যেখানে ভেঙে পড়ে নিউটন-আইনস্টাইনের সূত্র, মহাকর্ষের ধারণা বদলের ইঙ্গিত

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ১৮ আগস্ট ২০২৩, ২৩: ১৫
Thumbnail image

আইজ্যাক নিউটন তাঁর সর্বজনীন মহাকর্ষ সূত্র প্রকাশ করেন ১৬৮৭ সালে। মহাবিশ্বের সব বস্তু পরস্পরকে আকর্ষণ করে। আর এই আকর্ষণ বল বস্তুগুলোর ভরের সমানুপাতিক। এটিই নিউটনের সূত্র। মহাবিশ্বকে বোঝার ক্ষেত্রে এটি একটি বৈপ্লবিক ধারণা ছিল। দীর্ঘ ২০০ বছরের বেশি সময় ভৌতবিজ্ঞানে এই তত্ত্বের প্রভাবের ধারেকাছে কিছু ছিল না। বলতে গেলে এটিই ছিল মহাবিশ্বের পরমতত্ত্ব। এই তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করেই মহাবিশ্বের সৃষ্টি ও নানা ঘটনা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে। অবশ্য এই করতে গিয়েই তত্ত্বটির সীমাবদ্ধতাও স্পষ্ট হতে থাকে। নিউটনের তত্ত্ব কৃষ্ণগহ্বর এবং মহাকর্ষীয় তরঙ্গের মতো ঘটনা ব্যাখ্যা করতে পারছিল না। 

এরপর বিশের দশকের গোড়ার দিকে আরেক বৈপ্লবিক তত্ত্ব নিয়ে হাজির হন আলবার্ট আইনস্টাইন। তিনি প্রস্তাব করলেন সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব। মহাবিশ্বের নানা ঘটনা ব্যাখ্যার পাশাপাশি দার্শনিক জগতেও এই তত্ত্বের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। স্থান এবং কালের বক্রতার মাধ্যমে মহাকর্ষীয় ত্বরণকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হলো। মহাকর্ষ নিয়ে নিউটনীয় ধারণাকেও বদলে দিল এই তত্ত্ব। 

কিন্তু মহাবিশ্ব তো আর ছোট জায়গা নয়। তাত্ত্বিকভাবে অসীমও বলা হয়। এই মহাবিশ্বের কিছু ঘটনা ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ হচ্ছে আইনস্টাইনের বৈপ্লবিক তত্ত্বও। আইনস্টাইনের তত্ত্বের সীমাবদ্ধতার সবচেয়ে পরিচিত উদাহরণটি হলো—কৃষ্ণগহ্বরের কেন্দ্র বা অনন্যতা (সিঙ্গুলারিটি)। এ ধরনের ঘটনায় এসে আইনস্টাইনের তত্ত্ব ভেঙে পড়ে। 

এবার দক্ষিণ কোরিয়ার সেজং ইউনিভার্সিটির একদল বিজ্ঞানীর গবেষণায় নিউটন এবং আইনস্টাইনের মহাকর্ষ ধারণার সীমাবদ্ধতার ইঙ্গিত পাওয়া গেল। তাঁরা দুই তারকার সমন্বয়ে গঠিত সৌর ব্যবস্থা যেখানে—দীর্ঘ প্রদক্ষিণ কাল এবং পরস্পরের মধ্যবর্তী দূরত্ব অনেক বেশি—এমন স্থানের মহাকর্ষ প্রচলিত তত্ত্বের ভিত্তিতে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। এ ধরনের সৌর ব্যবস্থাকে বলে ‘ওয়াইড বাইনারি’। এই ব্যবস্থায় শুধু দুটি তারকাই থাকে। এরা নিজ নিজ কক্ষপথে পরিভ্রমণ করে। এদের কেন্দ্র করে কোনো সৌরজগৎ নেই। 

দক্ষিণ কোরিয়ার বিজ্ঞানীদের এই আবিষ্কার চলতি মাসে দ্য অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। 

বিজ্ঞানীরা ৬৫০ আলোকবর্ষের মধ্যে অবস্থিত ২৬ হাজার ৫০০টি ওয়াইড বাইনারি বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁরা তথ্য সংগ্রহ করেছেন ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির গাইয়া মহাকাশ মানমন্দির থেকে। 

এই ওয়াইড বাইনারিগুলোর তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বিজ্ঞানীদের চোখে কিছু অদ্ভুত বিষয় ধরা পড়েছে। এই তারকাগুলোর নিজ নিজ কক্ষপথে কৌণিক ত্বরণ যখন খুবই কম থাকে—প্রতিবর্গ সেকেন্ডে দশমিক ১ ন্যানোমিটার, সেই সময় প্রাপ্ত ত্বরণ নিউটন-আইনস্টাইন মডেলের ওপর ভিত্তি করে যা হওয়ার কথা তার চেয়ে প্রায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ বেশি পাওয়া গেছে। 

তবে এই ত্বরণ যখন প্রতিবর্গ সেকেন্ডে ১০ ন্যানোমিটারের বেশি, তখন তাদের প্রাপ্ত ত্বরণ ঠিকই নিউটন-আইনস্টাইন মডেল অনুসরণ করে। অর্থাৎ অত্যন্ত কম ত্বরণের ক্ষেত্রেই তারকাগুলোর মহাকর্ষ বল অদ্ভুত আচরণ করে। সেখানে নিউটন-আইনস্টাইনের সূত্র আর খাটে না। 

মহাকর্ষের আদর্শ মডেলের যখন ব্যত্যয় ঘটে তখন ঘটনা ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে ডার্ক ম্যাটারের ধারণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বিজ্ঞানীরা এই ডার্ক ম্যাটার বা ডার্ক এনার্জির ধরন ও আচরণ সম্পর্কে এখনো নিশ্চিত নন। এটি এখনো তত্ত্বের পর্যায়ে রয়েছে। এ তত্ত্বে মনে করা হয়, মহাবিশ্বের গাঠনিক উপাদানের অধিকাংশই ডার্ক ম্যাটার। 

এখন ওয়াইড বাইনারি বা দ্বৈত তারকার এই অদ্ভুত মহাকর্ষীয় আচরণের পেছনে ডার্ক ম্যাটারের ভূমিকা থাকলে থাকতেও পারে। 

অবশ্য এ ঘটনা ব্যাখ্যার জন্য দক্ষিণ কোরিয়ার বিজ্ঞানীরা ‘মোডিফাইড নিউটনিয়ান ডায়নামিকসের’ (এমওএনডি) ধারণার ওপর ভরসা করছেন। এ ধারণার প্রথম প্রস্তাব করেন ইসরায়েলি বিজ্ঞানী মোরদেহাই মিলগ্রম, ১৯৮৩ সালে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই তত্ত্ব তারকার নগণ্য ত্বরণের সময় মহাকর্ষীয় বিচ্যুতিকে ব্যাখ্যা করতে পারার কথা। 

অবশ্য এমওএনডি ধারণা প্রভাবিত মহাকর্ষতত্ত্বে উল্লেখিত অপ্রত্যাশিত ক্ষেত্রে ১ দশমিক ৪ গুন ত্বরণ বৃদ্ধির ব্যাখ্যা রয়েছে। এই তত্ত্বের সহলেখকও মিলগ্রম। এই তত্ত্বকে বলে ‘অ্যা কোয়াড্রাটিক ল্যাগ্রাঙ্গিয়ান’ বা অ্যাকুয়াল। 

দক্ষিণ কোরিয়ার বিজ্ঞানীরা বলছেন, তাঁদের এই আবিষ্কার সরাসরি প্রমাণ করেছে, অত্যন্ত দুর্বল ত্বরণের ক্ষেত্রে আদর্শ মহাকর্ষ ধারণা ভেঙে পড়ে। 

গবেষণা প্রতিবেদনের সহলেখক কু হুন চে বলেন, ‘মহাবিশ্বে বহিঃক্ষেত্র প্রভাবিত স্থানে বৃত্তাকার কক্ষপথে কাইনেমেটিক ত্বরণ সম্পর্কে অ্যাকুয়াল তত্ত্ব বুস্ট ফ্যাক্টরের বিষয়ে যে ভবিষ্যদ্বাণী করে সেটি আমাদের পাওয়া বিচ্যুতির সঙ্গে মিলে যায়।’ 

নিউটন-আইনস্টাইনের তত্ত্ব যেমন ডার্ক ম্যাটারের মতো একটি কাল্পনিক বস্তুর ওপর নির্ভরশীল, তেমনই এমওএনডি তত্ত্বেরও কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার বিজ্ঞানীরা তাঁদের প্রত্যক্ষ করা ঘটনা ব্যাখ্যায় মোডিফাইড নিউটনিয়ান ডায়নামিকসের প্রস্তাব করেছেন, এটিও এখন পর্যন্ত নিছক একটি তত্ত্ব। এটিকে প্রতিষ্ঠিত করতে এবং সে অনুযায়ী আমাদের মহাবিশ্ব ও মহাকর্ষ সম্পর্কে ধারণা পরিবর্তনের আগে আরও বিস্তৃত পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনার দরকার আছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত