সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
প্রতিটি নতুন বছরের আগমনে প্রত্যাশা আর স্বপ্ন পূরণে আমরা উজ্জীবিত হয়ে উঠি। বাস্তবে আমাদের প্রত্যাশা পূরণ আর হয় না, অধরাই থেকে যায়। স্বপ্নগুলো দুঃস্বপ্নে নিক্ষিপ্ত হয়। এবারও যে তার ব্যতিক্রম ঘটবে না, সেটাও সার্বিক বিবেচনায় অনায়াসে বলা যায়। দেশের সার্বিক অবস্থাদৃষ্টে তা স্বীকার করতেই হবে।
প্রাপ্তির তুলনায় প্রত্যাশায় ব্যাপারটি সব সময়ই বড় থাকে। প্রত্যাশার তুলনা দিয়েই প্রাপ্তির বিচার ঘটে এবং দেখা যায় দুয়ের ভেতর ফাঁক রয়েছে। আর ওই যে ব্যবধান সেটাই কারণ হয় অসন্তোষের, নইলে মানুষ সচল থাকত না, সন্তুষ্টচিত্তে অচল হয়ে বসে পড়ত। থেমে যেত অগ্রগতি। বাংলাদেশের যে মুক্তিযুদ্ধ সে ক্ষেত্রেও প্রত্যাশাটা ছিল অনেক বড় এবং সেটা এক ধাপেই বড় হয়ে ওঠেনি, ধাপে ধাপে বৃদ্ধি পেয়েছে।
গণতন্ত্রের জন্য প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকার তো নিতান্তই স্বাভাবিক দাবি। ব্রিটিশ সরকার এটা দেয়নি, কিন্তু তারা তো ছিল দখলদার শক্তি। দেখা গেল পাকিস্তান সরকারও ওই ভোটাধিকার মানতে প্রস্তুত নয়। ১৯৫৪ সালে পূর্ববঙ্গে প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটে যে নির্বাচন হয়, তাতে মুসলিম লীগের যে দুর্দশা ঘটে, তাতেই শাসকেরা বুঝে ফেলে যে সর্বজনীন ভোটাধিকার দিলে সারা পাকিস্তানেও তাদের একই দশা ঘটবে। তার প্রধান কারণ পূর্ববঙ্গ তো বিপক্ষে যাবেই, পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাববিরোধী প্রদেশগুলোও যে পক্ষে থাকবে, এমন নিশ্চয়তা নেই। তাই প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচন দিতে তারা প্রস্তুত ছিল না। কিন্তু উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের পর ওই শাসকদের পক্ষে প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের দাবি মেনে না নিলে পূর্ববঙ্গে তো বটেই, পশ্চিম পাকিস্তানেও মানুষকে শান্ত করার উপায় ছিল না। ইয়াহিয়া খান তাই ওই দাবি মেনে নিয়েছিলেন। যত লোক তত ভোট—এই দাবি মেনে নিলে পূর্ব পাকিস্তানের আসনসংখ্যা যে বৃদ্ধি পাবে এবং তার ফলে শতকরা ৫৬ জন পাকিস্তানি নাগরিকের বাসভূমি পূর্ববঙ্গ পশ্চিম পাকিস্তানের ওপর কর্তৃত্ব করবে—এই আশঙ্কাটা তাদের জন্য অবশ্যই আতঙ্কের জ্বলন্ত কারণ ছিল। তবু নিতান্ত নিরুপায় হয়ে এবং এই আশা নিয়ে যে পূর্ববঙ্গে ভোট ভাগাভাগি হয়ে যাবে, তারা প্রাপ্তবয়স্কদের মাথাপিছু ভোটের দাবি মেনে নিয়েছিল।
পূর্ববঙ্গবাসীরা পাকিস্তানে থাকতেই চায়নি, বরং ওই রাষ্ট্রের সামরিক বেষ্টনী থেকে বের হয়ে আসতে চেয়েছে, ৬ দফাকে তারা স্বাধীনতার এক দফায় পরিণত করতে চেয়েছিল, যে জন্য সব ভোট তারা ছয় দফার বাক্সেই ফেলেছে এদিক-ওদিক না তাকিয়ে। সামরিক বাহিনীর লোকেরা অবশ্য চেষ্টা করছিল ইসলামপসন্দ মার্কাদের জিতিয়ে আনতে, এ জন্য তারা অর্থ সরবরাহ করা থেকেও বিরত থাকেনি। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি, রায় বেরিয়ে এসেছে ৬ দফার পক্ষে। এমনভাবে বেরিয়ে এল যে বোঝা গেল লোকে স্বায়ত্তশাসন নয়, স্বাধীনতাই চায় এবং আওয়ামী লীগের পক্ষে এই গণরায়কে অমান্য করার কোনো উপায়ই ছিল না।
৯ মাসের যুদ্ধে আমরা জয়ী হলাম। রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বাধীনতা পাওয়া গেল। আধুনিককালের ইতিহাসে বাঙালি এই প্রথম একটি নিজস্ব রাষ্ট্র স্থাপন করল, যার রাষ্ট্রভাষা হলো বাংলা। দেশ-বিদেশে বাংলাদেশের নাম ছড়িয়ে পড়ল। যুদ্ধ করে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ঘটেছে, তাই বাঙালির সম্মান তখন অসাধারণ উচ্চতায় পৌঁছেছে। কেবল বাংলাদেশের মানুষ বলে নয়, পৃথিবীর যে দেশে যত বাঙালি আছে সবাই পূর্ববঙ্গের এ অসামান্য অর্জনে গৌরববোধের সুযোগ পেয়েছে। পাকিস্তানি নয়, ভারতীয়ও নয়, বাঙালি নিজেকে বাঙালি বলেই পরিচয় দেওয়ার অধিকার অর্জন করেছে।
সব পুঁজিবাদী ও মুসলিম বিশ্বের সমর্থনপুষ্ট এবং অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে বাংলার মাটিতে গেরিলা আক্রমণের দ্বারা বিপর্যস্ত এবং আত্মসমর্পণে বাধ্য করার যে মনস্তাত্ত্বিক তাৎপর্য, সেটাও সামান্য নয়। এর মধ্য দিয়ে আমাদের আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদার বোধ দুটিই বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরাও যে পারি, এটা বুঝিয়ে দিতে পেরেছি এবং আমাদের আঘাত করলে প্রত্যাঘাত যে প্রাপ্য হবে, এটাও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। মতাদর্শিকভাবে পাকিস্তানি ধ্যানধারণা অর্থাৎ তথাকথিত দ্বিজাতিতত্ত্ব এবং ইসলামি রাষ্ট্রের ধারণা প্রত্যাখ্যাত ও পরাভূত হয়েছে। এমনটা তারা আশা করেনি। এ তো কেবল রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনীর পরাজয় নয়, এ হচ্ছে রাষ্ট্রের যে ভিত্তি, সেটাই নাকচ হয়ে যাওয়া। পাকিস্তান অবশ্য কোনো মতাদর্শের জোরে টিকে ছিল না, তার টিকে থাকার ভিত্তিটা মূলত ছিল সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্রের ক্ষমতা এবং পুঁজিবাদী বিশ্বের সমর্থন।
স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে বাঙালির পক্ষে বাঙালি পরিচয় নিয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার। সুযোগ এসেছে মাতৃভাষাকে শিক্ষা, প্রশাসনিক কাজকর্ম ও আদালতের ভাষা হিসেবে কার্যকর করার। বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ যে পূর্ববঙ্গেই নিহিত, এটা সত্য হয়ে উঠেছে। আগামী দিনে ঢাকাই হবে বাংলা সাহিত্যের রাজধানী—এমন কথাও উঠেছে এবং এটি যে কোনো অমূলক ধারণা, তা-ও নয়। কিন্তু এসবই হলো প্রত্যাশার রেখাবয়ব। আসল প্রত্যাশা ছিল ভেতরে।
সংবিধানে এখন ধর্মনিরপেক্ষতা নেই, সমাজতন্ত্রের স্বপ্নকে বিতাড়িত করা হয়েছে। শিক্ষার ধারা একটি নয়, তিনটি এবং কারও সাধ্য নেই যে তিন ধারাকে এক করবে। কেননা, ধারা তিনটি দাঁড়িয়ে আছে শ্রেণিবিভাজনের ওপর ভর করে এবং শ্রেণিদূরত্ব মোটেই কমছে না, বরং বাড়ছে এবং তিন ধারার শিক্ষা ওই দূরত্বকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। শিক্ষা সামাজিক ঐক্য আনবে কি, বরং উল্টো কাজ করে চলেছে। মাতৃভাষার চর্চা যেমন হওয়া উচিত ছিল সেভাবে হয়নি; উচ্চশিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা প্রচলনের যে চ্যালেঞ্জ ছিল সেটাকে ঠিকমতো গ্রহণই করা হয়নি, বাকিটা তো পরের কথা। উচ্চ আদালতের কার্যক্রম কবে বাংলায় চালু হবে বা আদৌ হবে কি না, সেটা কেউ বলতে পারে না। পুঁজিবাদী মূল্যবোধ মানুষকে পরস্পরবিচ্ছিন্ন, সমাজবিমুখ ও ভোগবাদী করে তুলেছে। প্রত্যাশা থেকে এই প্রাপ্তিটা যে কত দূরে তা বুঝিয়ে বলাটা প্রায় অসম্ভব বৈকি।
একটি নতুন এবং বড় মাপের বিপদ তো ইতিমধ্যে এসে জুটেছে। সেটা হলো জলবায়ু পরিবর্তন। এই পরিবর্তন অনেক দেশকেই আঘাত করবে, ইতিমধ্যে আঘাত শুরু হয়েও গেছে বৈকি; কিন্তু বাংলাদেশের দুর্ভোগটাই হবে সবচেয়ে কঠিন বলে ধারণা। কেননা, আমাদের দেশ অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ ও দরিদ্র, তদুপরি এটি একটি বদ্বীপ। ফলে প্লাবন, খরা, ঝড় ও জলোচ্ছ্বাস যা কিছুই আমাদের আঘাত করছে, তা-ই আমাদের পক্ষে সহ্য করা কঠিন হবে। এখনই হচ্ছে। আর দেশের একাংশ যদি সমুদ্রের নিচে চলে যায় তবে অবস্থা যে কী দাঁড়াবে, তা কল্পনা করাও কঠিন।
বাংলাদেশের নিজস্ব কণ্ঠ আছে, সেই কণ্ঠে এই বিপদের কথাটা অত্যন্ত প্রবলভাবে ধ্বনিত হওয়া আবশ্যক। বাংলাদেশের কণ্ঠস্বর বিশ্বে শোনা যাবে এবং সেই কণ্ঠে নিপীড়িত বিশ্বের বাণী ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হবে। এ-ও ছিল প্রত্যাশার অংশ। দোষটা আমাদের নয়, দোষ করেছে পুঁজিবাদী বিশ্ব, ভুক্তভোগী হচ্ছি আমরা। পুঁজিবাদী বিশ্বকে তাই অভিযুক্ত করা চাই, তাদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করতে হবে; কিন্তু আরও বড় কাজ যেটা সেটা হলো, পুঁজিবাদকে প্রতিহত করা দরকার, যাতে তারা মানুষের ভবিষ্যৎকে এভাবে বিপন্ন করে তুলতে না পারে। কাজটা চলছে। আন্তর্জাতিক প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে, তাতে আমরা যোগ দেব—প্রত্যাশা এটাও। কিন্তু প্রত্যাশাগুলো পূরণ হবে না, যদি দেশপ্রেমিক ও গণতান্ত্রিক মানুষ এগিয়ে না আসেন এবং জনগণের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আন্দোলন গড়ে না তোলেন, যেমনটা তাঁরা অতীতে করেছিলেন এবং করেছিলেন বলেই মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন সম্ভব হয়েছিল।
লেখক: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
প্রতিটি নতুন বছরের আগমনে প্রত্যাশা আর স্বপ্ন পূরণে আমরা উজ্জীবিত হয়ে উঠি। বাস্তবে আমাদের প্রত্যাশা পূরণ আর হয় না, অধরাই থেকে যায়। স্বপ্নগুলো দুঃস্বপ্নে নিক্ষিপ্ত হয়। এবারও যে তার ব্যতিক্রম ঘটবে না, সেটাও সার্বিক বিবেচনায় অনায়াসে বলা যায়। দেশের সার্বিক অবস্থাদৃষ্টে তা স্বীকার করতেই হবে।
প্রাপ্তির তুলনায় প্রত্যাশায় ব্যাপারটি সব সময়ই বড় থাকে। প্রত্যাশার তুলনা দিয়েই প্রাপ্তির বিচার ঘটে এবং দেখা যায় দুয়ের ভেতর ফাঁক রয়েছে। আর ওই যে ব্যবধান সেটাই কারণ হয় অসন্তোষের, নইলে মানুষ সচল থাকত না, সন্তুষ্টচিত্তে অচল হয়ে বসে পড়ত। থেমে যেত অগ্রগতি। বাংলাদেশের যে মুক্তিযুদ্ধ সে ক্ষেত্রেও প্রত্যাশাটা ছিল অনেক বড় এবং সেটা এক ধাপেই বড় হয়ে ওঠেনি, ধাপে ধাপে বৃদ্ধি পেয়েছে।
গণতন্ত্রের জন্য প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকার তো নিতান্তই স্বাভাবিক দাবি। ব্রিটিশ সরকার এটা দেয়নি, কিন্তু তারা তো ছিল দখলদার শক্তি। দেখা গেল পাকিস্তান সরকারও ওই ভোটাধিকার মানতে প্রস্তুত নয়। ১৯৫৪ সালে পূর্ববঙ্গে প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটে যে নির্বাচন হয়, তাতে মুসলিম লীগের যে দুর্দশা ঘটে, তাতেই শাসকেরা বুঝে ফেলে যে সর্বজনীন ভোটাধিকার দিলে সারা পাকিস্তানেও তাদের একই দশা ঘটবে। তার প্রধান কারণ পূর্ববঙ্গ তো বিপক্ষে যাবেই, পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাববিরোধী প্রদেশগুলোও যে পক্ষে থাকবে, এমন নিশ্চয়তা নেই। তাই প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচন দিতে তারা প্রস্তুত ছিল না। কিন্তু উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের পর ওই শাসকদের পক্ষে প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের দাবি মেনে না নিলে পূর্ববঙ্গে তো বটেই, পশ্চিম পাকিস্তানেও মানুষকে শান্ত করার উপায় ছিল না। ইয়াহিয়া খান তাই ওই দাবি মেনে নিয়েছিলেন। যত লোক তত ভোট—এই দাবি মেনে নিলে পূর্ব পাকিস্তানের আসনসংখ্যা যে বৃদ্ধি পাবে এবং তার ফলে শতকরা ৫৬ জন পাকিস্তানি নাগরিকের বাসভূমি পূর্ববঙ্গ পশ্চিম পাকিস্তানের ওপর কর্তৃত্ব করবে—এই আশঙ্কাটা তাদের জন্য অবশ্যই আতঙ্কের জ্বলন্ত কারণ ছিল। তবু নিতান্ত নিরুপায় হয়ে এবং এই আশা নিয়ে যে পূর্ববঙ্গে ভোট ভাগাভাগি হয়ে যাবে, তারা প্রাপ্তবয়স্কদের মাথাপিছু ভোটের দাবি মেনে নিয়েছিল।
পূর্ববঙ্গবাসীরা পাকিস্তানে থাকতেই চায়নি, বরং ওই রাষ্ট্রের সামরিক বেষ্টনী থেকে বের হয়ে আসতে চেয়েছে, ৬ দফাকে তারা স্বাধীনতার এক দফায় পরিণত করতে চেয়েছিল, যে জন্য সব ভোট তারা ছয় দফার বাক্সেই ফেলেছে এদিক-ওদিক না তাকিয়ে। সামরিক বাহিনীর লোকেরা অবশ্য চেষ্টা করছিল ইসলামপসন্দ মার্কাদের জিতিয়ে আনতে, এ জন্য তারা অর্থ সরবরাহ করা থেকেও বিরত থাকেনি। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি, রায় বেরিয়ে এসেছে ৬ দফার পক্ষে। এমনভাবে বেরিয়ে এল যে বোঝা গেল লোকে স্বায়ত্তশাসন নয়, স্বাধীনতাই চায় এবং আওয়ামী লীগের পক্ষে এই গণরায়কে অমান্য করার কোনো উপায়ই ছিল না।
৯ মাসের যুদ্ধে আমরা জয়ী হলাম। রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বাধীনতা পাওয়া গেল। আধুনিককালের ইতিহাসে বাঙালি এই প্রথম একটি নিজস্ব রাষ্ট্র স্থাপন করল, যার রাষ্ট্রভাষা হলো বাংলা। দেশ-বিদেশে বাংলাদেশের নাম ছড়িয়ে পড়ল। যুদ্ধ করে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ঘটেছে, তাই বাঙালির সম্মান তখন অসাধারণ উচ্চতায় পৌঁছেছে। কেবল বাংলাদেশের মানুষ বলে নয়, পৃথিবীর যে দেশে যত বাঙালি আছে সবাই পূর্ববঙ্গের এ অসামান্য অর্জনে গৌরববোধের সুযোগ পেয়েছে। পাকিস্তানি নয়, ভারতীয়ও নয়, বাঙালি নিজেকে বাঙালি বলেই পরিচয় দেওয়ার অধিকার অর্জন করেছে।
সব পুঁজিবাদী ও মুসলিম বিশ্বের সমর্থনপুষ্ট এবং অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে বাংলার মাটিতে গেরিলা আক্রমণের দ্বারা বিপর্যস্ত এবং আত্মসমর্পণে বাধ্য করার যে মনস্তাত্ত্বিক তাৎপর্য, সেটাও সামান্য নয়। এর মধ্য দিয়ে আমাদের আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদার বোধ দুটিই বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরাও যে পারি, এটা বুঝিয়ে দিতে পেরেছি এবং আমাদের আঘাত করলে প্রত্যাঘাত যে প্রাপ্য হবে, এটাও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। মতাদর্শিকভাবে পাকিস্তানি ধ্যানধারণা অর্থাৎ তথাকথিত দ্বিজাতিতত্ত্ব এবং ইসলামি রাষ্ট্রের ধারণা প্রত্যাখ্যাত ও পরাভূত হয়েছে। এমনটা তারা আশা করেনি। এ তো কেবল রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনীর পরাজয় নয়, এ হচ্ছে রাষ্ট্রের যে ভিত্তি, সেটাই নাকচ হয়ে যাওয়া। পাকিস্তান অবশ্য কোনো মতাদর্শের জোরে টিকে ছিল না, তার টিকে থাকার ভিত্তিটা মূলত ছিল সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্রের ক্ষমতা এবং পুঁজিবাদী বিশ্বের সমর্থন।
স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে বাঙালির পক্ষে বাঙালি পরিচয় নিয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার। সুযোগ এসেছে মাতৃভাষাকে শিক্ষা, প্রশাসনিক কাজকর্ম ও আদালতের ভাষা হিসেবে কার্যকর করার। বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ যে পূর্ববঙ্গেই নিহিত, এটা সত্য হয়ে উঠেছে। আগামী দিনে ঢাকাই হবে বাংলা সাহিত্যের রাজধানী—এমন কথাও উঠেছে এবং এটি যে কোনো অমূলক ধারণা, তা-ও নয়। কিন্তু এসবই হলো প্রত্যাশার রেখাবয়ব। আসল প্রত্যাশা ছিল ভেতরে।
সংবিধানে এখন ধর্মনিরপেক্ষতা নেই, সমাজতন্ত্রের স্বপ্নকে বিতাড়িত করা হয়েছে। শিক্ষার ধারা একটি নয়, তিনটি এবং কারও সাধ্য নেই যে তিন ধারাকে এক করবে। কেননা, ধারা তিনটি দাঁড়িয়ে আছে শ্রেণিবিভাজনের ওপর ভর করে এবং শ্রেণিদূরত্ব মোটেই কমছে না, বরং বাড়ছে এবং তিন ধারার শিক্ষা ওই দূরত্বকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। শিক্ষা সামাজিক ঐক্য আনবে কি, বরং উল্টো কাজ করে চলেছে। মাতৃভাষার চর্চা যেমন হওয়া উচিত ছিল সেভাবে হয়নি; উচ্চশিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা প্রচলনের যে চ্যালেঞ্জ ছিল সেটাকে ঠিকমতো গ্রহণই করা হয়নি, বাকিটা তো পরের কথা। উচ্চ আদালতের কার্যক্রম কবে বাংলায় চালু হবে বা আদৌ হবে কি না, সেটা কেউ বলতে পারে না। পুঁজিবাদী মূল্যবোধ মানুষকে পরস্পরবিচ্ছিন্ন, সমাজবিমুখ ও ভোগবাদী করে তুলেছে। প্রত্যাশা থেকে এই প্রাপ্তিটা যে কত দূরে তা বুঝিয়ে বলাটা প্রায় অসম্ভব বৈকি।
একটি নতুন এবং বড় মাপের বিপদ তো ইতিমধ্যে এসে জুটেছে। সেটা হলো জলবায়ু পরিবর্তন। এই পরিবর্তন অনেক দেশকেই আঘাত করবে, ইতিমধ্যে আঘাত শুরু হয়েও গেছে বৈকি; কিন্তু বাংলাদেশের দুর্ভোগটাই হবে সবচেয়ে কঠিন বলে ধারণা। কেননা, আমাদের দেশ অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ ও দরিদ্র, তদুপরি এটি একটি বদ্বীপ। ফলে প্লাবন, খরা, ঝড় ও জলোচ্ছ্বাস যা কিছুই আমাদের আঘাত করছে, তা-ই আমাদের পক্ষে সহ্য করা কঠিন হবে। এখনই হচ্ছে। আর দেশের একাংশ যদি সমুদ্রের নিচে চলে যায় তবে অবস্থা যে কী দাঁড়াবে, তা কল্পনা করাও কঠিন।
বাংলাদেশের নিজস্ব কণ্ঠ আছে, সেই কণ্ঠে এই বিপদের কথাটা অত্যন্ত প্রবলভাবে ধ্বনিত হওয়া আবশ্যক। বাংলাদেশের কণ্ঠস্বর বিশ্বে শোনা যাবে এবং সেই কণ্ঠে নিপীড়িত বিশ্বের বাণী ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হবে। এ-ও ছিল প্রত্যাশার অংশ। দোষটা আমাদের নয়, দোষ করেছে পুঁজিবাদী বিশ্ব, ভুক্তভোগী হচ্ছি আমরা। পুঁজিবাদী বিশ্বকে তাই অভিযুক্ত করা চাই, তাদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করতে হবে; কিন্তু আরও বড় কাজ যেটা সেটা হলো, পুঁজিবাদকে প্রতিহত করা দরকার, যাতে তারা মানুষের ভবিষ্যৎকে এভাবে বিপন্ন করে তুলতে না পারে। কাজটা চলছে। আন্তর্জাতিক প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে, তাতে আমরা যোগ দেব—প্রত্যাশা এটাও। কিন্তু প্রত্যাশাগুলো পূরণ হবে না, যদি দেশপ্রেমিক ও গণতান্ত্রিক মানুষ এগিয়ে না আসেন এবং জনগণের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আন্দোলন গড়ে না তোলেন, যেমনটা তাঁরা অতীতে করেছিলেন এবং করেছিলেন বলেই মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন সম্ভব হয়েছিল।
লেখক: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বর্তমানে মিয়ানমারের রাখাইন এলাকা বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির দখলে। ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে রাখাইনের ১৭টি শহরের ভেতর ১৪টি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে বলে আরাকান আর্মি দাবি করছে। দখল করা শহরের মধ্যে বাংলাদেশের সীমান্তসংলগ্ন মংডু, বুথিডাং এবং চিন রাজ্যের প
২৯ মিনিট আগেরাষ্ট্রীয় প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র বাংলাদেশ সচিবালয়ের একটি উঁচু ভবনে কয়েক দিন আগে ঘটে যাওয়া অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধানে গঠিত উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বিদ্যুতের লুজ কানেকশন থেকে ওই ঘটনার সূত্রপাত বলে সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে। সে সিদ্ধান্তের আলোকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্ম
৩২ মিনিট আগেগণ-অভ্যুত্থান যখন আগস্ট থেকে জানুয়ারিতে এসে পা রেখেছে, তখন বিভিন্ন সংগঠনের সৃষ্ট অনেক ঘটনাতেই রাজনৈতিক জটিলতা বেড়ে ওঠার আলামত দেখা যাচ্ছে। যে স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিল মানুষ, আন্দোলন শেষে তা এখন কিছুটা শীতল। আন্দোলনের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব নিয়ে জমে উঠেছে বিতর্ক। যে যার মতো করে নিজেদেরই আন্দোলন
৪২ মিনিট আগেবাংলাদেশে বটতলার একজন উকিল ছিলেন। বটতলার হলে কী হবে, তিনি ছিলেন ‘পূর্ব পাকিস্তানের’ গভর্নর—জবরদস্ত শাসক মোনায়েম খান। তাঁর দাপটে পূর্ব পাকিস্তান ছিল কম্পমান। কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরের এই স্বৈরশাসক একবার তাঁর ওস্তাদ ‘পাকিস্তানের’ স্বঘোষিত ফিল্ড মার্শাল প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের কাছ থেকে হুকুম পান...
১ দিন আগে