পরিবর্তিত শিক্ষাক্রমে ধারাবাহিক মূল্যায়নের চ্যালেঞ্জ

রায়হান আরা জামান
প্রকাশ : ০৫ অক্টোবর ২০২১, ১৯: ৩৭

সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষাক্রমের রূপরেখায় অনুমোদন দেওয়ায় শিক্ষাক্ষেত্রে আসন্ন পরিবর্তন সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। শিক্ষাক্রমের রূপরেখায় অনেকগুলো ইতিবাচক বিষয় সংযোজন ও পরিবর্তনের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এতে পাঠ্য বিষয়, বই, পরীক্ষা ও মূল্যায়ন পদ্ধতি, পাবলিক পরীক্ষা প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিস্তর পরিবর্তনের কথা বলা হচ্ছে। প্রস্তাবিত এসব পরিবর্তনের অধিকাংশই ইতিবাচক ফলাফল নিয়ে আসবে ভেবে আশাবাদী হতে চাই; তবে বাস্তবায়ন বিষয়ক কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক শঙ্কা জাগায়। 

যতগুলো পরিবর্তনের কথা বলা হচ্ছে, তার মধ্যে মনোযোগের কেন্দ্রে রয়েছে মূল্যায়ন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনার পরিকল্পনা। পাবলিক পরীক্ষার আধিক্য, পরীক্ষাকেন্দ্রিক পড়াশোনা এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে পরীক্ষাভীতি নিয়ে সমালোচনার রাজ্যে মূল্যায়ন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনার পরিকল্পনা অবশ্যই আশার বিষয়। শিক্ষাক্রমের রূপরেখায় বলা হয়েছে শিক্ষার্থীদের ধারাবাহিক এবং চলমান মূল্যায়নের মাধ্যমে শিখন যাচাই করা হবে। দশম শ্রেণির আগে কোনো পাবলিক পরীক্ষা থাকবে না, পরীক্ষা থাকবে না প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্তও। শিক্ষক প্রতিটি শিক্ষার্থীকে শ্রেণিকক্ষে ধারাবাহিকভাবে মূল্যায়ন করবেন। নিশ্চিতভাবেই বলা যায় তাত্ত্বিকভাবে সামষ্টিক বা চূড়ান্ত মূল্যায়নের (ফাইনাল পরীক্ষা) তুলনায় ধারাবাহিক মূল্যায়নের কার্যকারিতা বেশি। তবে যেকোনো বিষয়ের কার্যকারিতা মূলত নির্ভর করে প্রয়োগকারী ব্যক্তির ওপর। ধারাবাহিক মূল্যায়নে শিক্ষকের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি, যা তাঁর দায়িত্ব, নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গেও জড়িত। 

এ ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম যে বিষয় ভাবাচ্ছে, তা হলো শিক্ষকবৃন্দ পরিবর্তিত এই ব্যবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নিতে কতটুকু প্রস্তুত? তাদের কি শ্রেণিকক্ষে ধারাবাহিক মূল্যায়নের মাধ্যমে কীভাবে শিক্ষার্থীদের অগ্রগতি সঠিকভাবে যাচাই করা যায়, সে বিষয়ক জ্ঞান, দক্ষতা, মানসিকতা ও প্রশিক্ষণ আছে? অথবা শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা বৃদ্ধির সামগ্রিক কোনো পরিকল্পনা কি গ্রহণ করা হয়েছে? নাকি একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে যেতে শিক্ষকেরা একসময় সবকিছু শিখে যাবেন; তার আগ পর্যন্ত ‘ট্রায়াল অ্যান্ড এরর’ পদ্ধতিতে সবাই শিখতে থাকবেন? মূল্যায়ন পদ্ধতিতে গুণগত পরিবর্তন আনা খুবই প্রয়োজন বলে আমিও মনে করি। তবে সত্যিকারের টেকসই ও গুণগত পরিবর্তনের জন্য শিক্ষকদের জ্ঞান, দক্ষতা ও মানসিকতার পরিবর্তন জরুরি। 

পরীক্ষার সংখ্যা কমানোর পরিকল্পনাও পরিবর্তিত শিক্ষাক্রমের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। বর্তমান শিক্ষাক্রমে বিভিন্ন ক্লাসে অর্ধবার্ষিক ও বার্ষিক—এই দুই পরীক্ষা হওয়ার কথা। তবে বাংলাদেশের নামীদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মডেল টেস্ট, অনুশীলন টেস্ট প্রভৃতি নামে আরও বেশ কয়েকটি পরীক্ষা নেওয়া হয়। এই বাস্তবতাকে মাথায় রেখে ধারাবাহিকভাবে মূল্যায়ন করতে গিয়ে কোনোভাবেই যেন পরীক্ষার সংখ্যা বেড়ে না যায়, সেটাও খেয়াল করতে হবে। সারা বছর শিক্ষার্থীরা যেন পরীক্ষাভীতিতে না থাকে, তা নিশ্চিত করাও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকের দায়িত্ব। চলমান মূল্যায়নে অনেক সময় শিক্ষার্থী জানতেও পারে না যে, তাকে মূল্যায়ন করা হচ্ছে। এতে শিক্ষার্থীদের ওপর অতিরিক্ত কোনো চাপ পড়ে না। এসব বিষয় ও কৌশল সম্পর্কে শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠানের সচেতনতা প্রয়োজন। 

 ‘কোচিং বাণিজ্য’, শিক্ষকের কাছে না পড়তে গেলে নম্বর কম দেওয়াসহ নানা ধরনের পক্ষপাতমূলক সমস্যায় আমাদের ছেলেমেয়েরা আগে থেকেই জর্জরিত। এখন পাবলিক পরীক্ষার স্থলে যখন সম্পূর্ণ ফলাফল স্কুলের শিক্ষকের হাতে, তখন কোচিং বাণিজ্য আগের থেকেও দ্বিগুণ গতি পাবে না তো? আইন আছে শিক্ষকবৃন্দ নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কোচিংয়ে পড়াতে পারবেন না। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন বলেই জানা যায়। ধারাবাহিক মূল্যায়নে শিক্ষক অনেক বেশি ক্ষমতাবান যেহেতু, তার হাতেই প্রতিটি শিক্ষার্থীর পুরো বছরের ফলাফল; তাই শিক্ষকের নৈতিকতা এবং সততার বিষয়টি এখানে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষক—প্রতিটি শিক্ষার্থীকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করছেন কি না, তা তদারক করার কি কোনো মেকানিজম ঠিক করা হয়েছে? 

শিক্ষাক্রমে পরিবর্তন আনার পরিকল্পনা খুবই ইতিবাচক। পরীক্ষাকেন্দ্রিক পড়ালেখা থেকে বেরিয়ে সত্যিকারের কিছু শেখার জন্য, পরীক্ষাভীতি কমিয়ে শেখাকে আনন্দদায়ক করার জন্য, শিক্ষাব্যবস্থার গুণগত পরিবর্তন আনার জন্য পরিবর্তিত শিক্ষাক্রমে খুব ভালো কিছু প্রস্তাব আছে। পরিকল্পিত বাস্তবায়ন কৌশলের অভাবে কোনোভাবেই যেন এটি ব্যর্থ না হয়—এটাই প্রত্যাশা। 

রায়হান আরা জামান: শিক্ষক, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত