্ট্রের কথা যখন তোলা হয়, তখন বাংলার আবুল হাশিমই তার প্রতিবাদ করেছিলেন। ইতিহাসের প্রতি বিশ্বস্ত থাকলে আমাদের বলতে হবে, সে সময় আবুল হাশিমের বলা দুটি মুসলিম রাষ্ট্রের প্রসঙ্গ মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ উড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন এই কথা বলে যে ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের ‘স্টেট’টাই মুদ্রণ প্রমাদের মাধ্যমে ‘স্টেটস’ হয়ে গেছে। অর্থাৎ ভুলে একটা ‘এস’ যোগ হয়েছে। কথাটা যে সত্য নয়, তা-ও প্রমাণ করা হয়েছে সেখানেই। খসড়া প্রস্তাবটি এনে দেখা হয়েছে এবং বোঝা গেছে, পাকিস্তানের ঝান্ডা বরদার জিন্নাহ ঠিক বলেননি। প্রস্তাবে দুটি পৃথক রাষ্ট্রের কথাই বলা হয়েছিল।
গোঁজামিলের সেখানেই শুরু। জিন্নাহ তখন তড়িঘড়ি করে বলেছিলেন, স্বতন্ত্র আবাসভূমির জন্য একটি নিজস্ব সংবিধান প্রণয়নের উপযোগী স্বতন্ত্র গণপরিষদ স্থাপনের প্রস্তুতির জন্যই এই প্রস্তাব। অর্থাৎ এটি লাহোর প্রস্তাবের কোনো সংশোধন নয়। অর্থাৎ লাহোর প্রস্তাবে থাকা দুটি স্বতন্ত্র মুসলিম রাষ্ট্রকে এখানে চ্যালেঞ্জ করা হয়নি। আরও বড় কথা, লাহোর প্রস্তাব পরিবর্তনের কোনো আইনি ক্ষমতাও ছিল না ১৯৪৬ সালের দিল্লি লেজিসলেটার্স কনভেনশনের। কারণ, লাহোর প্রস্তাবটি ছিল ভারত মুসলিম লীগের বিশ্বাসের (ক্রিড) অংশ।
এই কথাটি মনে রেখেই পরবর্তী আলোচনায় প্রবেশ করতে হবে। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের জন্ম হলো। পূর্ব বাংলা হলো পাকিস্তানের একটি অংশ।
দুই অংশের মধ্যে দূরত্ব ছিল ১০০০ কিলোমিটারের বেশি। ধর্ম ছাড়া ইতিহাস, সংস্কৃতি, ভাষা কোনো কিছুতেই এই দূই এলাকার মধ্যে কোনো মিল ছিল না। ভাষা বিতর্ক চলছিল পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার আগে থেকেই। বাঙালির ভাষা আরবি, উর্দু না বাংলা হবে, তা নিয়ে হচ্ছিল বিতর্ক।
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘তোমরা কেবল ছাত্র নও, তোমরা বাঙালি। বাঙালি মুসলমান।’ এই কথার তাৎপর্য বোঝা কি খুব কঠিন?
ভারতভাগ নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পর ভাষার প্রশ্নটি বড় প্রশ্ন হয়ে ওঠে।
১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি করাচিতে গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনের প্রথম দিন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত দুটি সংশোধনী প্রস্তাব আনেন: ১. গণপরিষদের অন্তত একটি অধিবেশন ঢাকায় হোক। অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দু ও ইংরেজির সঙ্গে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকেও গণ্য করা হোক। মুসলিম লীগ এই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করে। খাজা নাজিমুদ্দিন বলেন, পূর্ব বাংলার অধিকাংশ মানুষই উর্দুর পক্ষে।
বাংলায় মুসলিম লীগের পতনের শুরুও হয়েছিল নাজিমুদ্দিনের এই মিথ্যাচারের মাধ্যমে। এর পরের ঘটনাগুলো সে সময়ের পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবরগুলোর দিকে দৃষ্টি দিলেই পাওয়া যাবে। ভাগ্যিস, সেগুলো এখনো পাওয়া যায়, নাহলে এগুলোকে কেউ কেউ মিথ্যে বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে পারত।
ভুলে গেলে চলবে না, রাষ্ট্রভাষা নিয়ে প্রশ্ন যখন উঠল, তখন তৎকালীন পূর্ব বাংলার মানুষ বুঝতে পেরেছিল, একটি জাতির জন্য ভাষা ও সংস্কৃতির প্রশ্নটি কতটা গুরুত্বপূর্ণ। অন্য অনেক বিষয় অমীমাংসিত থাকলে শুধু ধর্ম কোনো বন্ধন সৃষ্টি করতে পারে না।
পাকিস্তান গড়ার উদ্দেশ্য কী ছিল? তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া এ ব্যাপারে কী বলেছেন, তা জেনে আসা যায়। ‘পাকিস্তানি রাজনীতির বিশ বছর’ নামে প্রকাশিত বইয়ে তিনি বলেছেন, ‘বস্তুত লাহোর প্রস্তাবই ছিল উপমহাদেশের মুসলিম আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু বা অ্যাঙ্কর। এই প্রস্তাবভিত্তিক আন্দোলনকালে মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ করার কাজে ধর্মকে টানা হইলেও, সেই আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ছিল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা। আজ যাঁরা পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রশ্নকে সযত্নে পরিহার করিয়া শুধু ধর্মীয় বন্ধনকে সম্মুখে তুলিয়া ধরিতে চান, তারা অখণ্ড ভারতের মুসলিম আন্দোলনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকেই কেবল বিকৃত করিতেছেন না, বরং প্রকৃত সমস্যা এড়াইবার এবং শোষণ ও বৈষম্য অব্যাহত রাখার দুরভিসন্ধি আঁটিতেছেন। ধর্মই যদি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনে একমাত্র বন্ধন হয়, তাহা হইলে আরব জাহানে যেখানে শুধু ধর্মই নয়, ভাষাও অভিন্ন, সেখানে তেরটি পৃথক রাষ্ট্রের অস্তিত্ব থাকিতে পারিত না। আরব জাহানে শুধু তেরটি পৃথক রাষ্ট্রই নয়, তেরটি রাষ্ট্র পরস্পর-বিরোধীও বটে। এক ভাষাভাষী এবং একই ধর্মাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও স্বকীয়তা, জাতীয়তাবাদ এবং সমাজব্যবস্থার হেরফেরের জন্য এতগুলি পৃথক রাষ্ট্রের অস্তিত্ব রহিয়াছে। ...যাঁরা মানুষের মৌলিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রশ্নকে বাদ দিয়া শুধু ধর্মের উপর অনাবশ্যক গুরুত্ব প্রদান করিতে চান, তারা আদতে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৈষম্য-নীতির প্রশ্রয় দিবারই পক্ষপাতী।’
মানিক মিয়ার এই বিশ্লেষণের প্রয়োজনীয়তা ম্লান হয়নি। এই আঙ্গিকে প্রশ্নটি নিয়ে ভাবা দরকার। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অনেকেই আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস নিয়ে মনগড়া কথাবার্তা বলছেন। তাতে যেন নতুন প্রজন্ম বিভ্রান্ত না হয়, সে জন্য সত্যিকারের ইতিহাস তুলে ধরা দরকার। তথ্য-উপাত্ত থাকলে ইতিহাসকে বিভ্রান্ত করা সম্ভব নয়। এভাবেই ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ঘটনাগুলোও নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করতে হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সময়টিতে কীভাবে এই বাংলার জনমানুষের প্রতিনিধি হয়ে উঠলেন, সেটাও তথ্য-উপাত্ত দিয়েই প্রমাণ করা যায়। এ ক্ষেত্রে বামপন্থীদের বিভাজন ও বিভ্রান্তির কথাগুলোও তো প্রকাশ করতে হবে। ইসলামি দলগুলোর রাজনীতিরও বিশ্লেষণ হতে হবে। স্বাধিকার আন্দোলন পরিচালিত হয়েছে গণমানুষকে সঙ্গে করে নিয়ে। মূল ভাবনা ছিল, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা হাতে পেলে এই বাংলার মুক্তি আসবে। কিন্তু আক্ষেপ করতে হয় এই ভেবে যে স্বাধীনতার পর আজ পর্যন্ত সেই আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন হয়নি। কীভাবে তা বাস্তবায়িত হবে, সে পথ খোঁজাই সবচেয়ে জরুরি এখন।
২. শুরুতে যে কথা বলেছিলাম, তাতে ফিরে আসি। রবীন্দ্রনাথ-নজরুলবিষয়ক বিতর্ক আজকের নয়। দেশভাগের পর তা উচ্চকিত হয়ে উঠেছিল। এই দুই মহৎ কবির কেউই পরস্পরকে অশ্রদ্ধা করতেন না। রবীন্দ্রনাথের প্রতি নজরুলের ছিল অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা আর নজরুলের প্রতি রবীন্দ্রনাথের ছিল অবারিত স্নেহ। ইতিহাসের একই সময়ে দুজন বসবাস করলেও তাঁদের মধ্যে কোনো বৈরিতার কথা শোনা যায় না। বরং নজরুলের কারাগারজীবনের সময় রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বসন্ত’ নামের বইটি উৎসর্গ করেছেন নজরুলকে। রবীন্দ্রনাথ-নজরুলকে নিয়ে বিতর্ক করার একটা মূল কারণ হলো ধর্ম। তাই রবীন্দ্রনাথের পূর্ব পুরুষেরা এই বাংলার মানুষ হলেও এবং নজরুলের পূর্ব পুরুষদের বাস পশ্চিম বাংলায় হলেও ধর্মীয় কারণে নজরুলকে নিজের মানুষ আর রবীন্দ্রনাথকে পর ভাবা হয়। এর চেয়েও বড় কথা, সাহিত্যের স্বাদ আস্বাদনের চেয়ে কে ছোট, কে বড় সেই আলোচনায় যুক্ত হয় রাজনীতির জিলাপিতে আটকে যাওয়া ব্যক্তিরা।
রবীন্দ্রনাথকে ছোট করার জন্য যে ধরনের গল্প ফাঁদা হয়, তার অনেকগুলোই হাস্যকর। সেই বিভ্রান্তি নিয়েও আলোচনা হতে হবে। অর্থনীতিবিদ আকবর আলি খান সে রকম কিছু বিভ্রান্তির জবাব দিয়েছেন।
অন্যদিকে নজরুল হামদ-নাতের পাশাপাশি যে শ্যামাসংগীতগুলো লিখেছেন, সেগুলোও কালোত্তীর্ণ হয়েছে। যে তাঁকে যেভাবে নেবে, সেভাবেই নজরুলকে বিশ্লেষণ করা যাবে। তবে তাঁর রাজনৈতিক নিবন্ধগুলো পড়লে বোঝা যায়, ধর্ম নিয়ে বিভাজনের পক্ষপাতী তিনি ছিলেন না।
নতুন প্রজন্ম আমাদের প্রজন্মের চেয়ে অনেক বেশি বিচক্ষণ। তারাই ইতিহাসের শস্যক্ষেত্র থেকে ঠিক ফসল তুলে আনুক, সেটাই কাম্য।
লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে নীতিনির্ধারণী একটি বিষয় অগ্রাধিকার বিবেচনার জন্য অপেক্ষমাণ আছে, আর তা হলো, রাষ্ট্রীয় কাঠামোর পরিবর্তন করা, নাকি যথাশিগগির নির্বাচন আয়োজন করা? অনেক ধরনের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর পরিবর্তনের জন্য জাতীয় সংসদের বিকল্প কিছু আছে বলে মনে হয় না।
৩ ঘণ্টা আগেএকটি কলা। হ্যাঁ, ঠিকই পড়ছেন। একটি সাধারণ কলা, যা নিলামে বিক্রি হলো ৭৪ কোটি টাকায়। এটি শিল্প, না কৌতুক, না সামাজিক শ্লেষ—নাকি তিনটির মিশেল? ইতালীয় শিল্পী মরিজিও ক্যাটালানের এই ‘কমেডিয়ান’ আমাদের শিল্পের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি আর বাজারজাত সৃজনশীলতার প্রশ্ন নিয়ে ভাবতে বাধ্য করে।
৩ ঘণ্টা আগে‘গণতন্ত্র মঞ্চ’র অন্যতম নেতা সাইফুল হক বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ছাত্রজীবনে তিনি ছাত্র ঐক্য ফোরামের নেতা ছিলেন। তিনি পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লেখেন। এখন পর্যন্ত ২০টি বই লিখেছেন। অন্তর্বর্তী সরকার এবং দেশের রাজনীতি নিয়ে...
১ দিন আগেসদ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে কি না, তা নিয়ে নানা মাত্রিক আলোচনার মধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস আলম নিজের ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন: ‘গণহত্যার বিচারের আগে আওয়ামী লীগকে কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেব না। প্রয়োজনে দ্বিতীয় অভ্যুত্থান হবে।’
১ দিন আগে