মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষক

জহুরা খাতুন
প্রকাশ : ০৫ অক্টোবর ২০২১, ১৮: ৪৯

‘শিক্ষক মোরা শিক্ষক
মানুষের মোরা পরম আত্মীয়
ধরণির মোরা দীক্ষক’—

একজন আদর্শ শিক্ষকের মহান জীবন ব্রত সম্পর্কে একটি অনিন্দ্যসুন্দর অভিব্যক্তি প্রকাশ পায় উক্ত কাব্যছন্দে। তবে, আমরা কি সত্যিই দীক্ষক হতে পেরেছি? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে পত্রিকার একটি লেখায় হঠাৎ চোখ আটকে যায়। যে লেখার শিরোনাম ছিল ‘শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্কে কেন ছন্দপতন’। যেখানে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কয়েকটি ঘটনার বর্ণনা রয়েছে—শিক্ষকদের আচরণ ও কর্মকাণ্ড সম্পর্কে। এর কাছাকাছি ফ্রেমবন্দী ছিল আরেকটি ছবি। তার ক্যাপশন ছিল: ‘বাল্যবিবাহের শিকার স্কুলছাত্রী ক্লাসে এসেছে শিশুসন্তান নিয়ে’। আর সেই শিশুকে কোলে নিয়ে শিক্ষক বোর্ডে লিখলেন: ‘তবুও এগিয়ে যেতে হবে’। এখানে আমি দুটি বিষয়ের অবতারণা করলাম। যার নিয়ামক একজন শিক্ষক। প্রথমে লেখাটি পড়ে অস্বস্তিবোধ করেছিলাম। কিন্তু পরের লেখাটি পড়ে কিছুটা স্বস্তি পেলাম। কারণ পঙ্কজ বড়ুয়ার মতো শিক্ষকেরা এখনো সমাজে আছেন বলে আমরা গর্ব করে বলতে পারি: ‘আমরা মানুষ গড়ার কারিগর বা দ্বিতীয় জন্মদাতা।’ 

আজ বিশ্ব শিক্ষক দিবস। আমার এক শিক্ষার্থীর অনুরোধে এই লেখা লিখলাম। তাহলে বুঝতেই পারছেন, এখনো শিক্ষক-শিক্ষার্থীর একটি মধুর সম্পর্কের বন্ধন রয়েছে বলেই শত ব্যস্ততার মধ্যেও লিখতে রাজি হয়েছি। তাই শিক্ষক-শিক্ষার্থীর এই বন্ধন যেন অটুট থাকে, তার জন্য আমাদের প্রচেষ্টা থাকবে আজীবন। 

একজন সুশিক্ষকের সাধারণত যেসব গুণ থাকা দরকার, তা আমরা মোটামুটি সবাই জানি। যেমন: সৎ, ন্যায়পরায়ণ, ধৈর্যশীল, মানবিক, নম্র ও ভদ্র, দায়িত্বশীল, সময়ানুবর্তী, উদার, রুচিশীল, পরিপাটি মিষ্টভাষী, বন্ধুসুলভ ও শান্ত প্রকৃতির। এ ছাড়া তিনি হবেন আধুনিক চিন্তাভাবনার ধারক। এ পি জে আবদুল কালামের ভাষায়—‘একজন মহান আর আদর্শ শিক্ষকের মধ্যে কয়েকটি বিশেষ গুণ অবশ্যই থাকা উচিত—করুণা, জ্ঞান ও অদম্যশক্তি।’ আর কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের মতে, ‘উত্তম শিক্ষক হবেন উত্তম ছাত্র।’ অর্থাৎ, সুশিক্ষকের সাধনাই হচ্ছে সারা জীবন ছাত্র থাকার অনুধ্যান। সত্যিকার অর্থে এতগুলো গুণের অধিকারী হওয়া কি চাট্টিখানি কথা? এর জন্য প্রয়োজন আজীবন সাধনা। 

জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০-এর শিক্ষার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য মানবতার বিকাশ এবং জনমুখী উন্নয়ন ও প্রগতিতে নেতৃত্বদানের উপযোগী মননশীল, যুক্তিবাদী, নীতিবান, সব ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, কুসংস্কারমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক, দেশপ্রেমিক ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নাগরিক গড়ে তোলা। এ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সামনে রেখেই বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন কর্তব্য পালনকারী ব্যক্তিরা। শিক্ষাক্রম, পাঠ্যসূচি ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নেও যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে। পরীক্ষাপদ্ধতিসহ এ মূল্যায়নে পরিবর্তন আনা হচ্ছে। 

শিক্ষকদের মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সব স্তরের শিক্ষকের জন্য পৃথক বেতন কাঠামো প্রণয়ন করা হবে বলে কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে। এমন আরও পলিসি রয়েছে শিক্ষানীতিতে, যা বাস্তবায়িত হলে আমরা সত্যিই একটি উন্নত জাতিতে পরিণত হব। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, ‘কাজীর গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই।’ 

এই যে আমি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ২০০২ সালে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করে দীর্ঘ ১৮ বছর একই পদে থেকে ২০২১ সালের ৩০ জুন সিনিয়র শিক্ষক পদে পদোন্নতি পেয়েছি। এর পর আর কোনো পদোন্নতি হবে কি না, তা-ও জানি না। এমনটি কি আর অন্য কোনো পেশায় আছে? অথচ জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০-এর ৫৮ পৃষ্ঠায় ৩ নং কৌশলে এ বিষয়ে স্পষ্ট উল্লেখ আছে। 

আমরা যাঁরা শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে শিক্ষকতা করি, তাঁরা প্রতিনিয়ত শত বাধার সম্মুখীন হই। তাই এ ক্ষেত্রে—

১. শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত কমাতে হবে। 
২. শিক্ষকদের শিক্ষকতা ব্যতীত অন্য কাজে সম্পৃক্ততা থেকে বিরত থাকতে হবে। 
৩. সামাজিক মর্যাদা বাড়ানোর লক্ষ্যে পদোন্নতির ব্যবস্থা থাকতে হবে। 
৪. শিক্ষকদের শিশুমনস্ক ও সমাজবিজ্ঞানের আধুনিক ধারার সঙ্গে পরিচিত হতে হবে। 
৫. শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবকসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। 
৬. একজন শিক্ষকের মাথায় থাকতে হবে, ‘শিক্ষককে শিশুর ওপর কর্তৃত্ব করার অধিকার আজ অস্বীকৃত।’ তাই শিশুর প্রতি আন্তরিক হয়ে দায়িত্ব পালন করতে হবে। 

জহুরা খাতুন: সিনিয়র শিক্ষক (বাংলা), নরসিংদী সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত