চা শ্রমিকের মজুরি ও অধিকার প্রশ্নে ভোক্তারাও কি চুপ করে থাকবে?

তাপস বড়ুয়া
প্রকাশ : ১৭ আগস্ট ২০২২, ২০: ৫০

এ দেশের অনেক মানুষ যেখানে থাকে, যা খায়, তার চেয়ে জেলখানায় থাকার ব্যবস্থা ভালো, খাওয়ার ব্যবস্থা ভালো। কিন্তু মানুষ নর্দমার পাশে পলিথিনের নিচে বাস করা আর খেয়ে-না খেয়ে থাকাকে জেলখানার নিশ্চিত খাবার, আর মাথার ওপরে পাকা ছাদের চেয়ে বেশি পছন্দ করে। কেন? কারণ, থাকা-খাওয়াটা শেষ কথা নয়। থাকবে কি না, খাবে কি না—এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতাটা আরও বড় ব্যাপার। জেলখানায় সেটা থাকে না।

নব্য দাস শ্রমিকের ইস্যুটি এ জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এখন ক্রীতদাস প্রথা নেই। কিন্তু ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কাউকে কোনো কাজ করতে বাধ্য করাটা নতুন রকমের দাসপ্রথা। চা শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলন নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। তাদের কাজের শর্তগুলো অনেকটাই আধুনিক দাসত্বের মতোই।

মধ্যভারতের খরাপীড়িত এলাকার গরিব মানুষদের চা-বাগানের সবুজের লোভ দেখিয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল উত্তর-পূর্ব ভারতের চা বাগানগুলোতে। মিনিদের আসাম গিয়ে সস্তায় শ্রম বিক্রির সেই শুরু। তখন থেকে আমাদের দেশের উত্তর-পূর্ব দিকের চা বাগানগুলোতে তাঁরা বংশ পরম্পরায় কাজ করেন। প্রশ্ন হচ্ছে, এই মানুষগুলো প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে একই কাজ কেন করেন? এই পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় কেন যেতে পারেন না? বিভিন্ন পেশার দরিদ্র মানুষেরা তো এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে পেশা বদল করে।

প্রথমত, এই এলাকায় তাঁরা অভিবাসী। স্থানীয়দের সঙ্গে তাঁদের জনতাত্ত্বিক ও সামাজিক পার্থক্য রয়েছে। বংশপরম্পরায় একই জায়গায় থেকেও তাঁরা সেই জায়গার জনজীবনের মূলধারায় মিশে যেতে পারেননি। অন্যভাবে বললে, তাঁদের স্থানীয় জনজীবনে মিশে যাওয়ার মতো অনুকূল পরিবেশ পেতে পদ্ধতিগত বাধা দেওয়া হয়েছে সামাজিক, অর্থনৈতিক পার্থক্যগুলোকে জিইয়ে রেখে।

ব্রিটিশ আমল থেকেই এই চা শ্রমিকদের নব্য দাস করে রাখা হয়েছে। নগদ মজুরি কম দিয়ে, তার জায়গায় দেওয়া হয়েছে কম মূল্যে ন্যূনতম খাবারের জোগান (রেশন)। ফলে তারা টাকাটা হাতে পাচ্ছে না; বদলে পাচ্ছে মালিকের মর্জিমতো পণ্য ও সেবা। বাগানের রেশন আছে, ঘর তুলে থাকার মতো জায়গা আছে, বাগানের ডাক্তার আছে—এসব যারা বলেন, তাঁরা এটা বলেন না যে, এসব পণ্য ও সেবা মালিক দয়া করে দিচ্ছে না। শ্রমিকের পারিশ্রমিক থেকে এই পণ্য ও সেবার দাম কেটে রাখা হচ্ছে। বরং এসব যুক্তি বানিয়ে এই ২০২২ সালে একজন শ্রমিকের হাতে নগদ মজুরি হিসেবে দৈনিক ১২০ টাকা দেওয়া হচ্ছে। ঢাকা শহরে একজন রিকশাচালক এই টাকা এক ঘণ্টা রিকশা চালিয়ে আয় করেন। যে টাকায় মাত্র সাড়ে সাতটা বেনসন সিগারেট কেনা যায়। এর সঙ্গে রেশন ইত্যাদি যোগ করেই কিন্তু মালিকপক্ষ শ্রমিকের পেছনে মোট ব্যয় নির্ধারণ করছে। সুতরাং রেশন ইত্যাদি সুবিধা দয়ার দান নয়। তার মজুরির অংশ। 

টাকা হাতে না পেয়ে পণ্য ও সেবা পেলে সমস্যা কী? টাকা হাতে না এলে মানুষ টাকা কীভাবে কাজে লাগাবে, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত হয়। সে ক্ষেত্রে মালিকই সিদ্ধান্ত নেয়, শ্রমিকের মজুরির ব্যবহার কীভাবে হবে। পারিশ্রমিকের কত অংশ চাল কিনতে, তেল কিনতে খরচ করবে। অথচ, নগদ মজুরি বাদে অন্য যেসব সুবিধা, সেগুলোও তার মজুরিরই অংশ। কিন্তু মজুরির সেই অংশ খরচের ক্ষেত্রে তাঁর সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা নেই। 

টাকা নিজের হাতে নিয়ে খরচ করতে না পারলে ইচ্ছে থাকলেও মানুষ সঞ্চয় করতে পারবে না। একজন মানুষ একই পেশাতেই বাঁধা পড়ে থাকবে, এদিক-ওদিক যাওয়ার চিন্তা করতে পারবে না—এটা নিশ্চিত করার একটা বড় উপায় হচ্ছে আর্থিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা তাঁর কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া। যাতে সে সঞ্চয় করতে না পরে, পেশা বদলের চিন্তা না করতে পারে। আর্থিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতার ওপর সরাসরি নির্ভর করে সন্তানের শিক্ষাসহ জীবনের নানাবিধ গুরুত্বপূর্ণ দিক, যেগুলো তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের সার্বিক জীবনমানের উন্নয়নকে প্রভাবিত করে। 

বাংলাদেশের সমাজে বর্ণভেদ প্রথা নেই। চা বাগানে অন্যরকম বর্ণভেদ প্রথা আছে। শ্রেণির ভিত্তিতে নির্ধারিত বর্ণভেদ প্রথা কতটা নির্মম ও অসম্মানজনক হতে পারে, সেটা দেখার জন্য চা বাগানের শ্রমিক, আর কর্মকর্তাদের পারস্পরিক ব্যবহার, আচার-আচরণকে উদাহরণ হিসেবে নেওয়া যায়। 

ম্যালেরিয়ার ওষুধ যখন ভারতবর্ষে প্রথম আসে, তখন আসামের চা বাগানগুলোতে এই ওষুধ শুধু অফিসারদের দেওয়া হতো। শ্রমিক যদি ম্যালেরিয়ায় মারাও যায়, তাকে সেই ওষুধ দেওয়া হতো না। আসামের এক চা বাগানের ডাক্তার, গীতিকার-সুরকার সলিল চৌধুরীর বাবা এর প্রতিবাদ করে চাকরি হারিয়েছিলেন। 

শ্রমিকের সঙ্গে কর্মকর্তার বৈষম্যের এই পরিস্থিতি এক শ বছর পর এসেও খুব বদলায়নি সামন্তবাদী মনোভাবের কারণে। ব্রিটিশ গেছে, কিন্তু চা-বাগানের শ্রমিক-কর্মকর্তার উঁচু-নীচ সম্পর্ক পরিবর্তিত হয়নি। তাদের সম্মান, তাদের মজুরি ও অন্যান্য সুবিধা প্রদানের বিষয়টি প্রায় একই রকমভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। 

শ্রমিকদের দাবি, মজুরি ১২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করা হোক। এই বাজারে সেটাও দেবে না মালিকেরা। যদিও চায়ের বাজার বড় হচ্ছে প্রতি বছর, মালিকের আয় বাড়ছে। হাজার কোটি টাকার একটা খাত এটা। যে মানুষেরা শত বছর ধরে এই খাতটাতে জীবনের সর্বস্ব দিয়েছে, তারা এই উঠতি বাজারের কণামাত্র সুবিধা পাবে না—এটা কীভাবে হয়! 

গার্মেন্টস খাতে মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলন হয়। সরকার ও মালিকপক্ষ খাতসংশ্লিষ্ট অন্যদের সঙ্গে আলোচনা করে কয়েক বছর পরপর ন্যূনতম মজুরি নতুন করে নির্ধারণ করে। এ নিয়েও অনেক প্রশ্ন থাকলেও গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেতন-ভাতার প্রসঙ্গটি সংবাদমাধ্যম ও সুধীজনদের মনোযোগ পায়। সরকারের ওপর, মালিকের ওপর চাপ তৈরি হয়। তারা কিছুটা হলেও বদল আনে। তাদের সদিচ্ছা হয়তো সব সময় এর কারণ নয়। রপ্তানিমুখী খাত বলে বিদেশি ক্রেতাদের চাপ থাকে। কারণ, যে দেশে পণ্য যাবে, সে দেশের আইন-কানুন মেনে ওই সব ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা করতে হয়। সে দেশের ভোক্তাদের চাপ থাকে। 

বাংলাদেশের চা শিল্প এখনো ততটা রপ্তানিমুখী নয়। বাংলাদেশি চায়ের সিংহভাগ ভোক্তা এ দেশীয়। শ্রমিকের স্বার্থরক্ষায় ভোক্তাদের কণ্ঠস্বর এখানে শক্ত নয়। চাল, তেল, ডিমের মতো নিত্যপণ্যের দাম হু হু করে বেড়ে যায়। ব্যবসায়ীরা জানেন, সরকারও জানে—ভোক্তাদের দিকটা না দেখলেও চলবে। সুতরাং চায়ের উৎপাদকের ওপর ভোক্তা বা সরকারের চাপ নেই শ্রমিকের জীবনমান উন্নয়নের। ব্যবসায়ীরা নিজেরাই নির্ধারণ করছেন, শত বছরের প্রথাতেই তাঁরা বেঁধে রাখবেন সাড়ে চার লাখ চা শ্রমিককে। কিন্তু ক্রেতারাও কিছু বলবে না শ্রমিকশোষণ নিয়ে, এটা কীভাবে হয়? 

ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ‘এথিক্যাল ট্রেড’ নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠানগুলো চা শিল্পে শ্রমমান, শ্রমিকের জীবনযাত্রার পরিবর্তন নিয়ে কাজ করছে। গড়ে উঠেছে ‘এথিক্যাল টি পার্টনারশিপ’-এর মতো উদ্যোগ। উদাহরণ হিসেবে সেইন্সবুরির মতো কোম্পানির কথা বলা যায়। কোম্পানিটি ইউরোপের বাজারে ভারতীয় চা বিক্রি করে। তারা এই শিল্পের শ্রমিকদের জীবনমান নিয়ে বাগানগুলোর সঙ্গে কাজ করছে। আমাদের গার্মেন্টস শিল্পে ক্রেতা প্রতিষ্ঠান যেভাবে শ্রমিকের জীবনমান নিয়ে কথা বলে, সে রকমই। আমাদের চা শিল্পে তেমনটা নেই। কারণ, আমাদের বিক্রেতা ও ভোক্তা উভয়ই মূলত এ দেশীয়। বাইরের চাপ না এলে আমরা কি আমাদের দেশের শ্রমিকদের কথা ভাবব না? 

পরিস্থিতির পরিবর্তন দরকার। মানুষকে নব্য দাস করে রেখে যে ব্যবসা, তা মানবাধিকার ও শ্রমসংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক নীতিমালার পরিপন্থী। এই খাতে শুধু নগদ মজুরি বৃদ্ধি নয়; সার্বিকভাবে শ্রমিকের প্রাপ্যর বিষয়টির পর্যালোচনা দরকার। মালিক, শ্রমিক, সরকার, শ্রম অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনসহ অন্যান্য অংশীজনদের মতামত গ্রহণ করা ও মূল্যায়ন করার মাধ্যমে পুরো বেতন-ভাতার বিষয়টি ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেওয়া হোক। 

লেখক: বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত ও কলাম লেখক

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত