Ajker Patrika

কার্ল মার্ক্স আর কত দিন বেঁচে থাকবেন

মারুফ ইসলাম
আপডেট : ০৫ মে ২০২৩, ১৬: ৪০
কার্ল মার্ক্স আর কত দিন বেঁচে থাকবেন

লেখকদের দু পয়সা দাম দেয় না যে সমাজ, যে সমাজের মানুষ হরদম হাসাহাসি করে লেখকদের নিয়ে এবং বলে—‘কী হয় লিখে?’ তাদের জন্য এক ‘চপেটাঘাতের মতো উদাহরণ’ হয়ে আছেন কার্ল মার্ক্স। মার্ক্সই সম্ভবত সেই এক এবং অদ্বিতীয় লেখক ও চিন্তক, যাঁর লেখালেখি ও চিন্তা সমগ্র বিশ্বকে আলোড়িত করেছে। মার্ক্সের তত্ত্ব নিয়ে আপত্তি থাকলেও শোষণহীন সমাজের আকাঙ্ক্ষা বামপন্থী তো বটেই, ডানপন্থী, মধ্যপন্থী, গণতন্ত্রপন্থী, স্বৈরপন্থী, এমনকি উগ্র ধর্মপন্থীদের মনেও কোনো না কোনোভাবে জায়গা করে নিয়েছে। 

সুতরাং যাঁরা বলেন লেখালেখি করে কী হয়, তাঁরা যদি তাঁদের চোখের ঠুলি সরিয়ে মার্ক্সের জীবনের দিকে তাকান, তাহলে দেখতে পাবেন, কী প্রবল প্রতিপত্তি ও ক্ষমতা একজন লেখকের। শুধু লেখার মধ্য দিয়ে একজন মানুষ কোটি কোটি মানুষের চিন্তার জগৎ বদলে দিয়েছেন। তাঁর পেটে ভাত ছিল না, গতরে ধোপদুরস্ত কাপড় ছিল না, কিন্তু জগৎকে বদলে দেওয়ার অসীম ক্ষমতা তাঁর ছিল। 

জার্মানির বার্লিনে মার্কস ও এঙ্গেলসের ভাস্কর্যবলা হয়ে থাকে রাশিয়ায় দুজন জার আছেন, অর্থাৎ শাসক আছেন। একজন ক্ষমতাসীন, যিনি সত্যিকার অর্থেই রাষ্ট্রক্ষমতায় আছেন, তিনি আইন ও বল প্রয়োগের মাধ্যমে মানুষদের শাসন করেন। আরেকজন তলস্তয়, যিনি তাঁর লেখা দিয়ে মানুষকে শাসন করে চলেছেন। পাশের দেশ ভারতের অরুন্ধতী রায়ের কথাই ধরুন। মাত্র দুটি উপন্যাস লিখেছেন—গড অব স্মল থিংকস ও দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস। দুটি উপন্যাস আর পত্র-পত্রিকায় কিছু কলাম লিখে তিনি এতটাই ক্ষমতাধর হয়ে উঠেছেন যে খোদ ভারত রাষ্ট্র তাঁকে ভয় পায়। 

মজার বিষয় হচ্ছে, আমাদের সচতুর সমাজ লেখকদের দু পয়সার দাম না দিলেও, তাঁদের কানাকড়ি গুরুত্ব না দিলেও, লেখার যে একটা সর্বপ্লাবী ক্ষমতা আছে, সে ব্যাপারে তারা ওয়াকিবহাল। ফলে প্রায়ই দেখা যায়, আজ তারা ওমুক বইকে নিষিদ্ধ করছে, কাল তারা ওমুক লেখককে দেশছাড়া করছে, পরশু তারা তমুক লেখকের কল্লা কেটে ফেলছে। 

কেন এত ভয়? লিখে যদি কিছু না-ই হয়, লেখালেখি যদি এতই ‘অর্থহীন বাজে কর্ম’ হয়, তাহলে শাসকেরা কেন সেই লেখাকে বাজেয়াপ্ত করেন? কেন লেখকের মাথার দাম নির্ধারণ করেন (ইরানের প্রয়াত সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লা আলী খামেনি ব্রিটিশ লেখক সালমান রুশদির মাথার দাম হিসেবে ৩০ লাখ ডলার পুরস্কার ঘোষণা করেছিলেন)? একটা গুরুত্বহীন কাজ করে, একজন গুরুত্বহীন মানুষ সমাজে যদি কায়ক্লেশে বেঁচে থাকেন, তো শাসকদের অসুবিধা কোথায়? 

১৮৪৮ সালে জার্মান ভাষায় প্রকাশিত কমিউনিস্ট মেনিফেস্টোর প্রথম সংস্করণঅতএব বোঝা যাচ্ছে, অসুবিধা আছে। লেখকেরা সমাজে অস্বস্তি তৈরি করেন। বোঝা যাচ্ছে, কালো কালো ছোট ছোট অক্ষরের এক পাশবিক ক্ষমতা রয়েছে, যে ক্ষমতা অর্থ, প্রতিপত্তি, বাহুবল কিংবা রাষ্ট্রক্ষমতা দিয়ে অর্জন করা যায় না। 

এই দানবিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন মার্ক্স। ফলে তাঁর সংসারে তিনবেলা আহার না জুটলেও, পরনে ছিন্নবস্ত্র শোভা পেলেও, পকেটে মৃত কন্যার জন্য কফিন কেনার টাকা না থাকলেও, এই আপাত নিরীহ, দরিদ্র, কপর্দকশূন্য মানুষটিকে ভীষণ ভয় পেত রাষ্ট্র। তাই জার্মানি নামক রাষ্ট্র তাকে খেদিয়ে দিয়েছে বারবার। তাঁকে জার্মানি থেকে পালিয়ে যেতে হয়েছে ফ্রান্সে। ফ্রান্সেও তিনি অচিরেই রাষ্ট্রের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ান। ফলে ফ্রান্সও তাঁকে খেদিয়ে দেয়। তিনি পাড়ি জমান বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে। ব্রাসেলসে গিয়ে নানা বিপ্লবী লেখা লিখতে শুরু করেন। ফলে বেলজিয়াম থেকেও একসময় বহিষ্কৃত হন মার্ক্স। তিনি আবার ফিরে আসেন ফ্রান্সে। ফ্রান্স তাঁকে কিছুদিন রাখার পর আবার তাড়িয়ে দেয়। তিনি আশ্রয় নেন নিজ দেশ জার্মানিতে। কিন্তু জার্মানিও বেশি দিন সহ্য করতে পারে না মার্ক্সকে। তাড়িয়ে দেয়। মহামতি মার্ক্স তারপর পাড়ি দেন লন্ডনে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ছিলেন এই শহরেই। ব্রিটিশরাজ তাঁকে খেদানোর আগেই অবশ্য পৃথিবী থেকে বিদায় নেন মার্ক্স। 

কার্ল মার্কসের জন্মস্থান। এখানে এখন মার্কসের নামে জাদুঘর রয়েছেএই যে জীবন—যে জীবনের সঙ্গে কদাচ দেখা হয়নি দোয়েলের, ফড়িংয়ের, যে জীবন শুধু শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পালিয়ে বেড়িয়েছে দেশ থেকে দেশে, যে জীবনে ছিল না কোনো সাধ, আহ্লাদ, সচ্ছলতা—এমন এক দ্বীনহীন দরিদ্র জীবনযাপনকারী মানুষকে ভয় পেয়েছে পৃথিবীর প্রতিটি ক্ষমতাধর মানুষ। 

একজন লেখকের শক্তি এখানেই। একজন চিন্তকের ক্ষমতা এখানেই। প্রায় কানাকড়িশূন্য একজন মানুষ শুধু লেখা দিয়ে আর চিন্তা দিয়েই জীবৎকালে শাসন করেছেন গোটা দুনিয়া। মৃত্যুর এত বছর পরেও করে যাচ্ছেন। পৃথিবীর প্রায় সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয় কার্ল মার্ক্সের তত্ত্ব। লাখো ছেলেমেয়ে তাঁর তত্ত্ব পড়েছে। প্রভাবিত হয়েছে। নতুন চিন্তার খোরাক পেয়েছে। পৃথিবীকে, ক্ষমতাকে, রাষ্ট্রকে, বৈষম্যকে নতুনভাবে চেনার সুযোগ পেয়েছে। যারা বলে, লিখে কী হয়, তারা অবশ্য এসব কিছু দেখতে পায় না। আজন্ম তাদের চোখে ঠুলি পড়াই থাকবে। 

আজ এই প্রবল প্রতাপশালীর জন্মদিন। পুরো নাম কার্ল হাইনরিশ মার্ক্স। তিনি ১৮১৮ সালের ৫ মে তৎকালীন জার্মানির প্রাশিয়ার ত্রিভস শহরে সচ্ছল মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

দাস ক্যাপিটালের প্রথম খণ্ডমার্ক্সেের বাবা হার্শেল মার্ক্স ছিলেন পেশায় আইনজীবী। তিনি চেয়েছিলেন, পুত্রও তাঁর মতো আইনজীবী হোক। কিন্তু তাঁর পুত্র যে ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ স্লোগান দিয়ে পৃথিবী বদলে দেবেন, তা কি আর ঘুণাক্ষরে জানতেন! 

শুধু মার্ক্সের বাবাই নন, শিক্ষকেরাও বুঝতে পারেননি, মার্ক্স একদিন ব্রহ্মাণ্ড বদলে দেওয়া দার্শনিক হবেন। কারণ মার্ক্স ছিলেন ছোটবেলা থেকেই ভালো ছাত্র। আর যারা ক্লাসে ভালো ছাত্র থাকেন, তাঁরা শেষ পর্যন্ত আইনজীবী, প্রকৌশলী—এসবই হন। সমাজের রীতিটা এমনই ছিল সে সময়। 

একজন মেধাবী ছাত্র হিসেবে জার্মানির বন ও বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন, দর্শন ও ইতিহাস বিষয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন তিনি। পরে ১৮৪১ সালে ইউনিভার্সিটি অব জেনা থেকে পিএইচডি ডিগ্রিও সম্পন্ন করেছিলেন কার্ল মার্ক্স। 

সবাই ভেবেছিলেন মার্ক্স এবার কোমর বেঁধে আইন পেশায় নামবেন। কিসের আইন পেশা, কিসের কী! শিক্ষাজীবন শেষে সবাইকে অবাক করে দিয়ে কার্ল মার্ক্স যোগ দেন ‘রিনিশে জেইতুং’ নামের একটি পত্রিকায়। ইংরেজিতে বলা হয় ‘রাইনল্যান্ড নিউজ’, বাংলায় বলা যায় ‘রাইনল্যান্ডের খবর’। 

 ১৮৪২ সালে এই পত্রিকার সম্পাদক হয়েছিলেন কার্ল মার্ক্স। এর পরই মূলত তাঁর ক্ষুরধার লেখনী দিয়ে সবাইকে চমকে দেন। জার্মানিজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে তাঁর প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। একসময় পত্রিকাটি বন্ধ করে দেয় তৎকালীন জার্মান সরকার। 

পরের বছর প্রেমিকা জেনি ভন ভেস্তফানেলকে বিয়ে করেন কার্ল মার্ক্স। এরপর তিনি প্যারিসে পাড়ি জমান। শুরু হয় তাঁর অপরিসীম দারিদ্র্য ও ইউরোপীয় রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই। 

কন্যা জেনির সঙ্গে কার্ল মার্কসমার্ক্সের এই লড়াইয়ের সময়ে তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন ফ্রেডরিক এঙ্গেলস। জার্মানির মার্ক্স হয়তো শেষ পর্যন্ত সারা বিশ্বের মার্ক্স হয়ে উঠতে পারতেন না, যদি না এঙ্গেলস তাঁর পাশে থাকতেন অকৃত্রিম বন্ধু হয়ে। 

তবু প্যারিসেও বেশি দিন টিকতে পারেননি কার্ল মার্ক্স। ফ্রান্স সরকার তাঁকে পরিবারসমেত তাড়িয়ে দেয়। ১৮৪৫ সালে তিনি পাড়ি দেন ব্রাসেলসে। এর দুই বছর বাদে ১৮৪৭ সালে মার্ক্স ও এঙ্গেলস যোগ দেন কমিউনিস্ট লিগে এবং ওই একই বছরে এঙ্গেলসের সহযোগিতায় যৌথভাবে রচনা করেন সেই পৃথিবী পাল্টে দেওয়া বই—‘দ্য কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো’। 

এরপর একে একে মার্ক্স লিখে ফেলেন দাস ক্যাপিটাল, দ্য ক্রিটিক অব পলিটিক্যাল ইকোনমি, দ্য পভার্টি অব ফিলোসফি ইত্যাদি। মার্ক্স যখন এসব লিখেছেন, তখন হয়তো স্বপ্নেও ভাবেননি, তিনি আসলে জীবিত থাকতেই অমরত্বের গাথা লিখছেন। এসব লেখাই একদিন তাঁকে কিংবদন্তিতে পরিণত করবে। 

এ কথা সত্য, মার্ক্স তাঁর লেখালেখির মাধ্যমে আদর্শ ও চিন্তাধারা প্রচার করেছেন, তা তাঁর জীবদ্দশায় খুব একটা জনপ্রিয়তা পায়নি। ১৮৮৩ সালের ১৪ মার্চ মারা যান কার্ল মার্ক্স। মৃত্যুর পর তাঁর সমাজতান্ত্রিক চিন্তা গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। পৃথিবীর অনেক রাষ্ট্রনায়ক তাঁর চিন্তাকে গ্রহণ করে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। তবে দুঃখজনক সত্য, মার্ক্সের চিন্তাধারার সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন বিশ্বের কোথাও এখনো হয়নি। তিনি যে শোষণহীন শ্রমজীবী মানুষের সমাজের স্বপ্ন দেখতেন, তা আজও পূরণ হয়নি। 

তবে পৃথিবীতে যতকাল শ্রেণিবৈষম্য বেঁচে থাকবে, ততকাল কার্ল মার্ক্স বেঁচে থাকবেন, তাতে সন্দেহ নেই।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত