রেজা করিম ও শাহরিয়ার হাসান
ঢাকা: ২০১৩ সালের ৫ মে। হঠাৎ করে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ঢাকার রাজপথ। দলে দলে মিছিল নিয়ে মতিঝিলের দিকে এগোতে থাকে হাজার হাজার টুপি পরা মানুষ। তাদের সিংহভাগই কওমি মাদ্রাসার শিক্ষক–শিক্ষার্থী। হেফাজতে ইসলাম নামে একটি নতুন সংগঠনের ব্যানারে মিছিল করা এসব মানুষ একপর্যায়ে বসে পড়ে শাপলা চত্বর এলাকায়। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়। শুরু হয় তাণ্ডব। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে পুরো রাজধানীতে। ওই রাতে পুলিশ তাঁদের সরিয়ে দিলেও সেদিনের শোডাউনই হেফাজতকে দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী অরাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। তবে মাত্র আট বছরের ব্যবধানেই সেই উদ্ধত হেফাজত আজ কুপোকাত।
গত আট বছরে নানাভাবে সরকারকে চাপে রেখেছে হেফাজত। সুযোগ পেলেই শক্তি দেখাতে চাওয়া হেফাজত সর্বশেষ তাণ্ডব চালায় সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকালে। তাদের এই কর্মকাণ্ড দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বহির্বিশ্বেও সমালোচিত হয়।
গত ২৫ এপ্রিল রাতে বিলুপ্তির ঘোষণার মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে পতন হয়েছে হেফাজতে ইসলামের। বিলুপ্ত কমিটির আমির জুনাইদ বাবুনগরীর ঘোষণার মধ্য দিয়ে ১১ বছরের পথ চলায় বিরতি নিল সংগঠনটি। সম্প্রতি স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ভারত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির যোগ দেওয়া নিয়ে বিরোধিতা করে আন্দোলনের মাঠ গরম করে হেফাজত। এবারও তাঁরা শাপলা চত্বরের মতো ভয়াল পরিস্থিতি তৈরির পাঁয়তারা চালায়। তবে সরকারের কঠোর অবস্থান এবং নিজেদের ভুলের কারণে পুরোপুরি ভরাডুবি হয়েছে তাঁদের। লন্ডভন্ড হেফাজতকে আর কোনোমতেই ছাড় দিতে চায় না সরকার। এ অবস্থায় হেফাজতের সামনে কঠিন এক আগামী অপেক্ষা করছে।
হেফাজতের উত্থান-পতন
২০১০–এর ১৯ জানুয়ারি জন্ম হয় হেফাজতে ইসলামের। জন্মের পরপরই রাজপথ গরম করে নিজেদের অবস্থানের জানান দেয় কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠনটি। ২০১১ সালে নারী উন্নয়ন নীতিমালার বিরোধিতা করে আন্দোলনের মাঠে নামে হেফাজতে ইসলাম। তবে সে বছর শায়খুল হাদিস আজিজুল হক ও মুফতি ফজলুল হক আমিনীর নেতৃত্বাধীন ওই আন্দোলনে হেফাজতকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। ওই দুই নেতার মৃত্যুর পরে ধীরে ধীরে নিজেদের জানান দিতে শুরু করে সংগঠনটি। ২০১৩ সালে শাহবাগে ব্লগারদের উপস্থিতি ও তাঁদের লেখাকে ইস্যু করে সামনে চলে আসে হেফাজত। ওই বছরের ফেব্রুয়ারিতে ব্লগার রাজিব হায়দারের ফেসবুক স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে হেফাজতের আমির শাহ আহমদ শফী দেশের বয়োজ্যেষ্ঠ আলেমদের নিয়ে হাটহাজারীতে আলোচনায় বসেন। সে আলোচনার সিদ্ধান্তেই ৫ এপ্রিল ২০১৩ শাপলা চত্বরে সমাবেশ করে হেফাজত। সেদিনই প্রথমবারের মতো রাজধানীতে জোরেশোরে নিজেদের উত্থানের জানান দেয় সংগঠনটি।
সম্প্রতি মোদিবিরোধী আন্দোলনে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালনের নামে অশান্ত হয়ে ওঠে হেফাজত। ২৬, ২৭ ও ২৮ মার্চের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে কমপক্ষে ১৭ জন মানুষ প্রাণ হারান। আহত হন আরও অনেকে। ক্ষতির সম্মুখীন হয় বিপুল সম্পদ। গত ৩ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের একটি রিসোর্টে নারীসহ অবরুদ্ধ হন হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক। এ অবস্থায় হেফাজতের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে যায় সরকার। এরপর আট বছর আগে করা ‘সরকার উৎখাতে উসকানি’ দেওয়ার ৬৮টি মামলার তদন্ত নতুন করে সক্রিয় হয়। নতুন করে দায়ের হয় ১৪৪টি মামলা। আসামি করা হয়েছে ৩ হাজার ২০০ জনকে। অজ্ঞাতনামা আসামি আছে প্রায় ৮০ হাজার। নতুন-পুরোনো মামলায় এরই মধ্যে হেফাজতের প্রায় ৯০০ নেতা–কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ২০ জনসহ ৩৫ জন কেন্দ্রীয় নেতা রয়েছেন। ১১ এপ্রিল হেফাজতের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদীকে গ্রেপ্তার করে এই অভিযান শুরু করে পুলিশ। এরই ধারাবাহিকতায় ১৮ এপ্রিল আলোচিত মামুনুল হক গ্রেপ্তার হন।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার শফিকুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা হেফাজতের পুরোনো মামলাগুলো গুছিয়ে এনেছি। নতুন মামলাগুলোর কয়েকটি সিআইডি ও পিবিআই তদন্ত করছে। আগামী দু-এক মাসের মধ্যে মামলাগুলোর তদন্ত শেষ করা হবে।’
একের পর এক কেন্দ্রীয় নেতার গ্রেপ্তার আর মামলার ভারে নুয়ে পড়া হেফাজত সমঝোতার পথ বেছে নিয়ে সরকারের মন গলানোর চেষ্টা করে। তবে কোনো চেষ্টাই কাজে আসেনি। এ পরিস্থতিতে ২৫ এপ্রিল রাতে হেফাজতের কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। বর্তমানে সংগঠন চলছে ৫ সদস্যবিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে। এরপরেও থামেনি গ্রেপ্তার অভিযান।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, হেফাজতের পরিচয় ও উদ্দেশ্য অস্পষ্ট। তারা নিজেদের অরাজনৈতিক বললেও তাদের কর্মকাণ্ডে রাজনীতি আছে। তাঁদের স্ববিরোধী আচরণ প্রমাণ করে যে রাজনীতির বিষয়ে তাদের স্পষ্ট কোনো ধারণা নেই। কাজেই তাঁদের পতন অনিবার্য। অন্যদিকে হাতেনাতে প্রমাণ না থাকলেও এটা বোঝা যায়, হেফাজতে ওপরের সারির নেতারা কারো না কারও স্বার্থ রক্ষায় কাজ করছেন। অন্যদিকে হেফাজতকে এখানে অনেক বড় করে তোলা হয়েছে নানাভাবে। ঠিক যতটা না, তার অনেক বড় করে দেখানো হয়েছে।
রাজনীতির জন্য হেফাজতকে বড় কোনো ফ্যাক্টর মনে করেন না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘হেফাজতকে বড় করে দেখানো হলেও সারা দেশে তাদের মূলত দুইটা মাত্র পকেট। একটা পকেট ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়, আরেকটা চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে। এই দুইটা পকেট দিয়ে তাঁরা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে ফেলবে, এই শক্তি তাঁদের নেই। তাঁরা হয়তো উত্তেজনা ছড়াতে পারবে, যেটা তাঁরা করেছে। কিন্তু শেষমেশ তাঁদের পতনও হয়েছে।’
হেফাজতের করুণ পরিণতির জন্য সংগঠনের নেতা–কর্মীদের অনেকেই বলছেন, বিভক্তিই এ পরিণতি ডেকে এনেছে। সংগঠনের বর্তমান নাজুক পরিস্থিতির জন্য হেফাজতের বিলুপ্ত কমিটির নীতি নির্ধারকদেরও দায়ী করেছেন কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকে। তাঁরা বলেন, 'জুনাইদ বাবুনগরী ও তাঁর একান্ত অনুসারীদের স্বেচ্ছাচারিতার কারণে আজ এমন পরিণতি হয়েছে। হেফাজত বিভক্ত না হলে হয়তো আজ এ অবস্থা দেখতে হতো না।'
২০২০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর হেফাজতে ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা ও আমির আহমদ শাহ শফীর মৃত্যু হয়। ১৫ নভেম্বর নতুন কমিটি হয়। এই কমটিতে শফীপন্থীরা জায়গা না পাওয়ায় সংগঠনে বিদ্রোহী একটি পক্ষ দাঁড়িয়ে যায়। এ পক্ষটি শফীপুত্র আনাস মাদানীকে নিয়ে হেফাজতে ইসলামকে নিয়ে নতুন করে পরিকল্পনা করে আসছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে এ পক্ষটি তৎপর হয়ে উঠেছে। তাঁরাই এখন ব্যস্ত হেফাজতকে নতুনভাবে সাজাতে।
এরই মধ্যে আহমদ শফীর ২৫ হাজার মুরিদ ও খলিফার তালিকা তৈরি করে তাঁদের সক্রিয় করার প্রক্রিয়া চলছে। নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করছে তাঁরা। আলেম-ওলামাদের সঙ্গেও আলোচনা চলছে। সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও এ বিষয়ে যোগাযোগ রক্ষা করছেন তাঁরা।
হেফাজতে ইসলামের সাবেক যুগ্ম মহাসচিব মাঈনুদ্দীন রুহী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘হেফাজতের আগামী দিনে কী হবে, না হবে, সেটা আমরাই নির্ধারণ করব। আহমদ শফীর আদর্শের আলোকে হেফাজতের আগামী দিনের নেতৃত্ব গড়ে উঠবে। এ লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি।’
বিরোধী পক্ষের এ চাপ নিয়েও চিন্তায় আছে হেফাজতের বর্তমান নেতৃত্ব। বিশেষ করে ওই পক্ষটি সরকারঘেঁষা বলে চিন্তাটা আরও বেশি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সরকার ও হেফাজতের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী ১৪ দলের এক নেতা বলেছেন, সরকার বাবুনগরী ও তাঁর অনুসারীদের নিয়ে করা হেফাজতকে কোনোভাবেই মানতে পারছে না। এরই মধ্যে আমিরের জন্য নতুন কাউকে খোঁজা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে হেফাজতে ইসলামের আহ্বায়ক কমিটির সদস্যসচিব নেতা নুরুল ইসলাম জিহাদী বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না।’
হেফাজত কারও নয়
রাজনৈতিক স্বার্থে হেফাজতকে ব্যবহারের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ থাকলেও সংগঠনটির দায় নিতে চায় না কেউ। বিএনপির অভিযোগ, হেফাজতে ইসলাম শুরু থেকেই ক্ষমতাসীন সরকারের মাধ্যমে প্রতিপালিত হয়ে আসছে। সংগঠনটির বেড়ে ওঠা, কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিসের স্বীকৃতি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘কওমি জননী’ উপাধি, হেফাজতের শীর্ষনেতৃত্বের সঙ্গে সরকারের উচ্চপর্যায়ের নিয়মিত যোগাযোগের মধ্য দিয়ে তারই প্রমাণ পাওয়া গেছে।
হেফাজতের কর্মসূচি ঘিরে সংঘটিত সাম্প্রতিক তাণ্ডবের জন্য সরকার দলের পক্ষ থেকে বিএনপিকে দায়ী করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘দেশের বিভিন্ন স্থানে উগ্র-সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর তাণ্ডবলীলায় যে বিএনপি জড়িত, তা দিবালোকের মতো পরিষ্কার।’
জবাবে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘সরকারের নেতা, মন্ত্রী, অনেক মিডিয়ায় প্রচার করা হয়েছে ‘হেফাজতকে বিএনপি ইন্ধন দিয়েছে, কর্মসূচি পালনে সমর্থন দিয়েছে।’ কিন্তু হেফাজতের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই।’
ক্যালেন্ডারে হেফাজতের কর্মসূচি
২০১১: নারী-পুরুষের সমানাধিকার নিশ্চিত করতে ‘নারী উন্নয়ন নীতিমালা’ ঘোষিত হওয়ার পরপরই সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠে সংগঠনটি।
২০১৩: দেশে ইসলামি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দাবিতে ১৩ দফা উত্থাপন করে। দাবিগুলোর বেশ কয়েকটি ধারা বাংলাদেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ৫ মে শাপলা চত্বরের ঘটনা এখনো মানুষের মনকে নাড়িয়ে দেয়।
২০১৪: ৫ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হেফাজতে ইসলাম অংশ নেবে এমন প্রচারও ছিল। শেষ পর্যন্ত তারা অবশ্য নির্বাচনে যায়নি। সংগঠনটির বিরুদ্ধে সরকার সমর্থক ও সরকারবিরোধী দুই অংশের কাছ থেকেই আর্থিক সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ ওঠে। ১১ এপ্রিল এক সমাবেশে আহমদ শফী বলেন, ‘হাসিনা সরকার, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ সবাই আমাদের বন্ধু।’
২০১৭: সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে স্থাপন করা গ্রিক দেবীর ভাস্কর্য অপসারণে বিক্ষোভ করে হেফাজত। বিক্ষোভ সমাবেশে হেফাজত নেতারা হুমকি দেন, সুপ্রিম কোর্ট চত্বর থেকে ভাস্কর্যটি অপসারণ করা না হলে ‘শাপলা চত্বরের মতো পরিস্থিতি’ তৈরি হতে পারে।
২০২০: বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য অপসারণের দাবি করে হেফাজতে ইসলাম।
২০২১: ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের বিরোধিতা করে আক্রমণাত্মক কর্মসূচি পালন করে। এসব কর্মসূচি ঘিরে সহিংসতায় ১৭ জন প্রাণ হারান।
ঢাকা: ২০১৩ সালের ৫ মে। হঠাৎ করে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ঢাকার রাজপথ। দলে দলে মিছিল নিয়ে মতিঝিলের দিকে এগোতে থাকে হাজার হাজার টুপি পরা মানুষ। তাদের সিংহভাগই কওমি মাদ্রাসার শিক্ষক–শিক্ষার্থী। হেফাজতে ইসলাম নামে একটি নতুন সংগঠনের ব্যানারে মিছিল করা এসব মানুষ একপর্যায়ে বসে পড়ে শাপলা চত্বর এলাকায়। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়। শুরু হয় তাণ্ডব। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে পুরো রাজধানীতে। ওই রাতে পুলিশ তাঁদের সরিয়ে দিলেও সেদিনের শোডাউনই হেফাজতকে দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী অরাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। তবে মাত্র আট বছরের ব্যবধানেই সেই উদ্ধত হেফাজত আজ কুপোকাত।
গত আট বছরে নানাভাবে সরকারকে চাপে রেখেছে হেফাজত। সুযোগ পেলেই শক্তি দেখাতে চাওয়া হেফাজত সর্বশেষ তাণ্ডব চালায় সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকালে। তাদের এই কর্মকাণ্ড দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বহির্বিশ্বেও সমালোচিত হয়।
গত ২৫ এপ্রিল রাতে বিলুপ্তির ঘোষণার মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে পতন হয়েছে হেফাজতে ইসলামের। বিলুপ্ত কমিটির আমির জুনাইদ বাবুনগরীর ঘোষণার মধ্য দিয়ে ১১ বছরের পথ চলায় বিরতি নিল সংগঠনটি। সম্প্রতি স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ভারত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির যোগ দেওয়া নিয়ে বিরোধিতা করে আন্দোলনের মাঠ গরম করে হেফাজত। এবারও তাঁরা শাপলা চত্বরের মতো ভয়াল পরিস্থিতি তৈরির পাঁয়তারা চালায়। তবে সরকারের কঠোর অবস্থান এবং নিজেদের ভুলের কারণে পুরোপুরি ভরাডুবি হয়েছে তাঁদের। লন্ডভন্ড হেফাজতকে আর কোনোমতেই ছাড় দিতে চায় না সরকার। এ অবস্থায় হেফাজতের সামনে কঠিন এক আগামী অপেক্ষা করছে।
হেফাজতের উত্থান-পতন
২০১০–এর ১৯ জানুয়ারি জন্ম হয় হেফাজতে ইসলামের। জন্মের পরপরই রাজপথ গরম করে নিজেদের অবস্থানের জানান দেয় কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠনটি। ২০১১ সালে নারী উন্নয়ন নীতিমালার বিরোধিতা করে আন্দোলনের মাঠে নামে হেফাজতে ইসলাম। তবে সে বছর শায়খুল হাদিস আজিজুল হক ও মুফতি ফজলুল হক আমিনীর নেতৃত্বাধীন ওই আন্দোলনে হেফাজতকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। ওই দুই নেতার মৃত্যুর পরে ধীরে ধীরে নিজেদের জানান দিতে শুরু করে সংগঠনটি। ২০১৩ সালে শাহবাগে ব্লগারদের উপস্থিতি ও তাঁদের লেখাকে ইস্যু করে সামনে চলে আসে হেফাজত। ওই বছরের ফেব্রুয়ারিতে ব্লগার রাজিব হায়দারের ফেসবুক স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে হেফাজতের আমির শাহ আহমদ শফী দেশের বয়োজ্যেষ্ঠ আলেমদের নিয়ে হাটহাজারীতে আলোচনায় বসেন। সে আলোচনার সিদ্ধান্তেই ৫ এপ্রিল ২০১৩ শাপলা চত্বরে সমাবেশ করে হেফাজত। সেদিনই প্রথমবারের মতো রাজধানীতে জোরেশোরে নিজেদের উত্থানের জানান দেয় সংগঠনটি।
সম্প্রতি মোদিবিরোধী আন্দোলনে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালনের নামে অশান্ত হয়ে ওঠে হেফাজত। ২৬, ২৭ ও ২৮ মার্চের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে কমপক্ষে ১৭ জন মানুষ প্রাণ হারান। আহত হন আরও অনেকে। ক্ষতির সম্মুখীন হয় বিপুল সম্পদ। গত ৩ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের একটি রিসোর্টে নারীসহ অবরুদ্ধ হন হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক। এ অবস্থায় হেফাজতের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে যায় সরকার। এরপর আট বছর আগে করা ‘সরকার উৎখাতে উসকানি’ দেওয়ার ৬৮টি মামলার তদন্ত নতুন করে সক্রিয় হয়। নতুন করে দায়ের হয় ১৪৪টি মামলা। আসামি করা হয়েছে ৩ হাজার ২০০ জনকে। অজ্ঞাতনামা আসামি আছে প্রায় ৮০ হাজার। নতুন-পুরোনো মামলায় এরই মধ্যে হেফাজতের প্রায় ৯০০ নেতা–কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ২০ জনসহ ৩৫ জন কেন্দ্রীয় নেতা রয়েছেন। ১১ এপ্রিল হেফাজতের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদীকে গ্রেপ্তার করে এই অভিযান শুরু করে পুলিশ। এরই ধারাবাহিকতায় ১৮ এপ্রিল আলোচিত মামুনুল হক গ্রেপ্তার হন।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার শফিকুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা হেফাজতের পুরোনো মামলাগুলো গুছিয়ে এনেছি। নতুন মামলাগুলোর কয়েকটি সিআইডি ও পিবিআই তদন্ত করছে। আগামী দু-এক মাসের মধ্যে মামলাগুলোর তদন্ত শেষ করা হবে।’
একের পর এক কেন্দ্রীয় নেতার গ্রেপ্তার আর মামলার ভারে নুয়ে পড়া হেফাজত সমঝোতার পথ বেছে নিয়ে সরকারের মন গলানোর চেষ্টা করে। তবে কোনো চেষ্টাই কাজে আসেনি। এ পরিস্থতিতে ২৫ এপ্রিল রাতে হেফাজতের কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। বর্তমানে সংগঠন চলছে ৫ সদস্যবিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে। এরপরেও থামেনি গ্রেপ্তার অভিযান।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, হেফাজতের পরিচয় ও উদ্দেশ্য অস্পষ্ট। তারা নিজেদের অরাজনৈতিক বললেও তাদের কর্মকাণ্ডে রাজনীতি আছে। তাঁদের স্ববিরোধী আচরণ প্রমাণ করে যে রাজনীতির বিষয়ে তাদের স্পষ্ট কোনো ধারণা নেই। কাজেই তাঁদের পতন অনিবার্য। অন্যদিকে হাতেনাতে প্রমাণ না থাকলেও এটা বোঝা যায়, হেফাজতে ওপরের সারির নেতারা কারো না কারও স্বার্থ রক্ষায় কাজ করছেন। অন্যদিকে হেফাজতকে এখানে অনেক বড় করে তোলা হয়েছে নানাভাবে। ঠিক যতটা না, তার অনেক বড় করে দেখানো হয়েছে।
রাজনীতির জন্য হেফাজতকে বড় কোনো ফ্যাক্টর মনে করেন না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘হেফাজতকে বড় করে দেখানো হলেও সারা দেশে তাদের মূলত দুইটা মাত্র পকেট। একটা পকেট ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়, আরেকটা চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে। এই দুইটা পকেট দিয়ে তাঁরা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে ফেলবে, এই শক্তি তাঁদের নেই। তাঁরা হয়তো উত্তেজনা ছড়াতে পারবে, যেটা তাঁরা করেছে। কিন্তু শেষমেশ তাঁদের পতনও হয়েছে।’
হেফাজতের করুণ পরিণতির জন্য সংগঠনের নেতা–কর্মীদের অনেকেই বলছেন, বিভক্তিই এ পরিণতি ডেকে এনেছে। সংগঠনের বর্তমান নাজুক পরিস্থিতির জন্য হেফাজতের বিলুপ্ত কমিটির নীতি নির্ধারকদেরও দায়ী করেছেন কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকে। তাঁরা বলেন, 'জুনাইদ বাবুনগরী ও তাঁর একান্ত অনুসারীদের স্বেচ্ছাচারিতার কারণে আজ এমন পরিণতি হয়েছে। হেফাজত বিভক্ত না হলে হয়তো আজ এ অবস্থা দেখতে হতো না।'
২০২০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর হেফাজতে ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা ও আমির আহমদ শাহ শফীর মৃত্যু হয়। ১৫ নভেম্বর নতুন কমিটি হয়। এই কমটিতে শফীপন্থীরা জায়গা না পাওয়ায় সংগঠনে বিদ্রোহী একটি পক্ষ দাঁড়িয়ে যায়। এ পক্ষটি শফীপুত্র আনাস মাদানীকে নিয়ে হেফাজতে ইসলামকে নিয়ে নতুন করে পরিকল্পনা করে আসছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে এ পক্ষটি তৎপর হয়ে উঠেছে। তাঁরাই এখন ব্যস্ত হেফাজতকে নতুনভাবে সাজাতে।
এরই মধ্যে আহমদ শফীর ২৫ হাজার মুরিদ ও খলিফার তালিকা তৈরি করে তাঁদের সক্রিয় করার প্রক্রিয়া চলছে। নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করছে তাঁরা। আলেম-ওলামাদের সঙ্গেও আলোচনা চলছে। সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও এ বিষয়ে যোগাযোগ রক্ষা করছেন তাঁরা।
হেফাজতে ইসলামের সাবেক যুগ্ম মহাসচিব মাঈনুদ্দীন রুহী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘হেফাজতের আগামী দিনে কী হবে, না হবে, সেটা আমরাই নির্ধারণ করব। আহমদ শফীর আদর্শের আলোকে হেফাজতের আগামী দিনের নেতৃত্ব গড়ে উঠবে। এ লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি।’
বিরোধী পক্ষের এ চাপ নিয়েও চিন্তায় আছে হেফাজতের বর্তমান নেতৃত্ব। বিশেষ করে ওই পক্ষটি সরকারঘেঁষা বলে চিন্তাটা আরও বেশি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সরকার ও হেফাজতের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী ১৪ দলের এক নেতা বলেছেন, সরকার বাবুনগরী ও তাঁর অনুসারীদের নিয়ে করা হেফাজতকে কোনোভাবেই মানতে পারছে না। এরই মধ্যে আমিরের জন্য নতুন কাউকে খোঁজা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে হেফাজতে ইসলামের আহ্বায়ক কমিটির সদস্যসচিব নেতা নুরুল ইসলাম জিহাদী বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না।’
হেফাজত কারও নয়
রাজনৈতিক স্বার্থে হেফাজতকে ব্যবহারের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ থাকলেও সংগঠনটির দায় নিতে চায় না কেউ। বিএনপির অভিযোগ, হেফাজতে ইসলাম শুরু থেকেই ক্ষমতাসীন সরকারের মাধ্যমে প্রতিপালিত হয়ে আসছে। সংগঠনটির বেড়ে ওঠা, কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিসের স্বীকৃতি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘কওমি জননী’ উপাধি, হেফাজতের শীর্ষনেতৃত্বের সঙ্গে সরকারের উচ্চপর্যায়ের নিয়মিত যোগাযোগের মধ্য দিয়ে তারই প্রমাণ পাওয়া গেছে।
হেফাজতের কর্মসূচি ঘিরে সংঘটিত সাম্প্রতিক তাণ্ডবের জন্য সরকার দলের পক্ষ থেকে বিএনপিকে দায়ী করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘দেশের বিভিন্ন স্থানে উগ্র-সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর তাণ্ডবলীলায় যে বিএনপি জড়িত, তা দিবালোকের মতো পরিষ্কার।’
জবাবে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘সরকারের নেতা, মন্ত্রী, অনেক মিডিয়ায় প্রচার করা হয়েছে ‘হেফাজতকে বিএনপি ইন্ধন দিয়েছে, কর্মসূচি পালনে সমর্থন দিয়েছে।’ কিন্তু হেফাজতের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই।’
ক্যালেন্ডারে হেফাজতের কর্মসূচি
২০১১: নারী-পুরুষের সমানাধিকার নিশ্চিত করতে ‘নারী উন্নয়ন নীতিমালা’ ঘোষিত হওয়ার পরপরই সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠে সংগঠনটি।
২০১৩: দেশে ইসলামি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দাবিতে ১৩ দফা উত্থাপন করে। দাবিগুলোর বেশ কয়েকটি ধারা বাংলাদেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ৫ মে শাপলা চত্বরের ঘটনা এখনো মানুষের মনকে নাড়িয়ে দেয়।
২০১৪: ৫ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হেফাজতে ইসলাম অংশ নেবে এমন প্রচারও ছিল। শেষ পর্যন্ত তারা অবশ্য নির্বাচনে যায়নি। সংগঠনটির বিরুদ্ধে সরকার সমর্থক ও সরকারবিরোধী দুই অংশের কাছ থেকেই আর্থিক সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ ওঠে। ১১ এপ্রিল এক সমাবেশে আহমদ শফী বলেন, ‘হাসিনা সরকার, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ সবাই আমাদের বন্ধু।’
২০১৭: সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে স্থাপন করা গ্রিক দেবীর ভাস্কর্য অপসারণে বিক্ষোভ করে হেফাজত। বিক্ষোভ সমাবেশে হেফাজত নেতারা হুমকি দেন, সুপ্রিম কোর্ট চত্বর থেকে ভাস্কর্যটি অপসারণ করা না হলে ‘শাপলা চত্বরের মতো পরিস্থিতি’ তৈরি হতে পারে।
২০২০: বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য অপসারণের দাবি করে হেফাজতে ইসলাম।
২০২১: ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের বিরোধিতা করে আক্রমণাত্মক কর্মসূচি পালন করে। এসব কর্মসূচি ঘিরে সহিংসতায় ১৭ জন প্রাণ হারান।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান বলেছেন, আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের অন্য নেতাকর্মীরা ভারত ও অন্য দেশে অবস্থান করে বাংলাদেশে বিশৃঙ্খলা তৈরি করে অস্থিতিশীলতা তৈরির চেষ্টা করছে।
১ ঘণ্টা আগেনতুন নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব গ্রহণকে স্বাগত জানিয়েছে বিএনপি। জনগণের প্রত্যাশা পূরণে নতুন কমিশন কাজ করবে বলেও আশা প্রকাশ করেছে দলটি
২১ ঘণ্টা আগেরাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের অপসারণ চেয়ে তাঁর নিয়োগ দেওয়া নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) প্রত্যাখ্যান করেছে জাতীয় নাগরিক কমিটি। একই সঙ্গে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের প্রাপ্ত প্রস্তাবের আলোকে নতুন আইনের অধীনে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের দাবি জানিয়েছেন তারা
১ দিন আগেড. কামাল হোসেন আর গণফোরামের সঙ্গে যুক্ত নন এবং তিনি রাজনীতি থেকে অবসর নিয়েছেন—বলে জানিয়েছেন নিজেকে গণফোরামের সভাপতি দাবি করা এবং সাবেক সংসদ সদস্য মফিজুল ইসলাম খান কামাল।
২ দিন আগে