মানুষ খুশিতে কেঁদে ফেলে কেন?

প্রমিতি কিবরিয়া ইসলাম, ঢাকা 
আপডেট : ২৯ মার্চ ২০২৪, ০৯: ৫০
Thumbnail image

মানুষ কষ্টের সময় কান্না করে—এটি খুবই সাধারণ ব্যাপার। তবে কেউ কেউ খুশির খবর শুনেও কান্না জুড়ে দেয়! খুশির কান্না অন্যদের বিভ্রান্ত করলেও এটিও একটি স্বাভাবিক আচরণ।

খুশির কান্না নির্দিষ্ট বয়স ও লিঙ্গর সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। এই ধরনের ঘটনা যে কোনো বয়স ও লিঙ্গের মানুষের মধ্যে ঘটতে পারে। তবে এই ধরনের আচরণের পেছনের কারণ স্পষ্ট না হলেও বিজ্ঞানীরা কয়েকটি সম্ভাব্য বিষয় চিহ্নিত করেছেন।

খুশির কান্না নির্দিষ্ট বয়স ও লিঙ্গর সঙ্গে সম্পর্কিত নয়।কান্না চরম আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে
বেশির ভাগ মানুষ দুঃখ, রাগ ও হতাশাকে নেতিবাচক বলে মনে করে। মানুষ সাধারণত সুখী হতে চায়। সুখের সময়কে নেতিবাচক হিসেবে দেখে এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া কঠিন। তাহলে খুশির সময় মাঝে মাঝে মানুষ কান্না করে কেন!

অন্য আবেগের সঙ্গে সুখের মিল আছে। আবেগ ইতিবাচক বা নেতিবাচক যা–ই হোক কেনা কেন, এটি সব সময় তীব্র অনুভূতি তৈরি করতে পারে।

২০১৫ সালের এক গবেষণায় বলা হয়, খুশির কান্নার সময় মানুষ আবেগগুলো এত তীব্রভাবে অনুভব করে যে, সেগুলো নিয়ন্ত্রণের অযোগ্য হয়ে যায়। যখন এই আবেগগুলো মানুষকে অভিভূত করতে শুরু করে তখন তা প্রকাশ করার জন্য মানুষ কেঁদে ফেলে বা চিৎকার করে।

দ্বিরূপ অভিব্যক্তি
খুশির কান্না দ্বিরূপ অভিব্যক্তি প্রকাশের একটি দুর্দান্ত উদাহরণ। দ্বিরূপ মানে মানুষের ‘দুটি রূপ’কে বোঝানো হয়। আবেগের অভিব্যক্তিগুলো মানুষের মস্তিষ্কের একই স্থান থেকে আসে, তবে বিভিন্ন উপায়ে প্রদর্শিত হয়।

অনেক সময় বড়রা আদর করতে গিয়ে শিশুর গাল টিপে দেয়। এই আচরণ অবশ্যই শিশুকে আঘাত করার জন্য নয়। আক্রমণাত্মক এই অভিব্যক্তি কিছুটা অদ্ভুত বলে মনে হতে পারে, তবে এটির একটি সরল ব্যাখ্যা রয়েছে। ছোট শিশুকে দেখে অনুভূতিগুলো এতটাই তীব্র হয় যে, তখন সেগুলো কীভাবে পরিচালনা করবে এটি মানুষ বুঝে উঠতে পারে না। 

আবেগের ভারসাম্য রক্ষা
আবেগকে সঠিকভাবে পরিচালিত করতে না পারলে পরিণতি নেতিবাচক হতে পারে। আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে মোটামুটি বেগ পেতে হয়, এমন মানুষের মনমেজাজ হুটহাট পরিবর্তন হতে পারে বা তারা এলোমেলো আচরণ করতে পারে।

তাই এই খুশির কান্না চরম অনুভূতিতে কিছুটা ভারসাম্য রক্ষা করতে সাহায্য করে। এটি না হলে এই আবেগ মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। তাই চরম অনুভূতির সময় নিজেকে শান্ত করার জন্য কান্নাকাটি বেশ কাজে আসতে পারে! 

অন্যের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম
যখন কেউ কোনো ছোট কারণে কান্না করে, সেটি আসলে আরেকজনের কাছে একটি বার্তা পাঠায়। কান্নার মাধ্যমে অন্যরা জানতে পারে যে, ব্যক্তির আবেগ তাকে অভিভূত করেছে। ফলে অন্যরা বুঝে যায়, তাকে মানসিকভাবে সমর্থন বা সান্ত্বনা দেওয়া দরকার।

অনেকে কিন্তু তার খুশি ও আনন্দের সময়ও প্রিয়জনদের সমর্থন চাইতে পারে। ২০০৯ সালের এক গবেষণায় জানা যায়, মানুষ সুখ, আনন্দ এমনকি ভালোবাসার জন্য যে আবেগগুলো অনুভব করে তা অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চায়।

মানুষ সামাজিক জীব। এই সামাজিক প্রকৃতি চরম অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেওয়ার আকাঙ্ক্ষা তৈরিতে ভূমিকা রাখতে পারে। পাশাপাশি ভালো বা খারাপ সময়ে মানুষ সংহতি ও স্বাচ্ছন্দ্যের সন্ধান করে। তাই খুশির কান্না অন্যদের সঙ্গে আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার একটি বার্তা।

গবেষকেরা আরও উল্লেখ করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি অর্জন, বিয়ে বা দেশে ফেরার মতো উল্লেখযোগ্য ঘটনা এই বার্তার গুরুত্ব বাড়াতে পারে।

কান্না করলে ভালো অনুভূত হয়
অনেকেই কান্নাকাটি পছন্দ করে না। কান্নার পর মাথাব্যথা হয়, সর্দি হয়। এসব নানা কারণে অনেকেই এই আচরণকে অপছন্দ করে। তবে কান্নার সুফল রয়েছে। যেমন: 

সুখের হরমোন
কান্নার ফলে দেহে এন্ডোরফিন ও অক্সিটোসিন হরমোন ক্ষরিত হয়। এগুলো শরীরের ব্যথা উপশমে, মেজাজ ভালো রাখতে ও সাধারণ সুস্থতার উন্নতি করতে সাহায্য করে।

যেহেতু কান্নার মাধ্যমে অন্যদের কাছ থেকে সান্ত্বনা ও সমর্থন আকর্ষণ করা যায়; তাই মানুষের সঙ্গে সংযোগের অনুভূতি বাড়াতে সাহায্য করে কান্না যা ব্যক্তির মেজাজ ও সামগ্রিক সুস্থতা উন্নত করতে সাহায্য করে।

দুঃখ ও ক্রোধ থেকে সৃষ্ট কান্না আবেগ প্রশমিত করতে সাহায্য করতে পারে। কিন্তু সুখের জন্য কাঁদলে অক্সিটোসিন, এন্ডোরফিন হরমোন ক্ষরিত হয় এবং সামাজিক সমর্থন পেয়ে মানুষের মধ্যে আরও ভালো অনুভূতির সৃষ্টি হতে পারে।

মানসিক মুক্তি
অনেক আনন্দের মুহূর্ত হুট করে আসে না। বিয়ে করা, সন্তান জন্ম, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করা, স্বপ্নের চাকরিতে নিয়োগ পাওয়ার মতো সাফল্যগুলো মানুষ সহজে পায় না। মাইলফলকগুলো অর্জনের জন্য অনেককেই প্রচুর পরিশ্রম, সময় ব্যয় ও ধৈর্য ধরতে হয়। এসব অর্জন করার পর দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার ফলে মানুষের কান্না পায়।

আবেগের পার্থক্য নিরূপণে বিভ্রান্তি 
সুখের কান্না নিয়ে আরেকটি তত্ত্ব রয়েছে: বিভিন্ন সূত্রের মতে, এই কান্নার কারণ হলো—মস্তিষ্ক অনেক সময় তীব্র আবেগগুলোর মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না। 

দুঃখ, রাগ বা আনন্দের মতো শক্তিশালী আবেগ অনুভব করার সময় মস্তিষ্কের অ্যামিগডালা নামের অঞ্চলটি সেই আবেগকে চিহ্নিত করে ও মস্তিষ্কের আরেকটি অংশ হাইপোথ্যালামাসে একটি সংকেত পাঠায়।

স্নায়ুতন্ত্রে সংকেত পাঠিয়ে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে মস্তিষ্ক। কিন্তু হাইপোথ্যালামাস ঠিক কোন অনুভূতির সম্মুখীন হয়েছেন তা স্নায়ুতন্ত্রকে জানায় না। কারণ হাইপোথ্যালামাসও এই অনুভূতি সম্পর্কে নিশ্চিত নয়।

স্নায়ুতন্ত্রের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর মধ্যে একটি হলো মানুষের চাপের প্রতিক্রিয়া জানাতে সাহায্য করা। কেউ যখন হুমকির সম্মুখীন হয় তখন স্নায়ুতন্ত্রের সহানুভূতিশীল শাখা প্রতিরোধ বা পালিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত করে।

হুমকি প্রশমিত হওয়ার পরে স্নায়ুতন্ত্রের প্যারাসিমপ্যাথেটিক শাখা মানুষকে শান্ত হতে সাহায্য করে।

একইভাবে হাইপোথ্যালামাস অভিভূত হওয়ার সংকেত পাঠালে স্নায়ুতন্ত্র কান্নার জন্য তাড়না দেয়। এর মাধ্যমে খুশি ও দুঃখের আবেগ প্রশমিত হয়। 

তথ্যসূত্র: হেলথলাইন

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত