মইনুল হাসান
খুব অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছে ফ্রান্স এবং ইউরোপ। কারণ, অনেকটা ‘ভাগ্যক্রমে’ ইমানুয়েল মাখোঁ টানা দ্বিতীয় মেয়াদে পাঁচ বছরের জন্য ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। তা না হলে প্রেসিডেন্টের আসনটি আগামী পাঁচ বছরের জন্য চলে যেত মারিন লো পেনের নেতৃত্বে কট্টর ডানপন্থীদের দখলে।
ঠিক পাঁচ বছর আগে, ২০১৭ সালের মে মাসের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এই দুজন প্রার্থী মুখোমুখি হয়েছিলেন। তারও আগে ২০০২ সালের নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপে উত্তীর্ণ হয়ে মারিন লো পেনের বাবা জঁ মারি লো পেন প্রায়ই এলিজে প্রাসাদের সদর দরজার কাছে পৌঁছে গিয়েছিলেন। সে সময় জঁ মারি ফ্রান্সের জনগণের এক বিশাল অংশকে বিশ্বাস করাতে পেরেছিলেন যে, ফ্রান্সের সকল সর্বনাশের মূল হচ্ছে বহিরাগত অভিবাসীরা, বিশেষ করে মুসলিমরা। আর ইউরোপীয় ইউনিয়ন মানেই সার্বভৌমত্ব হারানো, ফ্রান্সের নিজস্বতা বলে কিছু থাকল না। তিনি ইউরো মুদ্রার চরম বিরোধিতা করেছিলেন। প্রান্তিক জনগণকে বোঝাতে চেষ্টা করেছিলেন, ইউরোর কারণে দ্রব্যমূল্য বাড়ছে। তবে শেষ পর্যন্ত ডানপন্থী জ্যাক শিরাকের কাছে তাঁকে হার মানতে হয়েছিল।
মূলধারার ঐতিহ্যবাহী ডান এবং বামপন্থী প্রধান দুটি দল সোশ্যালিস্ট ও রিপাবলিক পার্টি বিগত বছরগুলোতে ফ্রান্সের রাজনৈতিক অঙ্গনে দাপিয়ে বেড়িয়েছে এবং এ দুই দলের নেতারাই পালাক্রমে এলিজে প্রাসাদের বাসিন্দা হয়েছেন। কিন্তু এমন শীর্ষ দুটি দলের নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অনিয়ম, কেলেঙ্কারির অভিযোগ ওঠে। অর্থনৈতিক স্থবিরতা, বেকারত্বের হার বৃদ্ধি, ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস জনমনে অসন্তোষের ক্ষোভকে উসকে দেয়। বারবার সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয় বহু নিরীহ মানুষ। অনিশ্চয়তা, নিরাপত্তাহীনতায় হতাশাগ্রস্ত জনগণ সনাতন ডান এবং বাম দল থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। ব্যক্তিত্বের সংকটে রাজনীতিতে একধরনের শূন্যতা দেখা দেয়।
সে সময় ইউরোপের দেশগুলোতে চরমপন্থীরা রাজনীতির ময়দানে সরব হতে থাকে। আটলান্টিকের ওপারে ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে ইউরোপে চরমপন্থীদের উৎসাহ, উদ্দীপনা মাত্রা ছাড়ায়। কট্টর ডানপন্থী দলের নেত্রী মারিন লো পেন এমন মোক্ষম সুযোগ কাজে লাগিয়ে অনেকখানি এগিয়ে যান। জনতুষ্টির রাজনীতিতে অভিবাসননীতি ও ইসলামফোবিয়ার রং মাখিয়ে সামনে চলে আসেন। যুক্তরাজ্য ইউরোপ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নিলে ইউরোপবিদ্বেষী লো পেনের পাখা গজাতে শুরু করে। ইউরোপীয় নেতারা প্রমাদ গুনতে শুরু করেন এবং ইউরোপের অখণ্ডতা নিয়ে উদ্বিগ্ন হন। ইউরোপের এমন ক্রান্তিকালে স্বল্প পরিচিত সাবেক ব্যাংকার এবং অর্থমন্ত্রী মাখোঁ মাত্র ৩৯ বছর বয়সে অনেকটা চমক সৃষ্টি করেন। ‘এগিয়ে চলো’ আন্দোলনে স্থবির রাজনীতিতে গতি সঞ্চার করতে সক্ষম হন। তিনি বিভেদ-বৈষম্যে কমিয়ে আনার কথা বলেন। দেশের সব শ্রেণির মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টিতে সবার সঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার করেন। ভীতি দূর করে নিরাপদ স্বদেশ গড়ার প্রতিশ্রুতি দেন। রাষ্ট্রীয় ব্যয় কমানো, সরকারের দক্ষতা বাড়ানো, দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি রোধ, শ্রম আইন শিথিল, বঞ্চিত এলাকায় শিক্ষার সুযোগ বাড়ানো, বেকারত্ব লাঘব, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, করের বোঝা কমানো, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে এগিয়ে নেওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। বিশেষ করে বিশ্বায়নের যুগে প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধনের সঙ্গে পুরোনো ধ্যান-ধারণামুক্ত একটি আধুনিক সমাজের স্বপ্ন দেখান।
মাখোঁ ২০১৭ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ফ্রান্সের সবচেয়ে কম বয়সী প্রেসিডেন্ট হয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেন। রাজনীতির খুঁটিনাটি নিয়ে যাঁরা মাথা ঘামান, তাঁদের মতে এই তরুণ প্রেসিডেন্টের ভাগ্য প্রসন্ন ছিল বলেই অনেকটা ‘ভাগ্যক্রমে’ ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট হতে পেরেছিলেন। আর তাই রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা তাঁকে আখ্যা দিয়েছেন ‘প্রেসিডেন্ট বাই চান্স’ হিসেবে।
প্রথমবার নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁকে বেশ কয়েকটি সমস্যার মোকাবিলা করতে হয়। জীবাশ্ম জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিতে জনগণের অসন্তোষের বারুদে বিস্ফোরণ ঘটে। ‘হলুদ কোর্তা’ খ্যাত সামাজিক আন্দোলন দীর্ঘদিনের জন্য দানা বাঁধে। সে আন্দোলনের রেশ না কাটতেই অতিমারি হানা দেয়। বিপর্যস্ত হয় জনমানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। আর শরণার্থী এক মুসলিম তরুণের সন্ত্রাসী হামলাতে খুন হয় একজন স্কুলশিক্ষক। ফলে দেশজুড়ে ইসলামফোবিয়া এবং মুসলিমবিরোধী বিষবাস্প ছড়াতে শুরু করে।
অভ্যন্তরীণ এসব সংকটের মোকাবিলায় মাখোঁ দক্ষতার পরিচয় দিলেও বেশ কিছু সংস্কার থেকে সরে আসেন। এর মধ্যে অবসর নেওয়ার বয়স নির্ধারণের ব্যাপারটি চাপা পড়ে যায়। গড় আয়ু বৃদ্ধি পাওয়ায় অবসর নেওয়ার বয়স ৬০ থেকে বাড়িয়ে তা ৬৫-তে উন্নীত করার পরিকল্পনা ছিল। ফরাসিরা এমন সংস্কারকে তাঁদের জীবনমান হ্রাস বলে মনে করে। অতিমারি মোকাবিলাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে এমন একটি অজনপ্রিয় বিষয় নিয়ে তিনি আর অগ্রসর হননি। এদিকে বিদেশি উদ্যোক্তাদের আকর্ষণ করার জন্য করের বোঝা লাঘব করেন। বিরোধীরা তাঁকে তাই ‘বাণিজ্যবান্ধব’ এবং ‘ধনীদের প্রেসিডেন্ট’ আখ্যা দেয়। অনেকে তাঁকে ‘দাম্ভিক’ বলতে মোটেই দ্বিধা করছেন না। তারপরও সমালোচনা গায়ে না মেখে গতবারের নির্বাচিত তরুণ প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকাকালে নানা আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ সংকট সাহস এবং দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা করেন।
২০২২ সালে নির্বাচনের সময় ইউরোপে সূর্য ঢাকা পড়ছে যুদ্ধের কালো ছায়াতে। ধ্বংসাত্মক ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ইউরোপের অন্য দেশের মতোই ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতি ও ইইউ জোটের জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের একমাত্র স্থায়ী সদস্য ফ্রান্স হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারছে না। যুদ্ধের কারণে ইউরোপব্যাপী জ্বালানি সরবরাহ হুমকির মুখে পড়েছে, দ্রব্যমূল্য বেড়েছে এবং তা গত ৪০ বছরের মধ্যে সর্বাধিক। অতিমারি ও যুদ্ধের কারণে ফরাসি জনজীবনে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা অসহিষ্ণুতার আগুনকে উসকে দিচ্ছে।
যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে রাজনীতির ঘোলা পানিতে ফায়দা নিতে তৎপর ছিল সস্তা স্লোগানসর্বস্ব কট্টর ডান ও বামেরা। বিশেষ করে ডানপন্থীদের উত্থান ছিল অনেকটাই বিস্ময়কর। ২০০২ থেকে ২০২২—এই দুই দশক ধরে কট্টর ডানপন্থীরা প্রায়ই ক্ষমতার কাছাকাছি চলে এসেছে। অর্থাৎ, গত চার দশকের বেশি সময় ধরে চরমপন্থীরা গণতন্ত্রের লেবাস গায়ে চড়িয়ে একান্ত নিষ্ঠায় উগ্র জাতীয়তাবাদ, বর্ণবাদ, ঘৃণা ও স্বৈরাচার চর্চায় তাদের রাজনীতির বিষবৃক্ষকে পুষ্টি জুগিয়েছে। আজ সে বিষবৃক্ষের শিকড় পৌঁছে গেছে ফরাসি সমাজের অনেক গভীরে। নির্বাচন ঘনিয়ে এলে এলিজে প্রাসাদের সদর দরজায় খুব শব্দ করে কড়া নাড়ে। এখন তাঁরা ৪০ শতাংশের ওপরে ভোট পান। প্রশ্ন হচ্ছে, আর কত দিন তাঁদের ঠেকিয়ে রাখা যাবে?
এই প্রশ্নটিকে সামনে রেখে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর আইফেল টাওয়ারের পাদদেশে উল্লসিত জনগণের উদ্দেশে ভাষণ দিতে গিয়ে মাখোঁ বলেছেন, ‘নির্বাচন শেষ হয়েছে, এখন আমি সকল ফরাসি নাগরিকের প্রেসিডেন্ট। আমি জানি, আমাকে যারা ভোট দিয়েছেন, তাঁদের অনেকেই আমার মতাদর্শে বিশ্বাস করেন না। শুধু চরমপন্থীদের ঠেকাবার জন্য আমাকে ভোট দিয়েছেন।’
ইমানুয়েল মাখোঁ, পুরো নাম ইমানুয়েল জ্যাঁ মিশেল ফ্রেডেরিক মাখোঁ। জন্ম ২১ ডিসেম্বর ১৯৭৭। বয়স ৪৪ বছর। তাঁর ঝুলিতে আছে বিগত পাঁচ বছরের রাষ্ট্র পরিচালনার অভিজ্ঞতা। তিনি ফ্রান্সের বহুধা বিভক্ত সমাজকে একত্র করে একটি আধুনিক সমাজ গঠনে দক্ষ ভূমিকা রাখবেন। সর্বোপরি বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা, বৈশ্বিক অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার এবং জলবায়ু তথা পরিবেশ রক্ষায় বিশেষ অবদান রাখবেন—এমনটাই আশা।
বিজ্ঞান, শিল্পকলা, সংস্কৃতি, দর্শন, মানবতাবাদী বহু সংস্কারের উজ্জ্বল গৌরবের দেশ ফ্রান্সের প্রতি স্বাভাবিক কারণেই মানুষের আশা অনেক বেশি। তিনি নিশ্চয়ই হতাশ করবেন না। তাঁকে প্রেসিডেন্ট ‘বাই চান্স’ বলা হলেও এটাই তাঁর শেষ সুযোগ; অর্থাৎ, লাস্ট চান্স।
লেখক: ফ্রান্সপ্রবাসী লেখক
খুব অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছে ফ্রান্স এবং ইউরোপ। কারণ, অনেকটা ‘ভাগ্যক্রমে’ ইমানুয়েল মাখোঁ টানা দ্বিতীয় মেয়াদে পাঁচ বছরের জন্য ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। তা না হলে প্রেসিডেন্টের আসনটি আগামী পাঁচ বছরের জন্য চলে যেত মারিন লো পেনের নেতৃত্বে কট্টর ডানপন্থীদের দখলে।
ঠিক পাঁচ বছর আগে, ২০১৭ সালের মে মাসের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এই দুজন প্রার্থী মুখোমুখি হয়েছিলেন। তারও আগে ২০০২ সালের নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপে উত্তীর্ণ হয়ে মারিন লো পেনের বাবা জঁ মারি লো পেন প্রায়ই এলিজে প্রাসাদের সদর দরজার কাছে পৌঁছে গিয়েছিলেন। সে সময় জঁ মারি ফ্রান্সের জনগণের এক বিশাল অংশকে বিশ্বাস করাতে পেরেছিলেন যে, ফ্রান্সের সকল সর্বনাশের মূল হচ্ছে বহিরাগত অভিবাসীরা, বিশেষ করে মুসলিমরা। আর ইউরোপীয় ইউনিয়ন মানেই সার্বভৌমত্ব হারানো, ফ্রান্সের নিজস্বতা বলে কিছু থাকল না। তিনি ইউরো মুদ্রার চরম বিরোধিতা করেছিলেন। প্রান্তিক জনগণকে বোঝাতে চেষ্টা করেছিলেন, ইউরোর কারণে দ্রব্যমূল্য বাড়ছে। তবে শেষ পর্যন্ত ডানপন্থী জ্যাক শিরাকের কাছে তাঁকে হার মানতে হয়েছিল।
মূলধারার ঐতিহ্যবাহী ডান এবং বামপন্থী প্রধান দুটি দল সোশ্যালিস্ট ও রিপাবলিক পার্টি বিগত বছরগুলোতে ফ্রান্সের রাজনৈতিক অঙ্গনে দাপিয়ে বেড়িয়েছে এবং এ দুই দলের নেতারাই পালাক্রমে এলিজে প্রাসাদের বাসিন্দা হয়েছেন। কিন্তু এমন শীর্ষ দুটি দলের নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অনিয়ম, কেলেঙ্কারির অভিযোগ ওঠে। অর্থনৈতিক স্থবিরতা, বেকারত্বের হার বৃদ্ধি, ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস জনমনে অসন্তোষের ক্ষোভকে উসকে দেয়। বারবার সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয় বহু নিরীহ মানুষ। অনিশ্চয়তা, নিরাপত্তাহীনতায় হতাশাগ্রস্ত জনগণ সনাতন ডান এবং বাম দল থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। ব্যক্তিত্বের সংকটে রাজনীতিতে একধরনের শূন্যতা দেখা দেয়।
সে সময় ইউরোপের দেশগুলোতে চরমপন্থীরা রাজনীতির ময়দানে সরব হতে থাকে। আটলান্টিকের ওপারে ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে ইউরোপে চরমপন্থীদের উৎসাহ, উদ্দীপনা মাত্রা ছাড়ায়। কট্টর ডানপন্থী দলের নেত্রী মারিন লো পেন এমন মোক্ষম সুযোগ কাজে লাগিয়ে অনেকখানি এগিয়ে যান। জনতুষ্টির রাজনীতিতে অভিবাসননীতি ও ইসলামফোবিয়ার রং মাখিয়ে সামনে চলে আসেন। যুক্তরাজ্য ইউরোপ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নিলে ইউরোপবিদ্বেষী লো পেনের পাখা গজাতে শুরু করে। ইউরোপীয় নেতারা প্রমাদ গুনতে শুরু করেন এবং ইউরোপের অখণ্ডতা নিয়ে উদ্বিগ্ন হন। ইউরোপের এমন ক্রান্তিকালে স্বল্প পরিচিত সাবেক ব্যাংকার এবং অর্থমন্ত্রী মাখোঁ মাত্র ৩৯ বছর বয়সে অনেকটা চমক সৃষ্টি করেন। ‘এগিয়ে চলো’ আন্দোলনে স্থবির রাজনীতিতে গতি সঞ্চার করতে সক্ষম হন। তিনি বিভেদ-বৈষম্যে কমিয়ে আনার কথা বলেন। দেশের সব শ্রেণির মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টিতে সবার সঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার করেন। ভীতি দূর করে নিরাপদ স্বদেশ গড়ার প্রতিশ্রুতি দেন। রাষ্ট্রীয় ব্যয় কমানো, সরকারের দক্ষতা বাড়ানো, দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি রোধ, শ্রম আইন শিথিল, বঞ্চিত এলাকায় শিক্ষার সুযোগ বাড়ানো, বেকারত্ব লাঘব, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, করের বোঝা কমানো, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে এগিয়ে নেওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। বিশেষ করে বিশ্বায়নের যুগে প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধনের সঙ্গে পুরোনো ধ্যান-ধারণামুক্ত একটি আধুনিক সমাজের স্বপ্ন দেখান।
মাখোঁ ২০১৭ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ফ্রান্সের সবচেয়ে কম বয়সী প্রেসিডেন্ট হয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেন। রাজনীতির খুঁটিনাটি নিয়ে যাঁরা মাথা ঘামান, তাঁদের মতে এই তরুণ প্রেসিডেন্টের ভাগ্য প্রসন্ন ছিল বলেই অনেকটা ‘ভাগ্যক্রমে’ ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট হতে পেরেছিলেন। আর তাই রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা তাঁকে আখ্যা দিয়েছেন ‘প্রেসিডেন্ট বাই চান্স’ হিসেবে।
প্রথমবার নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁকে বেশ কয়েকটি সমস্যার মোকাবিলা করতে হয়। জীবাশ্ম জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিতে জনগণের অসন্তোষের বারুদে বিস্ফোরণ ঘটে। ‘হলুদ কোর্তা’ খ্যাত সামাজিক আন্দোলন দীর্ঘদিনের জন্য দানা বাঁধে। সে আন্দোলনের রেশ না কাটতেই অতিমারি হানা দেয়। বিপর্যস্ত হয় জনমানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। আর শরণার্থী এক মুসলিম তরুণের সন্ত্রাসী হামলাতে খুন হয় একজন স্কুলশিক্ষক। ফলে দেশজুড়ে ইসলামফোবিয়া এবং মুসলিমবিরোধী বিষবাস্প ছড়াতে শুরু করে।
অভ্যন্তরীণ এসব সংকটের মোকাবিলায় মাখোঁ দক্ষতার পরিচয় দিলেও বেশ কিছু সংস্কার থেকে সরে আসেন। এর মধ্যে অবসর নেওয়ার বয়স নির্ধারণের ব্যাপারটি চাপা পড়ে যায়। গড় আয়ু বৃদ্ধি পাওয়ায় অবসর নেওয়ার বয়স ৬০ থেকে বাড়িয়ে তা ৬৫-তে উন্নীত করার পরিকল্পনা ছিল। ফরাসিরা এমন সংস্কারকে তাঁদের জীবনমান হ্রাস বলে মনে করে। অতিমারি মোকাবিলাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে এমন একটি অজনপ্রিয় বিষয় নিয়ে তিনি আর অগ্রসর হননি। এদিকে বিদেশি উদ্যোক্তাদের আকর্ষণ করার জন্য করের বোঝা লাঘব করেন। বিরোধীরা তাঁকে তাই ‘বাণিজ্যবান্ধব’ এবং ‘ধনীদের প্রেসিডেন্ট’ আখ্যা দেয়। অনেকে তাঁকে ‘দাম্ভিক’ বলতে মোটেই দ্বিধা করছেন না। তারপরও সমালোচনা গায়ে না মেখে গতবারের নির্বাচিত তরুণ প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকাকালে নানা আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ সংকট সাহস এবং দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা করেন।
২০২২ সালে নির্বাচনের সময় ইউরোপে সূর্য ঢাকা পড়ছে যুদ্ধের কালো ছায়াতে। ধ্বংসাত্মক ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ইউরোপের অন্য দেশের মতোই ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতি ও ইইউ জোটের জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের একমাত্র স্থায়ী সদস্য ফ্রান্স হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারছে না। যুদ্ধের কারণে ইউরোপব্যাপী জ্বালানি সরবরাহ হুমকির মুখে পড়েছে, দ্রব্যমূল্য বেড়েছে এবং তা গত ৪০ বছরের মধ্যে সর্বাধিক। অতিমারি ও যুদ্ধের কারণে ফরাসি জনজীবনে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা অসহিষ্ণুতার আগুনকে উসকে দিচ্ছে।
যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে রাজনীতির ঘোলা পানিতে ফায়দা নিতে তৎপর ছিল সস্তা স্লোগানসর্বস্ব কট্টর ডান ও বামেরা। বিশেষ করে ডানপন্থীদের উত্থান ছিল অনেকটাই বিস্ময়কর। ২০০২ থেকে ২০২২—এই দুই দশক ধরে কট্টর ডানপন্থীরা প্রায়ই ক্ষমতার কাছাকাছি চলে এসেছে। অর্থাৎ, গত চার দশকের বেশি সময় ধরে চরমপন্থীরা গণতন্ত্রের লেবাস গায়ে চড়িয়ে একান্ত নিষ্ঠায় উগ্র জাতীয়তাবাদ, বর্ণবাদ, ঘৃণা ও স্বৈরাচার চর্চায় তাদের রাজনীতির বিষবৃক্ষকে পুষ্টি জুগিয়েছে। আজ সে বিষবৃক্ষের শিকড় পৌঁছে গেছে ফরাসি সমাজের অনেক গভীরে। নির্বাচন ঘনিয়ে এলে এলিজে প্রাসাদের সদর দরজায় খুব শব্দ করে কড়া নাড়ে। এখন তাঁরা ৪০ শতাংশের ওপরে ভোট পান। প্রশ্ন হচ্ছে, আর কত দিন তাঁদের ঠেকিয়ে রাখা যাবে?
এই প্রশ্নটিকে সামনে রেখে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর আইফেল টাওয়ারের পাদদেশে উল্লসিত জনগণের উদ্দেশে ভাষণ দিতে গিয়ে মাখোঁ বলেছেন, ‘নির্বাচন শেষ হয়েছে, এখন আমি সকল ফরাসি নাগরিকের প্রেসিডেন্ট। আমি জানি, আমাকে যারা ভোট দিয়েছেন, তাঁদের অনেকেই আমার মতাদর্শে বিশ্বাস করেন না। শুধু চরমপন্থীদের ঠেকাবার জন্য আমাকে ভোট দিয়েছেন।’
ইমানুয়েল মাখোঁ, পুরো নাম ইমানুয়েল জ্যাঁ মিশেল ফ্রেডেরিক মাখোঁ। জন্ম ২১ ডিসেম্বর ১৯৭৭। বয়স ৪৪ বছর। তাঁর ঝুলিতে আছে বিগত পাঁচ বছরের রাষ্ট্র পরিচালনার অভিজ্ঞতা। তিনি ফ্রান্সের বহুধা বিভক্ত সমাজকে একত্র করে একটি আধুনিক সমাজ গঠনে দক্ষ ভূমিকা রাখবেন। সর্বোপরি বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা, বৈশ্বিক অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার এবং জলবায়ু তথা পরিবেশ রক্ষায় বিশেষ অবদান রাখবেন—এমনটাই আশা।
বিজ্ঞান, শিল্পকলা, সংস্কৃতি, দর্শন, মানবতাবাদী বহু সংস্কারের উজ্জ্বল গৌরবের দেশ ফ্রান্সের প্রতি স্বাভাবিক কারণেই মানুষের আশা অনেক বেশি। তিনি নিশ্চয়ই হতাশ করবেন না। তাঁকে প্রেসিডেন্ট ‘বাই চান্স’ বলা হলেও এটাই তাঁর শেষ সুযোগ; অর্থাৎ, লাস্ট চান্স।
লেখক: ফ্রান্সপ্রবাসী লেখক
সম্প্রতি হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী তিন দিনের মধ্যে অটোরিকশা বন্ধের প্রস্তাবে চালকদের রাস্তায় নেমে আসা এবং শহর কার্যত অচল হয়ে পড়ার ঘটনা ঘটেছে। এ অবরোধে সড়ক ও রেলপথে যোগাযোগ ব্যাহত হওয়ায় মানুষের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছায়।
৬ ঘণ্টা আগেআগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নিতে পারবে কী পারবে না, তাদেরকে নির্বাচনে অংশ নিতে দেওয়া হবে কী হবে না—এ নিয়ে গরম এখন রাজনীতির মাঠ। জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের নায়ক হিসেবে দাবিদার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দাবি তো আরও একধাপ বেশি। আওয়ামী লীগকে কেবল নির্বাচনের বাইরে রাখাই নয়, দাবি তাদের দেশের প্রাচী
১৪ ঘণ্টা আগেহুমায়ূন আহমেদ ও মেহের আফরোজ শাওনের ছেলে নিষাদ হুমায়ূনের একটা ভাইরাল ভিডিও ক্লিপ দেখলাম। বেশ মজা পেলাম। সত্যি বললে মজার চেয়েও ছোট্ট বাচ্চার কথায় ভাবনার উদ্রেক হলো। চিন্তার দুয়ার উন্মুক্ত হলো।
১৪ ঘণ্টা আগেপরিবেশকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে সার্কুলার অর্থনীতি বা বৃত্তাকার অর্থনীতি এক নবদিগন্ত উন্মোচন করতে পারে। বাংলাদেশে স্বল্প সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে সার্কুলার অর্থনীতির বিকল্প নেই।
১৪ ঘণ্টা আগে