শব্দের আড়ালে গল্প: ময়নাতদন্ত

রাজীব কুমার সাহা
প্রকাশ : ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৭: ৫৩
রাজীব কুমার সাহা

বাংলা ভাষায় অতিপরিচিত একটি শব্দ হলো ময়নাতদন্ত। বিশেষ করে চিকিৎসা-আইন-আদালতের পরিভাষায় কমবেশি আমরা সবাই শব্দটির প্রয়োগ দেখতে পাই। আমরা ময়নাতদন্তের ইংরেজি পোস্টমর্টেম শব্দটির সঙ্গেও পরিচিত। কিন্তু ময়নাতদন্ত মানে কী? কোনো বিষয়ের তদন্তের সঙ্গে ময়না পাখির সম্পর্ক কী? তবে কি প্রশিক্ষিত ময়না পাখি দিয়ে তদন্ত করানোকে ময়নাতদন্ত বলে? বাংলা ভাষায় ময়নাতদন্ত শব্দটি কীভাবে প্রবেশ করল? তবে চলুন আজ জানব ময়নাতদন্তের আদ্যোপান্ত।

আরবি ‘ময়না’ এবং সংস্কৃত ‘তদন্ত’ শব্দ সহযোগে গঠিত হয়েছে ময়নাতদন্ত শব্দটি। এটি বিশেষ্য পদ। আর সংস্কৃত তদন্ত শব্দের অর্থ হলো কোনো বিষয়ে অনুসন্ধান করে সত্য নিরূপণ। আভিধানিকভাবে ময়নাতদন্ত শব্দের অর্থ হলো অস্বাভাবিক বা আকস্মিক মৃত্যুর কারণ উদ্ঘাটনের উদ্দেশ্যে শবব্যবচ্ছেদ। অর্থাৎ ময়নাতদন্তের মাধ্যমে অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় মৃতদেহ বিশ্লেষণ করে মৃত্যুর কারণ জানার চেষ্টা করা হয়। এটিকে ইংরেজিতে বলা হয় পোস্টমর্টেম। পোস্টমর্টেম শব্দটিকে একই সঙ্গে অটোপসি বা নিক্রোপসি প্রভৃতি দ্বারাও বোঝানো হয়ে থাকে।

বাংলা ভাষায় ময়না শব্দের তিনটি অর্থ রয়েছে। প্রথমত দেশি ‘ময়না’ শব্দের অর্থ হলো কীটপতঙ্গভুক কালো পালকাবৃত শালিকজাতীয় পাখি। ময়নার এই অর্থটি আমরা প্রায় সবাই জানি। কিন্তু এর সঙ্গে ময়নাতদন্তের কোনো সম্পর্ক নেই। দ্বিতীয়ত সংস্কৃত ‘মদনসারিকা’ থেকে আগত বাংলা ‘ময়না’ শব্দের অর্থ হলো বাংলা লোকসংগীতের রাজা মানিকচন্দ্রের জাদুবিদ্যায় পারদর্শী পত্নী। এই অর্থটিকেই আবার আলংকারিক রূপে ডাকিনি বা খল স্বভাবের নারীর অর্থরূপেও প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। সবশেষ আরবি ‘মু’আইনা’ শব্দ থেকে আগত ‘ময়না’ শব্দের অর্থ হলো অনুসন্ধান বা অনুসন্ধেয় বিষয়। ময়নাতদন্তের ময়না আরবি ‘মু’আইনা’ শব্দ থেকেই জাত। এর অর্থ হলো প্রত্যক্ষরূপে, চোখের সামনে বা পরিষ্কারভাবে। সুতরাং দেখা যায়, ময়নাতদন্ত শব্দের ময়না দেশি বা সংস্কৃত শব্দ নয়। এটি আরবি থেকে জাত শব্দ। আরবি ‘মু’আইনা’ থেকে বাংলায় ‘ময়না’ হলেও শব্দটি তার অন্তর্নিহিত অর্থ বিসর্জন দেয়নি। বাগর্থতত্ত্বের বিচারে দেখা যায় শব্দটির মূল অর্থ এখানে সংকুচিত না হয়ে বরং প্রসারিতই হয়েছে।

প্রাসঙ্গিকভাবে আমরা এখানে আরেকটি শব্দের অবতারণা করতে পারি, সেটি হলো সুরতহাল। অনেকেই পোস্টমর্টেম বা ময়নাতদন্ত এবং সুরতহালকে একই অর্থে বিবেচনা করেন। কিন্তু সেটি ভুল। ময়নাতদন্ত এবং সুরতহাল প্রতিবেদনের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। সুরতহাল অর্থ হলো তদন্তের উদ্দেশ্যে কোনো ঘটনা বা অকুস্থলের চাক্ষুষ বিবরণ; আদালতের এজাহার। আরেকটু স্পষ্ট করে বললে সুরতহাল রিপোর্ট হলো লাশের বাহ্যিক আলামত যা প্রস্তুত করে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা। অপরদিকে ময়নাতদন্ত রিপোর্ট তৈরি করেন একজন চিকিৎসক। যিনি মৃত ব্যক্তির অঙ্গপ্রত্যঙ্গ থেকে আলামত সংগ্রহ করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন।

ময়নাতদন্তের কয়েকটি ভাগ রয়েছে, যেমন: মেডিকেল, একাডেমিক এবং ক্লিনিক্যাল। অস্বাভাবিক মৃত্যুর কারণ জানতে মেডিকেল, চিকিৎসাশাস্ত্রে পড়াশোনার জন্য একাডেমিক এবং কোনো ব্যক্তির অসুস্থতাজনিত মৃত্যু নিয়ে সন্দেহ হলে ক্লিনিক্যাল ময়নাতদন্ত করতে হয়। ময়নাতদন্তে অঙ্গভিত্তিক কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করা হয়, যেমন: মস্তিষ্ক, হার্ট, লিভার, কিডনি, ফুসফুস প্রভৃতি। এ ছাড়া হিস্টোপ্যাথলজি, টক্সিকোলজি, মাইক্রোবায়োলজি, রেডিয়োলজি প্রভৃতি পরীক্ষা সম্পন্ন করতে হয়। ময়নাতদন্ত রিপোর্ট পেতে সর্বনিম্ন দুই থেকে তিন দিন এবং সর্বোচ্চ দুই থেকে তিন মাস পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হওয়ার পর পরীক্ষা করে পাওয়া নথির ভিত্তিতে পূর্ণাঙ্গ ময়নাতদন্ত রিপোর্ট প্রস্তুত করা হয়। সেই সঙ্গে মৃত্যুর কারণ এবং পদ্ধতিসহ একটি মৃত্যুসনদ প্রদান করা হয়।

সন্দেহজনক মৃত্যুর প্রকৃত কারণ উদ্ঘাটনে ময়নাতদন্ত করা অত্যাবশ্যকীয় কাজ। তবে অনেক সময় সুরতহাল রিপোর্টেও কোনো ব্যক্তির মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু প্রকৃত মৃত্যুর কারণ জানতে অপেক্ষা করতে হবে চিকিৎসক-প্রদত্ত পোস্টমর্টেম বা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের জন্য।

লেখক: রাজীব কুমার সাহা

আভিধানিক ও প্রাবন্ধিক

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত