যে খনিতে হীরা খুঁজে পেলে নিয়ে যেতে পারবেন বাড়িতে

ইশতিয়াক হাসান
প্রকাশ : ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৫: ১৫

এমন একটি হীরার খনির কথা চিন্তা করুন তো, যেখানে চাইলেই বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে হীরার সন্ধানে নেমে পড়তে পারবেন। এমনকি এখানে কোনো হীরা পেলে সেটা সঙ্গে করে নিয়েও যেতে পারবেন। কেমন অবিশ্বাস্য শোনালেও মার্কিন মুল্লুকে এমন একটি খনি সত্যি আছে। 

খনিটির অবস্থান আরকানসাস রাজ্যের মারফ্রিজবোরো এলাকায়। এর বর্তমান নাম অবশ্য ক্রেটার অব ডায়মন্ডস স্টেট পার্ক। 

জন ওয়েসলি হাডলস্টন নামের এক ব্যক্তি কীভাবে আগ্নেয়গিরির রত্ন-সমৃদ্ধ মৃত জ্বালামুখে প্রথম হীরা খুঁজে পান এবং ‘ডায়মন্ড কিং’ বা ‘হীরক রাজা’ নামে পরিচিতি পেয়ে যান তা নিয়ে নানা ধরনের গল্প প্রচলিত আছে। সবচেয়ে জনপ্রিয় সংস্করণটি বলছে, ঘটনার সূচনা ১৯০৬ সালে। মধ্যবয়সী, অশিক্ষিত কৃষক হাডলস্টন তাঁর ২৪৩ একরের খামারের শালগমখেতে কাজ করছিলেন। এ সময়ই দুটি অদ্ভুত ধরনের চকচকে হলুদ কিন্তু স্বচ্ছ পাথর খুঁজে পেলেন। 

জিনিসগুলো আসলে কী সে সম্পর্কে নিশ্চিত না হওয়ায় গ্রাইন্ডিং হুইল দিয়ে পরীক্ষা করেন। তাঁকে বলা হয়েছিল এটি হীরা ছাড়া যেকোনো কিছুকে নির্দিষ্ট আকার দিতে পারে। তখনই খেয়াল করলেন পাথর দুটোর কিছু হয়নি, উল্টো এই চূর্ণ করার চাকার মধ্যে ক্ষত তৈরি করেছে। আর এ থেকে অনুমান করলেন হীরা পেয়ে গেছেন তিনি। এর দাম কেমন হতে পারে জানার জন্য কাছের শহর লিটল রকের এক স্বর্ণকারের কাছ পাঠালেন। 

রত্নের সন্ধানে ব্যস্ত তারাএখন তাঁর আবিষ্কারের জায়গাটি পৃথিবীর একমাত্র হীরার খনি, যেটি সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত। আর এখানে যে রত্নই খুঁজে পান না কেন সঙ্গে নিয়ে যেতে পারবেন। 

আনুমানিক ৩০০ কোটি বছর আগে শুরু হওয়া ধারাবাহিক ও নাটকীয় ভূতাত্ত্বিক পরিবর্তন এবং ভয়ংকর আগ্নেয় কার্যকলাপের ফলাফল হিসেবে হীরার খনিটির জন্ম। পৃথিবীর ভূত্বকের নিচে ৬০ থেকে ১০০ মাইলের মধ্যে উচ্চ তাপমাত্রা এবং চাপ কার্বনকে হীরাতে রূপ দেয়। তারপরে প্রেইরি ক্রিক নামে পরিচিত আগ্নেয়গিরির ছিদ্র গঠনের সময় গ্যাস এবং টুকরোসহ একটি প্রচণ্ড বিস্ফোরণ এই পাথর এবং খনিজগুলোকে পৃথিবীর গভীর থেকে ওপরে নিয়ে আসে। 

ক্রেটার অব ডায়মন্ডস স্টেট পার্কে খুঁজে পাওয়া নানা ধরনের হীরাআর এই হীরার খনি আবিষ্কারে বলা চলে গোটা দেশেই হাডলস্টন জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। এদিকে শহরের স্বর্ণকার তাঁকে জানান একটি হীরার ওজন ২ দশমিক ৬৩ ক্যারেট এবং অন্যটির ১ দশমিক ৩৮ ক্যারেট। যে জমিটি ১ হাজার ডলার ও একটি খচ্চরের বিনিময়ে কিনেছিলেন, লিটল রকের বিনিয়োগকারীদের কাছে ৩৬ হাজার ডলারে সেটা বেঁচে দিয়ে বেশ ভালো পরিমাণ লাভ হলো হাডলস্টনের। বিনিয়োগকারীরা একে একটি বাণিজ্যিক খনিতে পরিণত করলেন। 

হীরার খনির খবর অনেক রত্নসন্ধানীকে মারফ্রিজবোরোতে নিয়ে আসে। সংবাদপত্রগুলোর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এলাকার হোটেলগুলোর কোনো কামরা খালি না থাকায় অনেককে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয়। 

এখানেই চলে রত্নের খুঁজে অনুসন্ধানপরবর্তী সময়ে ঐতিহাসিক অনেক হীরারই সন্ধান মেলে খনিটিতে। যেমন স্ট্রোন ওয়াগনার ডায়মন্ডটির ওজন মাত্র ১ দশমিক ০৯ ক্যারেট হলেও এটি ছিল সব দিক থেকেই নিখুঁত বা ট্রিপল জিরো গ্রেডের। ৪.২৫ ক্যারেটের বিখ্যাত কান কেনারি হীরাটিরও সন্ধান মেলে এই খনিতে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাওয়া সবচেয়ে বড় হীরা আংকেল স্যাম ডায়মন্ডটিও উত্তোলন করা হয় এই খনি থেকে। এটার ওজন ৪০.২৩ ক্যারেট। ২০১৫ সালে পার্কে খুঁজে পাওয়া যায় ৮.৫৩ ক্যারেটের এসপেরানজা নামের হীরাটি। এটাকে কেটে সুন্দর আকৃতি দেওয়ার পর ওজনে দাঁড়ায় ৪.৬ ক্যারেট। ধারণা করা হয় এর দাম আনুমানিক ৫ লাখ ডলার বা প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা। এ ছাড়া এখানে মেলে ১৬.৩৭ ক্যারেট ওজনের অ্যামারিল্লো স্টারলাইট এবং ১৫.৩৩ ক্যারেটের স্টার অব আরকানসাস। 

কয়েকবার মালিকানা বদলের পর ১৯৭২ সালে আরকানসাস রাজ্যের পক্ষ থেকে হীরার খনিটি কিনে নেওয়া হয়। ৯১১ একর জায়গা নিয়ে গড়ে ওঠে ক্রেটার অব ডায়মন্ডস স্টেট পার্ক। এর মধ্যে দর্শনার্থীদের রত্ন অনুসন্ধানের জন্য উন্মুক্ত আছে ৩৭ একর এলাকা। আর ১৯৭২ সালের পর থেকে এই পার্কে মিলেছে ৩৫ হাজারের বেশি হীরা। 

অকাটা অবস্থায় বিখ্যাত এসপেরানজা হীরাগড়ে প্রতিদিন পার্কটিতে খুঁজে পাওয়া যায় দুটি করে হীরা। বাচ্চাদের হীরার জন্য মাটি খোঁড়া এবং দর্শনার্থীদের মাটির মধ্যে ছাঁকনি দিয়ে কাজ করতে দেখা যাওয়া এখানে অতি সাধারণ ঘটনা। তবে পার্কে এমন কিছু হীরাও মেলে যেগুলোর হিসাব থাকে না। বাচ্চাদের এবং পর্যটকদের সঙ্গে স্থানীয় রত্ন শিকারিরাও কখনো কখনো হীরা অনুসন্ধানে নামেন। তবে তাঁরা হীরা খুঁজে পেলেও পার্ক কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে নথিবদ্ধ করেন না। 

আবার হাডলস্টনের গল্পে ফিরে যাই। দ্রুতই সৌভাগ্য বিদায় নেয় তাঁর জীবন থেকে। অল্প সময়ের মধ্যে খনি বিক্রি করে পাওয়া টাকা উড়িয়ে দেন তিনি। ১৯৩৬ সালে মারা যান মোটামুটি কপর্দকহীন অবস্থায়। তবে তাঁকে স্মরণ করে যেখানে প্রথম হীরা খুঁজে পেয়েছিলেন হাডলস্টন, সে জায়গাটি চিহ্নিত করে রেখেছে পার্ক কর্তৃপক্ষ। 

চলো পরিবারের সবাই মিলে হীরা খুঁজিপার্কের দর্শনার্থী কেন্দ্র বা ভিজিটর সেন্টারে নানা ধরনের অকাটা হীরা সাজিয়ে রাখা হয়েছে দর্শনার্থীদের জন্য। পাশাপাশি এখনকার অনন্য ইতিহাস ও ভূতত্ত্বের গঠন তুলে ধরা ছবি দেখতে পাবেন। ডায়মন্ড ডিসকভারি সেন্টারে আপনি পার্কে পাওয়া পাথর এবং খনিজ সম্পর্কে জানার পাশাপাশি হীরা অনুসন্ধানের বিভিন্ন কলাকৌশলও শিখতে পারবেন। এমনিতে রংধনুর সাত রঙের হীরাই পাওয়া গেলে এই পার্ক বা খনি এলাকায় মেলে সাদা, বাদামি ও হলুদ রঙা হীরা। এ ছাড়া নীলকান্তমণি, পান্না, কোয়ার্টজ, আকিকসহ আরও নানা মূল্যবান রত্নপাথর পাওয়া যায় এই খনিতে। 

পার্ক এলাকায় দর্শনার্থীদের জন্য নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা আছে। যেমন হাঁটার জন্য পথ, বনভোজন ও ক্যাম্পিং করার জায়গা, উপহারের দোকান, রেস্তোরাঁ। আবার এখানে ডায়মন্ড স্প্রিং ওয়াটার পার্ক নামের যে জায়গাটি আছে, সেখানে গ্রীষ্মের উত্তপ্ত দিনে হীরা খুঁজে ক্লান্ত শরীরটাকে একটু শীতল করে নেওয়া যায়। 

যেখানে দেখিবে ছাই উড়াইয়া দেখ তাই, পাইলেও পাইতে পার অমূল্য রতনচারদিকে কড়া নজর রেখে খনি এলাকাটিতে হাঁটা-চলা করলেও মাটির ওপরের দিকে থাকা হীরার খোঁজ পেয়ে যেতে পারেন। খোঁড়াখুঁড়ির জন্য বাড়ি থেকে যন্ত্রপাতি নিয়ে আসতে পারেন। তবে না আনলেও দোষ নেই, পার্ক থেকে বালতি, বেলচা, কোদালসহ রত্ন অনুসন্ধানের অন্যান্য যন্ত্রপাতি কিনতে বা ভাড়া নিতে পারবেন। 

কোনো হীরা যদি খুঁজে পেয়েই যান, তবে এটি নথিবদ্ধ করে নিতে হবে। ও আরেকটা কথা, এখানে হীরা খুঁজতে কিন্তু টিকিট কাটতে হবে। টিকিটের দামটা খুব বেশি নয়। বড়দের জন্য ১০ ডলার, ছয় থেকে ১২ বছর যাদের বয়স তাদের জন্য ৬ ডলার আর বয়স ছয়ের নিচে হলে টিকিটই কাটতে হবে না। কাজেই ওয়েস্টার্ন বই পড়ে কিংবা সিনেমা দেখে যদি খোঁড়াখুঁড়ির একটা ভূত মাথায় চেপেই বসে, চলে যেতে পারেন আরকানসাসের এই হীরার খনিতে। 

সূত্র: এটলাস অবসকিউরা, আরকানসাস স্টেট পার্কস

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত